সিলেটে কালো অধ্যায়ের তিন ভিলেন
ডিআইজি মিজান, কমিশনার জাকির ও ডিসি আজবাহার আলীকে বদলি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৩:৫৬ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী :
মো. জাকির হোসেন খান। ডিআইজি পদের এই কর্মকর্তা সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার। শেখ হাসিনার সরকার পতনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন সফলতার দ্বারপ্রান্তে তিনি তখন নিজেকে রক্ষায় ছুটে যান নিরাপদ আশ্রয়ে। নিজে নিরাপদ স্থানে থেকে অধীনস্থ ফোর্সকে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার উপর বল প্রয়োগের নির্দেশ দেন। সাধারণ লোকজনের উপর হামলে পড়ার নির্দেশ দেন ক্রাইসিস রেসপন্স টিম ‘সিআরটি’কেও। তার কান্ডজ্ঞানহীন একটি নির্দেশনায় নগরের রাজপথ রক্তে ভেসে যায়। শত-শত মানুষ আজ পঙ্গু, কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বেডে। আর সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি শাহ শফিউর মিজানুর রহমানও একইভাবে বল প্রয়োগের নির্দেশ দেন। তার নির্দেশনায় গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও গোয়াইনঘাট আর বানিয়াচংয়ে ২২ জন খুন হন। আর সিলেট নগরীতে ডিসি আজবাহার আলী শেখের নির্দেশে প্রকাশ্যে দিবালোকে সাংবাদিক এটিএম তুরাবকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়। দেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে পুন্যভূমি সিলেটে এমন রক্তাক্ত, কালো অধ্যায় রচনা করার পর এবার এই তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে সিলেট ছাড়তে হচ্ছে। যদিও এরই মধ্যে আজবাহার আলী শেখের বিরুদ্ধে হত্যাসহ চারটি আর জাকির হোসেন খান একটি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। আর ডিআইজি শাহ শফিউর মিজানুর রহমানের দুর্নীতির তদন্তে নেমেছে দুদক। সিলেটের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে এই তিন পুলিশ কর্মকর্তা কার্যত ভিলেনের ভূমিকা পালন করেন। গতকাল বুধবার পুলিশের বিতর্কিত এই তিন কর্মকর্তাকে বদলি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব মো. মাহাবুবুর রহমান শেখ স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তাদেরকে বদলি করা হয়।
এর মধ্যে সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার জাকির হোসেন খানকে ঢাকার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআইতে আর সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি শাহ শফিউর মিজানুর রহমানকে রেলওয়ে পুলিশে বদলি করা হয়েছে। ব্যাপক আলোচিত নগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আজবাহার আলী শেখকে সিলেট মহানগর পুলিশ থেকে সরিয়ে রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয়ে সুপারনিউমারারি অতিরিক্ত ডিআইজি হিসাবে সংযুক্ত করা হয়েছে।
ডিআইজির নির্দেশে বহু হতাহত
জানা গেছে, সিলেট মহানগর ব্যতীত সিলেট বিভাগের চার জেলার পুরোটাই ডিআইজির অধীনে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই শক্তভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অধীনস্থ ফোর্সকে নির্দেশ দেন ডিআইজি মিজান। অবশ্য এর নানা কারণও আছে। বিগত দিনে লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম আর ঢাকায় পোস্টিংকালে তিনি এর প্রমাণও দিয়েছেন। এর মধ্যে কেবল লক্ষ্মীপুরের পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালনকালে তিন শতাধিক মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়। সে কারণে স্বৈরশাসকের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই পুলিশ কর্মকর্তা সিলেটেও এর ব্যত্যয় ঘটাননি। বল প্রয়োগের নির্দেশ দেন সর্বত্র। কেবল তার হিসেবেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সিলেটর বিভিন্ন জায়গায় ১৮ জন নিহত হয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যায় তার সাথে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, হবিগঞ্জ ২ জন, বানিয়াচংয়ে ৭ জন, গোলাপগঞ্জে ৭ জন আর বিয়ানীবাজারে ২ জন নিহত হন। অবশ্য, তিনি প্রত্যেকটি ঘটনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে নানান যুক্তিও দেন। বদলির কথা উল্লেখ করে ডিআইজি শাহ শফিউর মিজানুর রহমান সিলেটের ডাককে বলেন, কেবল আমি নই দেশের সব ডিআইজি ও পুলিশ কমিশনারকে বদলি করা হয়েছে। নতুন ডিআইজি যোগদানের পরই দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সিলেট ছেড়ে পরবর্তী গন্তব্যে চলে যাবেন বলে তিনি জানিয়েছেন। অবশ্য, গতকাল বুধবার পর্যন্ত সিলেট বিভাগের কোথাও এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে কোনো মামলা দায়েরের ঘটনা ঘটেনি।
