১৪ ট্রাক চিনি : মালিক সন্ধানে গা ছাড়া পুলিশ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জুলাই ২০২৪, ১২:৩২:০৭ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী :
সিলেট শহরতলীর উমাইরগাঁওয়ে জব্দকৃত ১৪ ট্রাক চিনি চোরাচালানীদের ৩৮ দিনেও শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। চোরাচালানের সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে পুলিশের গাছাড়া ভাব সচেতন মহলে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।
এ ঘটনায় গ্রেফতার দুই ট্রাক চালক তাদের জবানবন্দিতে কয়েকজনের নাম প্রকাশ করলেও তাদের কাউকে আজও পাকড়াও করতে পারেনি আইনশৃংখলা বাহিনী।
দু’আসামির জবানবন্দিতে তিনজনের নাম :
১৪ ট্রাক চিনি জব্দের ঘটনায় এ পর্যন্ত সদরুল আমিন ও মুনসুর আলী নামের দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা দু’জনেই ট্রাক চালক। গ্রেফতারের পর দেয়া সদরুল আমিন তার জবানবন্দিতে নাঈম আহমদের নাম বলেছেন। আর মুনসুর আলীর জবানবন্দিতে নূর ইসলাম ও দেলোয়ার মোল্লার নাম এসেছে। নাঈম আহমদের কোনো পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে, নূর ইসলাম ও দেলোয়ার মোল্লার পরিচয় পাওয়া গেছে। এই দেলোয়ার মোল্লার একটি ছবি গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রকিফুল ইসলাম শ্রাবনের সঙ্গে রয়েছে। দেলোয়ার মোল্লার ফেসবুক আইডিতে পাওয়া গেছে ওসি রফিকুলের সঙ্গে ছবিটি। আর নুর ইসলাম এক সময় ট্রাক চালক ছিলেন। নাঈম আহমদ ও নূর ইসলাম ট্রাক ভাড়া করেন আর দেলোয়ার মোল্লা পুলিশের বিষয় দেখবেন। জবানবন্দিতে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু চোরাই চিনি চোরাচালানের মালিকের কোনো তথ্য তাদের জবানবন্দিতে নেই।
রাস্তা দেখাতে ছিল ৩/৪ মোটরসাইকেল ও ১ প্রাইভেট কার :
জবানবন্দিতে সদরুল বলেন, “আমি ৩ বছর সৌদি আরব ছিলাম। গত ৩১ জানুয়ারি দেশে আসি। আমার বাবার দুটো ট্রাক আমি দেশে আসার পর দেখাশোনা করি এবং ড্রাইভারকে হেল্প করি। ৫ জুন একটা মোটরসাইকেলে করে দু’জন ব্যক্তি আমাদের ট্রাকস্ট্যান্ডে আসে ট্রাক ভাড়া করতে। এদের মধ্যে একজনের নাম নাঈম আহমদ। এরা দু’জন আমাদের দুটো ট্রাকসহ মোট চারটি ট্রাক প্রত্যেকটা চার হাজার টাকা করে ভাড়া করে। আমাদেরকে মাল পরিবহন করার কথা বলে ভাড়া করে। আমার ড্রাইভার আহাদ ও মুনির গাড়ি নিয়ে যায় ভাড়া নিতে। ট্রাক দুটো ভোলাগঞ্জ পাড়ুয়া বাজার নিয়ে যায়। গাড়ি সালুটিকর তেল পাম্পে নিয়ে যায়। ড্রাইভার জানে না যে, এসব অবৈধ চিনি পরিবহন করবে। সালুটিকর তেল পাম্পে যাবার পরে আমার ড্রাইভার মুমিন ফোন করে বলে যে, ওর ঘুম পাচ্ছে – আমি যেন যাই। আমি তখন ফজরের আগে সালুটিকর তেল পাম্পে যাই – ড্রাইভারের সাথে কথা বলে তাকে জাগিয়ে রাখার জন্য। গিয়ে দেখি ১৬/১৭ টা ট্রাক লোড অবস্থায় পাম্পের সামনে দাঁড়ানো। তখন ৩/৪ টা মোটরসাইকেল ও ১ টি সাদা রঙের প্রাইভেট কার আসে। এরা ট্রাকগুলোকে শিবেরবাজারের দিকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভাদেশ্বর স্কুলের সামনে যাবার পরেই একজন মোটরসাইকেল থেকে বলে ট্রাক ঘুরিয়ে ফেলার জন্য। আমাদের ট্রাক ঘুরানো হয়। হঠাৎ দেখি পুলিশ এসে রাস্তা আটকাইছে। তখন আমরা গাড়ি থেকে নেমে জানতে পারি যে এগুলো অবৈধ মালামাল। তখন দৌড়ে পালিয়ে যাই ।’
গত ৩০ জুন সিলেটের মহানগর হাকিম তৃতীয় আদালতের বিচারক উম্মে হাবিবা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় সদরুল আমিনের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। সদরুল আমিন সিলেট সদর উপজেলার উমদারপাড়ার আফান আলীর পুত্র।
চোরাচালানে চিনি ছিল ১৭ ট্রাক :
আদালতে দেয়া জবানবন্দি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুই আসামি তাদের জবানবন্দিতে ঘটনার আগ মুহূর্তে সালুটিকরে এক সাথে ১৬/১৭ টি ট্রাকের কথা বলেছেন। এর মধ্যে সদরুল আমিন বলেন, ১৬/১৭ টা ট্রাক লোড অবস্থায় পাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন।
