সাংবাদিক এটিএম তুরাব হত্যা মামলা
বিজিবি’র আটকের পর ওসি মঈনকে ছেড়ে দিল পুলিশ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১:০৬:৫৪ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী :
সিলেটের সাংবাদিক এটিএম তুরাব হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি এসএমপি’র কোতোয়ালি থানার বহুল আলোচিত সাবেক ওসি মঈন উদ্দিনকে বিজিবি আটক করলেও পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে।
গতকাল সোমবার ভোররাতে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার গোপীনাথপুর এলাকা থেকে টাস্কফোর্স আটক করে থানা পুলিশে সোপর্দ করার ঘণ্টা দুয়েক পরই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। একটি হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামিকে ছেড়ে দেয়ার ঘটনায় রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এই সুযোগে ওসি মঈন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন বলে আশংকা তৈরি হয়েছে।
হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. রেজাউল হক খান গতরাতে সিলেটের ডাককে ওসি মঈনকে ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, ওসি মঈন উদ্দিনের নামে একটি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্রের বিষয়ে বিজিবির একটি দল তার বাড়িতে গিয়েছিল এবং বিজিবি মঈনকে থানায় নিয়ে আসে। লাইসেন্স নিলেও মঈন কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্র ক্রয় করেননি। তার বিরুদ্ধে কোনো গ্রেফতারী পরোয়ানাও নেই। আবার কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করতে হলে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি নিতে হয়। ওসি মঈনের বিষয়ে এরকম কিছু না থাকায় তিনি স্বাভাবিকভাবেই থানা থেকে চলে যান। আর বিজিবি সীমান্তের পাঁচ কিলোমিটারের বাইরে তো অভিযান পরিচালনা করতে পারে না। এমনকি বিজিবির আসামি গ্রেফতারেও অনুমতি নেই বলে জানান হবিগঞ্জের এসপি।
জানা গেছে, ওসি মঈন উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুরের গোপীনাথপুরে অস্ত্র রয়েছে এমন খবরে গতকাল সোমবার ভোররাতে বিজিবির সদস্যরা অভিযান চালায়। মাধবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এমকেএম ফয়সাল অভিযানে নেতৃত্ব দেন। পরে অস্ত্র পাওয়া না গেলেও ওসি মঈন উদ্দিনকে (৪৩) আটক করে মাধবপুর থানায় সোপর্দ করা হয়।
৫৫ বিজিবির হবিগঞ্জ ব্যাটালিয়নের সহকারী পরিচালক মো. ইয়ার হোসেন লিখিতভাবে মাধবপুর থানার ওসিকে জানিয়ে মঈনকে সোপর্দ করেন। বিজিবির দেয়া ওই পত্রে বলা হয়, ‘১৪ জন বিজিবির সদস্যসহ মাধবপুর উপজেলার নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে ও মনতলা পুলিশ ফাঁড়ির প্রয়োজনীয় অফিসার-ফোর্সের সহায়তা নিয়ে অদ্য ২৩ সেপ্টেম্বর তারিখে মাধবপুর থানাধীন গোপীনাথপুর মাস্টার বাড়ী মনতলা সাকিনস্থ মঈন উদ্দিন এর বাড়ীতে টাস্কফোর্স পরিচালনা করি। টাস্কফোর্স পরিচালনাকালে মঈন উদ্দিনের বাড়ীতে কোন প্রকার অস্ত্র পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে জানা যায় যে, আটককৃত মঈন উদ্দিন এসএমপি কোতয়ালী মডেল থানার ( মামলা নং- ১৪/৩৬৯, তারিখ-২০/০৮/২০২৪খ্রিঃ, ধারা-১৪৩/১৪৭/১৪৮/৩০২/১৪৯/৩৪ পেনাল কোড- ১৮৬০) এর এজাহারভুক্ত আসামী। এমতাবস্থায়, তার বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করছি।’