নিজে নিরাপদ থেকে বল প্রয়োগের নির্দেশ
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগেই নিজেকে রক্ষায় নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে যান এসএমপি কমিশনার জাকির হোসেন খান। নিরাপদে গিয়ে আন্দোলনকারীদেরকে দমাতে গুলিবর্ষণ, সাউন্ড গ্রেনেড হামলাসহ সবধরনের হামলার নির্দেশ দেন। সিআরটিকে মাঠে নামারও আদেশ দেন। তার আদেশে নগরের বিভিন্ন স্থানে সর্বশক্তি নিয়োগ করে পুলিশ। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় সিলেট নগরী। বহু মানুষ হতাহত হয়। তাদের অনেকেই আজও হাসপাতালের বেডে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। কমিশনার জাকির হোসেন খানের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মো. সাজন আহমদ সাজু নামের এক গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। মামলাটি কোতোয়ালি থানায় রেকর্ড হয়েছে। তিনি অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনের মামলার প্রধান আসামি।
গতকাল তার সাথে কথা হয়। সিলেটের ডাককে তিনি বলেন, পরিস্থিতির জন্যে কেবল আমাকে দায়ী করা ঠিক হবে না। আমরা কেবল সরকারের আদেশ পালন করেছি। হতাহতের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বদলির আদেশ হয়ে গেছে। যেকোনো সময় পরবর্তী কর্মস্থলে যোগদান করবো।
আজবাহারের বেটাগিরির শেষ নেই
সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটে পুলিশ বিভাগে যে কর্মকর্তা সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত তিনি আজবাহার আলী শেখ। চিনি চোরাচালানের ভাগবাটোয়ারা থেকে শুরু করে কোথায় নেই তিনি। সিলেট মহানগর পুলিশের উত্তর বিভাগের ডিসি পদে কর্মরত টানা ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে। এর বদৌলতে গড়ে তুলেন নিজস্ব অপরাধ সাম্রাজ্য। ছাত্রলীগ ক্যাডারদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে সিলেটে সর্বপ্রথম তার হাত দিয়েই চিনি চোরাচালান বেপরোয়াভাবে শুরু হয়।
তার আগের কর্মস্থল ঝিনাইদহে সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল এএসপি) থাকাবস্থায় সরকার বিরোধীদের টার্গেট কিলিং শুরু করেন। বিএনপি-জামায়াতের ১৪ নেতাকর্মী তার হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন বলে বিভিন্ন সংবাদপত্রে উঠে এসেছে। এই আজবাহার আলী শেখের নির্দেশে গত মাসে নগরের বন্দরবাজারে সাংবাদিক এটিএম তুরাবকে হত্যা করে আরেক পুলিশ কর্মকর্তা এডিসি সাদেক দস্তগীর। এখানেই থেমে যাননি আজবাহার আলী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে হ্যান্ড মাইকে ছাত্র জনতাকে হত্যার হুমকিও দেন। যখন পুলিশের আক্রমণে আন্দোলনকারীরা নগরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার গলিতে আশ্রয় নেন আজবাহার আলী তখন হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দেন, ‘আসুন বাপের বেটা হলে বেরিয়ে আসুন, আসুন বেরিয়ে আসুন, বাপের বেটা হলে বেরিয়ে আসুন।’ এভাবে ঘোষণা দিয়ে আবার তিনি অট্টহাসিও দেন। একজন পুলিশ কর্মকর্তা হয়েও তার এমন পেশিশক্তির ‘বেটাগিরির’ ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। তার বিরুদ্ধে সাংবাদিক এটিএম তুরাব হত্যা মামলাসহ চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। অবশ্য, এত দাপুটে এই পুলিশ কর্মকর্তা এখন অনেকটা চুপসে গেছেন। চলে গেছেন একেবারে আত্মগোপনে। তার বক্তব্য জানতে চেয়ে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেয়া হলেও মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।