আর অন্য আসামি মুনসুর আলী বলেন, আমি ট্রাক চালাইয়া সালুটিকর আসি। তখন সেখানে দেখি আরও ১৬-১৭টি ট্রাক দাঁড়ানো। নূর ইসলাম আমাকে ফোনে বলে যে, উমাইরগাঁও রোড ধরে যাওয়ার জন্য। কিছু ট্রাক এক রোডে, কিছু অন্য রোডে, আবার সবকিছুর নির্দেশনা ফোনে ফোনে হচ্ছিল । জবানবন্দিতে ১৪ ট্রাক চিনি ধরা পড়ার আগে আরও তিনটি ট্রাক পালিয়ে যাওয়ার তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু, ওই ট্রাকগুলো কৌশলে অন্য রাস্তা দিয়ে পাচার করা হয়েছে। কোন রাস্তা দিয়ে কে নিয়ে গেছে তারও কোনো হদিস পাননি তদন্ত কর্মকর্তা।
নূর ইসলাম এখনও অধরা :
অভিযোগ রয়েছে, এক সময়ের ট্রাক চালক নূর ইসলাম মুলত পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক ওসির লাইনম্যান হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। সে নুরুজ্জামান নুরু নামেও পরিচিত। জানা গেছে, সে প্রায় দুই বছর থেকে ভারতীয় চোরাই চিনির লাইনম্যান হিসাবে কাজ করছে। এর আগে সে একজন ট্রাক চালক ছিলো। গ্রেফতারকৃত মুনসুর আলীর জবানবন্দি অনুযায়ী, ট্রাক ভাড়া করেছিলেন নূর ইসলাম। কিন্তু নূর ইসলাম এখনও অধরা। নুর ইসলাম ওরফে নুরুজ্জামান নুরু গোয়াইনঘাট উপজেলার বাসিন্দা বলে সূত্র জানিয়েছে।
মালিক সন্ধানে গা ছাড়া পুলিশ :
সিলেটে প্রকাশ্যে এক সাথে ১৪ ট্রাক চিনির বড় চোরাচালান আটকের এতদিন পর মালিককে শনাক্ত করতে না পারার বিষয়টি রহস্যময়। মাত্র দুই ট্রাক চালককে গ্রেফতার করেই যেন ক্ষান্ত তদন্ত কর্মকর্তা। চোরাচালানের সাথে একটি মোটরসাইকেল (সিলেট ল-১২-২৭৪৯) এবং সিলভার কালারের একটি প্রাইভেট কারও (সিলেট গ-১১-০৮৯৫) জব্দ করা হয়েছিল।
আদালতে দেয়া দুই আসামির জবানবন্দি অনুযায়ী এই মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কার চোরাই চিনির ১৪ ট্রাককে রাতের আঁধারে রাস্তা দেখিয়ে শিবেরবাজারের দিকে নিয়ে আসে। ঘটনার এতদিন পরেও এই মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের মালিক বের করা সম্ভব হয়নি। অথচ এই দুটো যানের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেলেই চোরাচালানের আদ্যোপান্ত বেরিয়ে আসত বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ১৪ ট্রাক চোরাই চিনি চোরাচালান মামলার গাছাড়া তদন্তের বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট চ্যাপ্টারের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বিস্ময় প্রকাশ করেন।
পুলিশ কর্মকর্তারা যা বলেন
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ গতকাল শনিবার দুপুরে সিলেটের ডাককে বলেন, এ ঘটনায় সম্পৃক্ত সকল ট্রাক চালকের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। ১৪ ট্রাক চিনির মালিক ও প্রাইভেট কারের মালিককে শনাক্তের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
১৪ ট্রাক চোরাই চিনির মামলায় কয়েক দিনের মধ্যেই একটা ভালো খবর পাওয়া যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন জালালাবাদ থানার ওসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জালালাবাদ থানার এসআই মো. আসাদুজ্জামান গতরাতে বলেন, জব্দকৃত চোরাই চিনির মালিক কয়েকজন। এদের শনাক্তে কাজ চলছে। প্রাইভেট কারের মালিকের সন্ধান পাওয়া গেলেও ওই মালিক কারটি অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছেন। আবার যিনি কিনেছেন তার কাছ থেকে আরেক জন নাকি নিয়ে গেছেন। এ রকম নানা জটিলতা আছে। আদালতে দুই আসামির দেয়া জবানবন্দি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। যাদের নাম এসেছে তাদের ব্যাপারেও খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, সিলেট মহানগর পুলিশের জালালাবাদ থানার উমাইরগাঁওয়ে গত ৬ জুন বৃহস্পতিবার ১৪ ট্রাক চোরাই চিনি জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় পরদিন পুলিশের এসআই মো. সালাহ উদ্দিন বাদী হয়ে জালালাবাদ থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেন। মামলা নম্বর-০৫।