আটক ওসি মঈন উদ্দিন গোপীনাথপুরের ইমাম উদ্দিনের পুত্র। গতকাল সোমবার দুপুরে মাধবপুর থানার ডিউটি অফিসার উপ-পরিদর্শক মু. সাদরুল হাসান খান তার থানায় ওসি মঈন উদ্দিন আটক রয়েছেন বলে সিলেটের ডাককে নিশ্চিত করেন। তবে বহুবার কল করার পরে মাধবপুর থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন একবার কল রিসিভ করলেও তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
সূত্র বলছে, ওসি মঈন উদ্দিনের ব্যাচমেট হওয়ায় মাধবপুর থানার ওসি মামুন তাকে নিরাপদ রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
গত ১৮ জুলাই সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র কোর্ট পয়েন্টে তরুণ সাংবাদিক এটিএম তুরাবকে লক্ষ্য করে যে ক’জন পুলিশ সদস্য সরাসরি গুলিবর্ষণ করেন ওসি মঈন উদ্দিন তাদের অন্যতম। সাংবাদিক তুরাব হত্যার ঘটনায় নিহতের সহোদর আবুল আহসান মো. আযরফ জাবুরের দায়েরকৃত মামলার এজাহারের ৬নং আসামি হলেন ওসি মঈন উদ্দিন। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পরে ওসি মঈন উদ্দিন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার আশংকা করছেন অনেকে। যদি তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান তাহলে এর দায়ভার কে নেবেন- বিভিন্ন মহল থেকে এমন প্রশ্ন উঠেছে।
২০০৬ সালে বাংলাদেশ পুলিশে উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদে যোগদানের পর ওসি মঈন উদ্দিন পর্যায়ক্রমে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানা, ছাতক থানা, বিশ্বম্ভরপুর থানা, দিরাই থানা, মৌলভীবাজার জেলার সদর থানা, কুলাউড়া থানা, বড়লেখা থানা, কুলাউড়া সার্কেল অফিস, সিলেট জেলার কানাইঘাট থানা, বালাগঞ্জ থানা ও এসএমপির মোগলাবাজার থানায় কর্মরত ছিলেন।
সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ১৩ জানুয়ারি সিলেট মহানগর পুলিশের এয়ারপোর্ট থানার ওসি হিসেবে মঈন উদ্দিন যোগ দেন। এরপর বাতিল হওয়া জাতীয় সংসদের নির্বাচনের মুহূর্তে গত ১২ ডিসেম্বর তাকে কোতোয়ালি থানায় বদলি করে নির্বাচন কমিশন। একই সাথে দেশের ৩৩৮ থানার ওসিকে নির্বাচন কমিশন বদলি করে তাদের কর্মস্থল থেকে দুরের থানায়। কিন্তু কোতোয়ালি ও এয়ারপোর্ট থানা একই নির্বাচনী আসনভুক্ত হওয়ার পরেও তাকে কেন একই আসনের অভ্যন্তরেই বদলি করা হয় তা নিয়ে ওই সময়ে প্রশ্ন দেখা দিলেও কেউ সাহস করে কিছু বলতে পারেননি। কারণ, চিনি চোরাচালান চক্রের সাথে তার দহরম-মহরম দিন বদলে দিয়েছে। তিনি কেবল এসএমপির দুই থানার ওসির দায়িত্ব পালনকালে শুধুমাত্র চিনি চোরাচালান খাত থেকেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও এসএমপির উত্তর বিভাগের ডিসি আজবাহার আলী শেখের অন্যতম সহযোগী হিসেবে ওসি মঈনের দাপটও ছিল সংশ্লিষ্ট অঙ্গনে। নগরের অস্ত্রবাজদের সাথে তার সখ্যতা ছিল চোখে পড়ার মতো। কেবল চিনি চোরাচালানই নয় চোরাচালান চক্রকে সহযোগিতার বিনিময়ে প্রতিদিন মোটা অংকের বখরা নেওয়ারও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
সর্বশেষ কোতোয়ালি থানার ওসি হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান ঠেকাতে সিলেট নগরীতে তার নেতৃত্বে ছাত্র জনতার উপর একাধিকবার অতর্কিত হামলা ও গুলিবর্ষণ করা হয়। গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই এক সময়ের দুর্দান্ত প্রতাপশালী ওসি মঈন উদ্দিন সিলেট থেকে পালিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে বলে সিলেটের ডাককে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।