বহুমুখী সংকটে সিলেটের চা শিল্প
চা উৎপাদনে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১:৩১:০৪ অপরাহ্ন
নূর আহমদ :
বহুমুখী সংকটে পড়েছে সিলেটের চা শিল্প। সিলেট বিভাগের তিন জেলায় অন্তত ৪২টি বাগান হুমকির মুখে রয়েছে। যে কোন মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বাগানগুলো। আবার অনেক বাগানে শ্রমিকদের মজুরি প্রদান অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। এতে শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। শ্রমিক নেতারা বলছেন, পূজার আগে মজুরি পরিশোধ না করলে সম্মিলিত আন্দোলনের ডাক দিবেন। অন্যদিকে বাগান মালিকদের দাবি আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাগান পরিচালনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এই শিল্পকে বাঁচাতে হলে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অকশনে (নিলামে) সিন্ডিকেটের আধিপত্য ভেঙে দিতে হবে। ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণপ্রাপ্তি সহজলভ্য করতে হবে।
চা শিল্প সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান সিলেটের মালনীছড়ায় ১৮৫৭ সালে শুরু হয় বাণিজ্যিক চা-চাষ। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, পঞ্চগড়সহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায়। বিশেষ করে সিলেটের তিন জেলায় ১৩৫টি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯২, হবিগঞ্জে ২৪ ও সিলেটে ১৯টি চা বাগান রয়েছে। এসব বাগানে অর্ধলক্ষাধিক চা শ্রমিক রয়েছেন। কিন্তু, ২০২২ সালের শ্রমিক বিক্ষোভের পর থেকে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো তা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাগান মালিক পক্ষ। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে চা বাগান পরিচালনায়।
মালিকপক্ষের আরো দাবি, উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, ঋণের সুদহার ও বৈরী অবহাওয়ায় সংকট দিন দিন বাড়ছে। এছাড়াও, ভারত থেকে চোরাইপথে আসছে নি¤œ মানের চা। যা দেশীয় বাজারে প্রভাব ফেলার পাশাপাশি মালিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ব্রোকার্সদের সিন্ডিকেট, প্রতিকূল আবহাওয়া ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটে নষ্ট হচ্ছে চায়ের গুণগত মানও। এছাড়া প্রতি কেজি চায়ের উৎপাদন খরচ ২শ’ টাকার বেশি হলেও নিলামে সেই চা বিক্রি করতে হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়। ব্যাংক সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১৪ শতাংশ। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ১৬৭ বছরের পুরনো এই শিল্পে আরো ধস নামবে।
সম্প্রতি সিলেটের চা শিল্পের সংকটময় পরিস্থিতির উত্তরণের জন্য ১০টি সুপারিশ সম্বলিত আবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বরাবরে পেশ করেছেন সিলেটের চা বাগান মালিকরা। এতে তারা বলেছেন, বর্তমানে চায়ের প্রতি কেজি উৎপাদন খরচ প্রায় ২৫০ টাকা। বাংলাদেশ চা বোর্ড, বাংলাদেশীয় চা সংসদ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ টি ট্রেডার্স এসোসিয়েশনের সমন্বয়ে চায়ের নিলামমূল্য নিম্নতম ৩শ’ টাকা নির্ধারণ করলে চা শিল্প আপাতত রক্ষা পেতে পারে।
এছাড়া, নিম্নতম মূল্যের উপরে চায়ের মান অনুযায়ী নিলাম মূল্য নির্ধারিত হতে পারে। চায়ের চোরাচালালান রোধ করার দাবি তুলে ধরে তারা বলেন, পঞ্চগড়ে উৎপাদিত চা আমাদের জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও ওখানে চা উৎপাদনের কোন নিয়মনীতি না মেনে খুবই নিম্নমানের চা উৎপাদিত হচ্ছে। ফ্যাক্টরি থেকে কোন ট্যাক্স-ভ্যাট পরিশোধ না করে অবৈধভাবে চা বিক্রি হচ্ছে। এই নিম্নমানের চা বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানসম্মত চায়ের নিলাম বাজারে যথাযথ মূল্য পাওয়া থেকে বাধার সৃষ্টি করছে।
মালিকপক্ষ আরো জানান, ছোট বড় প্রায় সব বাগানই বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে হাইপোথেটিক লোন নিয়ে থাকে এবং চায়ের নিলাম মূল্য সরাসরি কৃষি ব্যাংকে জমা হয়ে তা পরিশোধ করা হয়। এই ঋণ পরিশোধের সুদের হার ৯% থেকে বর্তমানে ১৩% করা হয়েছে। বর্তমান অবস্থায় তা পরিশোধ করা বাগানগুলোর পক্ষে অসম্ভব। বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পরিশোধের সুদের হার ৯% রাখার জন্য এবং ঋণ পরিশোধের সময়সীমার ব্যাপারে শিথিলনীতি গ্রহণ, রুগ্ন ও উন্নয়নশীল চা বাগানকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা জরুরি। একই সাথে চা বোর্ডের বাধ্যতামূলক ২.৫% সম্প্রসারণ আবাদ কার্যক্রম আপাতত স্থগিত রেখে শূন্যস্থান পূরণ করার উপর জোর দেয়া জরুরি বলে উল্লেখ করেন মালিকরা।
