সুনামগঞ্জের স্বাস্থ্যের ইকবাল দম্পতির অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে দুদক
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ অক্টোবর ২০২৪, ৫:২০:৫৬ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী :
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের বহুল আলোচিত ইকবাল হোসেন ও তার স্ত্রী রেহেনা বেগম দম্পতির বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের তথ্য প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থার দীর্ঘ তদন্তে উঠে এসেছে তাদের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র।
দুদক সূত্র বলছে, দুদকের উপ-পরিচালক জাবেদ হাবিব গত ৩১ জুলাই ইকবাল হোসেন ও তার স্ত্রী রেহেনা বেগমের বিরুদ্ধে দীর্ঘ তদন্তের প্রতিবেদন দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন। ওই প্রতিবেদন অনুমোদনের পরই তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হবে। ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল ইকবাল দম্পতির বিরুদ্ধে দুদক কর্মকর্তা বাদী হয়ে পৃথক দুটো মামলা দায়ের করেন। ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা নম্বর (মহানগর দুদক)-০৪ এবং তার স্ত্রী রেহেনা বেগমের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা নম্বর (মহানগর দুদক) ০৫। এর আগে ৪ এপ্রিল দুদক প্রধান কার্যালয়ের নিয়মিত সভায় জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ইকবাল ও রেহেনা দম্পতির বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়েরের অনুমোদন দেয়া হয়।
দুদকের একটি দায়িত্বশীল সূত্র গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সিলেটের ডাককে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। বর্তমানে ইকবাল হোসেন সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান সহকারী ও তার স্ত্রী রেহেনা বেগম সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। আলোচিত এই দম্পতির দুর্নীতি নিয়ে সিলেটের ডাক-এ ২০২২ সালে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এদিকে, ইকবাল হোসেন ও তার স্ত্রী রেহেনা বেগমের বক্তব্য জানতে চেয়ে গতকাল সন্ধ্যায় দৈনিক সিলেটের ডাক থেকে ফোন দেয়া হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এক ইকবাল – সম্পত্তি অঢেল
জানা গেছে, সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে দীর্ঘদিন চাকুরি করে বিপুল সম্পদের মালিক বনে যান ইকবাল হোসেন। মাত্র ১২শ’ টাকা বেতনে চাকুরি শুরু করা ইকবাল নিজে প্রায় ৬ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের একেবারে সামনেই নিজের সন্তান রাফির নামে গড়ে তুলেন আল-রাফি নামের বহুতল মার্কেট। ১০ শতক জায়গার ওপর নির্মিত ওই মার্কেটের জমিসহ বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা। হাসননগর সুরভী আবাসিক এলাকায় পৈতৃক বসতবাড়িতে প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন সুরম্য দ্বিতল বাসভবন। এটির অভ্যন্তর সাজানো হয়েছে দামী দামী ফার্নিচার দিয়ে। যে ভিটায় ইকবাল সুরম্য বাসভবন নির্মাণ করেছেন- একসময় ওই ভিটায় টিনের তৈরি বসতঘর ছিল। নতুন হাসননগর এলাকায় প্রায় ৬ শতক জায়গার ওপর নির্মাণ করেছেন কমিউনিটি সেন্টার। জায়গাসহ দ্বিতল বিশিষ্ট ওই কমিউনিটি সেন্টারের বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৭৫ লাখ টাকা। শহরতলীর হাসনবাহার এলাকায় ১৫ কেয়ার (৪২০ শতক) জমিতে গড়ে তুলেছেন পৃথক দুটি মৎস্য খামার। খামারের জমির মূল্য ৬০ লাখ টাকারও বেশি। হাসননগর এলাকায় রয়েছে ১০ শতকের একটি প্লট।
এর বাজার মূল্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা। বুড়িস্থল চামারবাড়ি এলাকায় ১৫ শতকের আরেকটি প্লট রয়েছে। এর বাজার মূল্য প্রায় ১৫ লাখ টাকা। শহরের কালিবাড়ি এলাকায় রয়েছে দুটো দোকান ঘর। যার দাম ১০ লাখ টাকা। এছাড়াও সুনামগঞ্জ পৌরসভার অন্তর্গত সুলতানপুর মৌজায় নিজ নামে ২২ শতক বোরো জমি ও ৩২ শতক বাড়ি, মোহনমোকন্দ মৌজায় ১ দশমিক ৮৮ শতক বোরো জমি ও ১৫ দশমিক ৮৪ শতক বাড়ি এবং রসুলপুর মৌজায় ৭ দশমিক ৫০ শতক আমন জমিও রয়েছে। সব মিলিয়ে ইকবাল নিজে ৫ কোটি টাকারও বেশি সম্পদের মালিক বলে জানা গেছে।
সেবায় সন্তুষ্ট; তাই স্ত্রীকে ৩ কোটি টাকার সম্পদ
