অসৎ-দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ডাম্পিং স্টেশন সিলেট!
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১:৩৬:২৩ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম :
ওলি আউলিয়ার স্মৃতিধন্য পবিত্র নগরী সিলেটকে কৌশলে ‘অসৎ ও দুর্নীতিবাজ’ কর্মকর্তাদের ডাম্পিং স্টেশনে পরিণত করা হচ্ছে-এমন অভিযোগ সচেতন মহলের। দেশের অর্ধশতাধিক জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদায়নকে কেন্দ্র করে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (মাঠ প্রশাসন) কে এম আলী আযমকে সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে পদায়ন ও তার যোগদান-তাদের এ অভিযোগকে আরো জোরালো করেছে। প্রায় ১০ কোটি টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলার আসামী সিলেটের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট এনামুল হকও এখনো বহাল স্বপদে।
সিলেটের নাগরিক সমাজের দাবি দাওয়া আদায়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ও সিলেট জেলা বারের সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন সিলেটের ডাককে জানান, ডিসি পদায়নের বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে পত্র-পত্রিকায় চেকের ছবিসহ ছাপা হয়েছে। কাজেই, বিষয়টির প্রশাসনিকভাবে নিরপেক্ষ অনুসন্ধান প্রয়োজন। বিভাগীয় অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনভাবে সিলেটের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী বিভাগে তাকে পদায়ন করা মোটেই সমীচিন নয় বলে মন্তব্য এ আইনজীবীর।
অপরদিকে, দুর্নীতির অভিযোগ উঠার পরও সিলেটের কাস্টমস কমিশনারকে স্বপদে বহাল রাখার বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। কাস্টমসের এ কমিশনার একজন বিতর্কিত, চিহ্নিত ও অভিযুক্ত ব্যক্তি। যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উঠে-আমাদের দাবি থাকে তাদেরকে দ্রুত প্রধান কার্যালয়ে ক্লোজড করে-তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এখনো পর্যন্ত এ কমিশনারকে সার্ভিসে স্বপদে বহাল রাখার-বিষয়টি উৎকণ্ঠার বলে তার মন্তব্য।
যে কারণে সরিয়ে দেয়া হয় আলী আযমকে :
গত ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর দুই দিনে দুই দফায় মোট ৫৯ জন জেলাপ্রশাসক নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওই নিয়োগের পর পরই সবাই কাজে যোগ দিতে প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। তবে বিপত্তি বাঁধে যারা ডিসি পদায়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাদের দাবির মুখে। তারা এই নিয়োগ বাতিলের দাবি তুলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হৈ চৈ শুরু করেন। উপ-সচিব পর্যায়ের ওই সকল কর্মকর্তা এক পর্যায়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ শাখার যুগ্ম সচিব কে এম আলী আযমের কক্ষে ঢুকে এসব করেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নতুন নিয়োগ দেওয়া আট জেলার জেলা প্রশাসকদের নিয়োগ বাতিল করা হয়। এছাড়া, চার জেলার জেলা প্রশাসক পরিবর্তন করা হয়। বাকি নিয়োগপ্রাপ্তদের নিয়োগ যাচাই-বাছাই করতে গঠন করা হয় কমিটি।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ শাখার যুগ্ম সচিব ড. জিয়াউদ্দীন আহমেদের রুম থেকে তিন কোটি টাকার একটি চেক উদ্ধার করা হয় বলে দেশের শীর্ষ এক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। এর পরপরই শুরু হয় হৈ-চৈ। পদায়ন হওয়া এক জেলা প্রশাসকের পক্ষে ওই যুগ্মসচিবকে চেকটি দেন মীর্জা সবেদ আলী নামের এক ব্যবসায়ী। চেকের সঙ্গে পাওয়া যায় চেক দাতার এনআইডির ফটোকপিসহ ডিসি নিয়োগসংশ্লিষ্ট কিছু কাগজপত্র। সেখানে একটি কাগজে পাঁচ জেলার ডিসির নাম রয়েছে। সেই কাগজের তালিকা থেকে দুই জন রংপুর ও নওগাঁর জেলা প্রশাসক হয়েছেন।
আরেকটি কাগজে ডিসি নিয়োগের ভাইভা দেওয়া প্রার্থীদের সংখ্যা ছিল। বলা হচ্ছে, ওই কাগজের হাতের লেখা আরেক যুগ্ম সচিব আলী আযমের। ডিসির ফিটলিস্ট তৈরি করতে মোট ৫৮২ প্রার্থীকে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি)-র কাছে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। এর মধ্যে ৪৭০ জন কর্মকর্তা উপস্থিত হন। বাকি ৫২ জন ভাইভা দিতে যাননি।
নিয়োগের ঘটনায় আলোচনায় আসা যুগ্ম সচিব কে এম আলী আজমকে গত ১৮ সেপ্টেম্বর সরিয়ে দেয়া হয়। তাকে সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে বদলি করা হয়েছে। নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে এ কর্মকর্তা গতকাল বুধবার সিলেট এসেছেন বলে প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। তার সিলেটে আসার একটি ছবিও সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে।
বিগত সরকারের আমলাদের সাথে সখ্যতার অভিযোগ :