বাগান পরিচালনায় নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরে মালিকরা আরো বলেন, বর্তমানে বাগানগুলোর হাতে সম্প্রসারণ কার্যক্রমে বিনিয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত তহবিলও নেই। তাই এই সম্প্রসারণ কার্যক্রম কয়েক বছরের জন্য স্থগিত রেখে শূন্যস্থান পূর্ণ করে উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়োজন। চায়ের মান রক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে মালিকপক্ষ থেকে বলা হয়, ঘন ঘন বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে ফ্যাক্টরিতে সবুজ কাঁচা চা পাতা (যা পচনশীল) প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে চায়ের মান রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। চা ফ্যাক্টরিগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবি জানানো হয়।
এছাড়া, চা শিল্পের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি বিবেচনায় চা শিল্পকে ভ্যাট ও ট্যাক্স থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়ার জন্য তারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে আবেদন জানান। আরো জানানো হয়, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চা আমদানির চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় চা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমদানির উপর শুল্ক বৃদ্ধি করে চা আমদানি নিরুৎসাহিত করার কল্পে ব্যবস্থা গ্রহণসহ চা শিল্প বাঁচাতে সুদৃষ্টি কামনা করেন বাগান মালিকরা।
অপরদিকে, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা জানান, সিলেটে চা বাগানগুলোর অবস্থা ভালো নেই। চা উৎপাদন আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। মালিকপক্ষ সরকারি ঋণ পাচ্ছে না সহ নানা অজুহাত দেখাচ্ছে। এতে তার ভ্যালির ২৩টি বাগানের মধ্যে ৮টি বাগানে শ্রমিকের মজুরি ও রেশন অনিয়মিত হয়ে পড়ছে বলে জানান তিনি। রাজু গোয়ালা জানান, এরই মধ্যে বুড়জান চা বাগানে বিক্ষোভ হয়েছে। রাজু গোয়ালা আরো জানান, তার ভ্যালিতে স্থায়ী অস্থায়ী প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক রয়েছে। দিন দিন এদের জীবন জীবিকা হুমকিতে পড়েছে। তিনি বলেন, আমরা চাই মালিক বাঁচুক শ্রমিকও বাঁচুক। এই শিল্প বাঁচাতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের বালিসিরি ভ্যালির সভাপতি বিজয় হাজরা বলেন, তার ভ্যালিতে এনটিসির ১৬টি বাগান যে কোন সময় মজুরি দেয়া বন্ধ করে দিতে পারে। এই অঞ্চলের ৪২টি বাগান হুমকিতে রয়েছে। তিনি জানান, শ্রমিকদের মজুরি দিতে না পেরে হবিগঞ্জের একটি বাগানের মালিক পালিয়ে গেছেন। ফলে শ্রমিকরা উপোস থাকছে। মজুরি পাচ্ছে না। ফলে বাগানে বাগানে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। বিজয় হাজরা দাবি করেন, যেসব বাগানে মজুরি দেয়া বন্ধ রয়েছে, পূজার আগে তা পরিশোধ না করলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। বিজয় হাজরা বলেন, শ্রমিক-মালিক মিলেই এই শিল্প। এটাকে সবাই মিলে রক্ষা করতে হবে।
সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানের ম্যানেজার আজম আলী বলেন, চা শিল্পে আর আগের দিন নেই। ব্রোকার্সদের সিন্ডিকেটের কারণে এই শিল্প আজ ধ্বংসের পথে। সিলেটের প্রতিটি বাগানের অবস্থা খারাপ। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই একে একে বাগান বন্ধ করে দিতে হবে।
আজম আলী আরো বলেন, যত সময় যাচ্ছে শ্রমিকদের মজুরি দেয়া কষ্টকর হয়ে পড়ছে। তিনি আরো বলেন, ভারত থেকে চোরাই পথে চা আসছে। এটা রোধ করতে না পারলে দেশীয় চা বাজার হারাবে। শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়বে। শ্রমিকরা বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হবে।
বাংলাদেশ চা সংসদ সিলেট বিভাগের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাগান পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকেই বেতন দিতে পারছেন না। এক কেজি চা উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা। কিন্তু, বিক্রয় করতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৮০ টাকায়। এই শিল্প বাঁচাতে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। না হয় দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এই শিল্প তার ঐতিহ্য হারাবে। বন্ধ হয়ে যাবে বাগানগুলো।