ইকবাল হোসেন তার স্ত্রী রেহেনা বেগমের সেবা যতœ ও শ্রদ্ধা ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে প্রায় ৩ কোটি টাকার সম্পদ দুটি হেবা দলিল মূলে স্ত্রী রেহেনা বেগমের নামে লিখে দেন। ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ৫০৭৪/২০১৬ নম্বর দলিলে সুলতানপুর মৌজায় ২২ শতক বোরো জমি ও ৩২ শতক বাড়ি ও মোহনমোকন্দ মৌজায় ১ দশমিক ৩৪ শতক বোরো জমি স্ত্রীর নামে লিখে দেন। দলিলে এই ১ দশমিক ৮৮ শতক জমির মূল্য ২ কোটি ২ লাখ ৯৭ হাজার টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। এরপরের বছর ২০১৭ সালে একই সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ২৭৬/২০১৭ নম্বর দলিলে মোহনমোকন্দ মৌজায় ১৫ দশমিক ৮৪ শতক বাড়ি ও রসুলপুর মৌজায় ৭ দশমিক ৫০ শতক আমন জমি লিখে দেন স্ত্রী রেহেনা বেগমের নামে। এই দলিলে উল্লেখিত জমির মূল্য লেখা হয় ৪১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। পৃথক দলিলে স্ত্রী রেহেনা বেগমের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে মোট ২ দশমিক ১১ একর বা ২১১ শতক জমি লিখে দেন ইকবাল। দলিলে এই জমির মূল্য ২ কোটি ৪৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকা উল্লেখ করা হলেও এই জমির বর্তমান বাজার মূল্য ৩ কোটি টাকারও বেশি আছে বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
রেহেনা বেগমও পিছিয়ে নেই
কেবল স্বামী ইকবাল হোসেনই নয় ; সম্পদে পিছিয়ে নেই স্ত্রী রেহেনা বেগমও। ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট যখন চাকুরি জীবন শুরু করেন ; তখন রেহেনার বেতন ছিল ৫ হাজার টাকারও কম। কেবল স্বামীর লিখে দেওয়া অঢেল সম্পদই নয়; রেহেনার নিজ নামেও একাধিক বাড়ি-জমি রয়েছে। ২০১৭ সালের ৯ মার্চ রেহেনা নিজ নামে ৮০ শতক বাড়ির জমি কেনেন। বাড়ির জমির মূল্য ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে এই ৮০ শতক বাড়ির মূল্য ৩০ লাখ টাকারও বেশি। এর আগে ওই বছরের ৪ জানুয়ারি সুলতানপুরে ৫৭ শতক জমি কিনেন রেহেনা। যার মূল্য উল্লেখ করা হয়, ২ লাখ ১৮ হাজার টাকা। বাস্তবে এই জমির মূল্যও ১৫ লাখ টাকারও বেশি। এছাড়াও, নিজের স্বজনদের জায়গা-জমিও নিজের দখলে নিয়ে গেছেন বলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তার পোস্টিং থাকলেও ডেপুটেশনে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে চলে আসেন। বছরের পর বছর ধরে এই হাসপাতালে দাপটের সাথে থাকলেও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরে তাকে অন্যত্র বদলি হতে হয়।
সূত্র বলছে, নিজের নামে কেনা বাড়ি-জমি ও স্বামীর লিখে দেওয়া সম্পদসহ রেহেনা বেগম বর্তমানে সাড়ে ৩ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। রেহেনা বেগম ২০৩৪ সালের ৬ জুলাই স্বাভাবিকভাবে অবসরে যাওয়ার কথা রয়েছে।
কে এই ইকবাল
সূত্র জানায়, সুনামগঞ্জ পৌরসভার হাসননগরের সুলতানপুর গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন ইকবাল হোসেন। তার পিতার নাম মো. ইসকন্দর আলী। পিতা ছিলেন আইনজীবী সহকারী বা মুহুরী। একটি টিনসেড ঘর আর সামান্য ফসলি জমি ছিল তাদের একমাত্র সম্বল। ১৯৯১ সালের ২৮ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে যোগদানের পর ইকবালের ভাগ্যে পরিবর্তন আসে। ধীরে ধীরে পাল্টে যায় চিরচেনা সেই দৃশ্যপট। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে তুলেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়।
যেভাবে উত্থান, অত:পর…
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের প্রধান সহকারী হওয়ার সুবাদে ইকবালের প্রভাব-প্রতিপত্তির শেষ ছিল না। হাসপাতালের সকল কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতেন তিনি। নার্সদের বদলি ও ছুটি মঞ্জুরে তাকে টাকা দিতে হতো। মেডিকেল সার্টিফিকেট, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট, ভিকটিম সার্টিফিকেটেও টাকা নিতেন ইকবাল। ধীরে ধীরে হাসপাতাল ও হাসপাতালের বাইরেও প্রভাব বিস্তার করেন। পছন্দের লোক দিয়ে হাসপাতালের ঔষধ কেনানো হতো। এর নেপথ্যে ছিল-ইকবালের কমিশন বাণিজ্য। শ্যালককে সাথে নিয়ে হাসপাতালের পুরাতন মালামাল কম দামে বিক্রি করে দিতেন। একবার সদর হাসপাতাল থেকে বদলি হলেও উচ্চ আদালতে রিট করে বহাল থাকেন। একপর্যায়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্তে তার দুর্নীতির বিষয়টি ধরা পড়ে। পরে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল থেকে তাকে বদলি করা হয়। দিরাই, জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি হয়ে কিছু দিন ছিলেন। পরে শাল্লা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলির আদেশ হলেও সেখানে আর যোগদান করেননি। এরপর বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ প্রকল্পে যোগ দেন। পরে বদলি হন দোয়ারাবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
স্বাভাবিক অবস্থায় ২০৩১ সালের ২৮ অক্টোবর তার অবসরে যাওয়ার কথা রয়েছে।
২০২০ সালে সর্বপ্রথম ইকবাল হোসেন ও তার স্ত্রীর অবৈধ সম্পদের খোঁজ পায় দুদক। এরপর দুদক এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়।
২০২১ সালের শুরুর দিকে সম্পদের বিবরণী চেয়ে ইকবালকে নোটিশ দেয় দুদক। ওই নোটিশের প্রেক্ষিতে ইকবাল নিজের সম্পদের তথ্যসহ সম্পদ বিবরণী জমা দেন।
ওই সম্পদ বিবরণীতে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের তথ্য গোপন করেন ইকবাল। এরপরই ইকবাল দম্পতির বিরুদ্ধে দুদক মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নেয়।