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট ঘেঁটে দেখা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী তিনজন আমলা, যারা বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে কাজ করেছেন আলী আযম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বর্তমান চেয়ারম্যান মঈনুদ্দীন আবদুল্লাহ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যখন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন, তখন বিসিএস প্রশাসন ২০ ব্যাচের কর্মকর্তা আলী আযম তার ব্যক্তিগত সচিব (পিএস) ছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেনের ব্যক্তিগত সচিবও ছিলেন তিনি। এমনকি প্রশাসন ৮৪ ব্যাচের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ও আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম সুবিধাভোগী সাবেক সমাজসেবা সচিব জিল্লার রহমানেরও স্নেহধন্য ছিলেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, বগুড়া জেলায় বাড়ি এবং যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছিলেন মূলত এই দুই বিষয়কে হাতিয়ার করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দ্রুত পদোন্নতি বাগিয়ে নেন আলী আযম। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (মাঠ প্রশাসন) হিসেবে তিনি ছিলেন এসএসবি’র সদস্য সচিব। তবে, এসব বিষয়ে কে এম আলী আযমের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, ২০তম প্রশাসন ব্যাচের কর্মকর্তা কে এম আলী আযম সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে পদোন্নতি পেয়ে ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের মধ্যে গত ১৯ আগস্ট তিনি একই মন্ত্রণালয়ের (এপিডি উইংয়ে) যুগ্ম সচিবের দায়িত্ব নেন।
দুদকের মামলার পরও এনামুল এখনো বহাল তবিয়তে :
প্রায় ১০ কোটি টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় সিলেটের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হক এখনো সিলেটে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। কাস্টমস অফিসের একটি দায়িত্বশীল সূত্র এনামুলের সিলেটে দায়িত্ব পালনের বিষয়টি সিলেটের ডাককে নিশ্চিত করেছে।
গত ৮ জুলাই ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এনামুলের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এর আগে গত ৪ জুলাই এনামুলের ৮ কোটি ৯৫ লাখ ৪ হাজার ৫০০ টাকার জমি ও ফ্ল্যাট ক্রোকের নির্দেশ দেন আদালত। ক্রোক করা সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে- গুলশানের জোয়ার সাহারায় ৬১ হাজার টাকার তিন কাঠা জমি, খিলক্ষেতে ৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকার ৩৩ শতাংশ জমি, কাকরাইলের আইরিশ নূরজাহান টাওয়ারে কমন স্পেসসহ ১১৭০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, যার মূল্য ২৮ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা, একই ভবনে কারপার্কিং স্পেসসহ ১৮৩৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাট যার মূল্য ৫১ লাখ ২৯০০ হাজার টাকা। এছাড়া কাকরাইলে ১৯০০ বর্গফুট ও ৩৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটসহ কারপার্কিং, যার মূল্য ২ কোটি ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। গাজীপুরে ৬২ লাখ ৪০ হাজার টাকার পাঁচ কাঠা জমি। মোহাম্মদপুরে তিনটি বাণিজ্যিক ভবনে চার হাজার বর্গফুটের তিনটি স্পেস, যার প্রতিটির মূল্য ৭১ লাখ ৩৫ হাজার করে। এছাড়া মোহাম্মদপুরে ১০ হাজার ৯৬৫ বর্গফুটের স্পেস রয়েছে, যার মূল্য দুই কোটি ৩৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এছাড়াও গুলশানের ৭২ লাখ টাকার ২৪২৮ বর্গফুটের ফ্ল্যাট এবং বাড্ডায় চার কাঠা নাল জমি যার মূল্য ১৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক ফারজান ইয়াসমিন আবেদনে উল্লেখ করেন, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে ৯ কোটি ৭৬ লাখ ৯৭ হাজার টাকা মূল্যের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার (আসামি) বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৭(১) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। তদন্তকালে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, আসামি তার মালিকানাধীন ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন, যা করতে পারলে এই মামলার ধারাবাহিকতায় আদালতে চার্জশিট দাখিল, আদালত বিচার শেষে সাজার অংশ হিসেবে অপরাধলব্ধ আয় থেকে অর্জিত সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্তকরণসহ সব উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। তাই মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে বিজ্ঞ আদালতে চার্জশিট দাখিলের পর বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক বিচার শেষে সরকারের অনুকূলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের সুবিধার্থে তথা সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তার স্থাবর সম্পত্তিসমূহ ক্রোক করা একান্ত প্রয়োজন।
২০২২ সালের নভেম্বর থেকে এনামুল হকের বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধানে নামে দুদক। একই বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মাহবুবুল আলম বাদী হয়ে এনামুল হকের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন।
জানা গেছে, ২০২৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার হিসেবে যোগ দেন মোহাম্মদ এনামুল হক। ২০২২ সাল থেকে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও ২০২৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের ৮ কাস্টমস কমিশনার হিসেবে যোগ দেন এই কর্মকর্তা। অনেকের মতে, এটা ছিল এনামুলের ডাম্পিং স্টেশন। দুর্নীতির অভিযোগ উঠার পরও সিলেট বিভাগের ৯টি শুল্ক স্টেশন থেকে কমিশনারের নামে প্রতিদিন টাকা উঠানো হতো বলে কয়েকজন আমদানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিলেটের ডাককে জানিয়েছেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাবার পরও নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। কিন্তু, এনামুলের চেয়ার এখনো বদল হয়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
এ ব্যাপারে গতরাতে এনামুলের সেল ফোনে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে, কাস্টমসের ওয়েবসাইট ও কাস্টমস অফিস সূত্র এখনো তার দায়িত্ব পালনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।