বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশের হাতে খুন
রায়হান হত্যাকান্ডের বিচার চার বছরেও শেষ হয়নি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ অক্টোবর ২০২৪, ৫:৫৭:০৬ অপরাহ্ন

কাউসার চৌধুরী :
সিলেট নগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে রায়হান আহমদ (৩২) হত্যাকান্ডের বিচার কার্যক্রম চার বছরেও শেষ হয়নি। একাধিক সাক্ষীকে আসামিপক্ষ পুনরায় জেরার মধ্য দিয়েই চলছে একের পর এক ধার্য তারিখ। সর্বশেষ সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করে আদালত যখন আসামি পরীক্ষা করবেন ; ঠিক তখন প্রধান আসামি দারোগা আকবর হোসেন ভূইয়ার পক্ষ থেকে আরেক আসামিকে পুনরায় জেরার আবেদন করা হয়। ওই সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করার আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে। দেশব্যাপী আলোচিত রায়হান হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তির বদলে উল্টো আসামিপক্ষ বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত
করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আর মামলার আসামি দারোগা হাসান আলী দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। আজ শুক্রবার রায়হান আহমদ হত্যাকান্ডের চার বছর পূর্ণ হয়েছে।
এদিকে, নিহত রায়হানের হতভাগ্য মা সালমা বেগম তার গর্ভের সন্তানের খুনীদের বিচারের দাবিতে পথ চেয়ে আছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত পিপি এ্যাডভোকেট জুবায়ের বখত গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে সিলেটের ডাককে বলেন, মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলার ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী ধাপে আসামি পরীক্ষা করার কথা। গত বুধবার ছিল আসামি পরীক্ষার ধার্য তারিখ। কিন্তু প্রধান আসামি দারোগা আকবরের পক্ষে এক সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করার আবেদন করেন। আকবরের পক্ষে ইতোপূর্বে আরও সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করা হয়েছে। আদালত তাদের আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ২৩ অক্টোবর বুধবার পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন। ওইদিন ওই সাক্ষীকে আসামি পক্ষ পুনরায় জেরা করবেন।
আর বাদীপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবুল ফজল চৌধুরী জানান, হত্যাকান্ডের পর থেকেই আসামিরা মামলা দুর্বল করতে চেষ্টা করে। এরপর বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত করতেও নানান চেষ্টা করে। সর্বশেষ সাক্ষ্য গ্রহণ যখন শেষ করা হয়ে আদালত যে ধার্য্য তারিখে আসামি পরীক্ষা করবেন তখনও আসামিপক্ষ এক সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করার আবেদন করেন। আদালত আসামিপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছেন যে, তারা আর কোনো সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করতে চান কিনা। আসামি পক্ষ জানিয়েছেন, শুধুমাত্র ওই সাক্ষীকেই তারা পুনরায় জেরা করবেন আর কোনো সাক্ষীকে পুনরায় জেরার আবেদন করবেন না। ইতোমধ্যে আসামিপক্ষ তাদের চাহিদা অনুযায়ী সাক্ষীদের পুনরায় জেরা করেছেন।
জানা গেছে, রায়হান আহমদকে হত্যার আগে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল তৌহিদ হোসেনের মোবাইল ফোন দিয়ে রায়হানের মায়ের কাছে কল দিয়ে টাকা দাবি করেন। মামলার সাক্ষী ওই কনস্টেবল তৌহিদকে এখন আবারও জেরা করতে চান আকবরের আইনজীবীরা। যদিও সাক্ষ্য গ্রহণের সময় কনস্টেবল তৌহিদকে জেরা করা হয়েছিল। মামলার ৬৯ জন সাক্ষীর মধ্যে আদালত ৬১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। গত বুধবার সিলেট মহানগর দায়রা জজ হাবিবুর রহমান চাঞ্চল্যকর এই মামলার আসামি পরীক্ষার দিন ধার্য ছিল। প্রধান আসামি দারোগা আকবরের পক্ষে কনস্টেবল তৌহিদকে পুনরায় জেরার আবেদন করা হলে আদালত এটি মঞ্জুর করেন।
এদিকে, জামিনে বেরিয়ে এসে আসামি দারোগা হাসান আলী দেশ ছেড়ে পালিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। গেল চারটি ধার্য তারিখ ধরে তিনি আদালতে হাজির না হওয়ায় তার পালিয়ে যাবার বিষয়টি আরও ঘনীভুত হচ্ছে।
সূত্র বলছে, এর আগে ৫৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের পর হঠাৎ করে আসামি কনস্টেবল হারুনের আইনজীবী গেল বছর পুরাতন ২৭ জন সাক্ষীকে নতুন করে পুনরায় জেরা করার আবেদন করেন। বাদীপক্ষ এই আবেদনের বিরোধিতা করেন। বিরোধিতা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি এ্যাডভোকেট নওশাদ আহমদ চৌধুরীও। ওই সময় পিপি বলেন, এভাবে পুরাতন সাক্ষীকে নতুন করে জেরা করা হলে মামলার বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হবে। উভয়পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে আদালত পুরাতন ৭ সাক্ষীকে নতুন করে জেরা করার অনুমতি দেন। ওই সাক্ষীদের পুনরায় জেরা করা হয়। পরবর্তীতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ডকারী ম্যাজিস্ট্রেট, ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার ও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
এর আগে ২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল সোমবার তৎকালীন সিলেট মহানগর দায়রা জজ মো. আবদুর রহিম পাঁচ আসামির উপস্থিতিতে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে চাঞ্চল্যকর রায়হান আহমদ হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। এর আগে ওই বছরের ১২ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের তারিখ নির্ধারণ থাকলেও সেটি পিছিয়ে নেওয়া হয়। অভিযোগ গঠনের পর মামলার বাদী নিহতের স্ত্রী তাহমিনা আক্তারের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে আদালত সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করেন পরবর্তীতে নিহত রায়হানের গর্ভধারিণী মা সালমা বেগমসহ একে একে ৬১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন ।
সূত্র জানায়, ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার সিলেটের তৎকালীন অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আব্দুল মোমেন প্রধান আসামি দারোগা আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ ৫ আসামির উপস্থিতিতে অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করেন। এর আগে ওই বছরের ৫ মে বুধবার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআই সিলেটের পরিদর্শক আওলাদ হোসেন ৫ আসামির বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩০২/২০১/৩৪ তৎসহ নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন ২০১৩ এর ১৫(১) (২)(৩) ধারায় সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্রটি দাখিল করেন। টানা ২০২ দিনের তদন্ত শেষে দেয়া অভিযোগপত্রে দারোগা আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ৫ পুলিশ সদস্যসহ ৬ জনকে আাসামি করা হয়। অভিযোগপত্রসহ কেস ডকেট ১ হাজার ৯৬২ পৃষ্ঠা। তবে মূল অভিযোগপত্র ২২ পৃষ্ঠার। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয়েছে ৬৯ জনকে। সাক্ষীদের মধ্যে ১০ জন আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
অভিযোগপত্রে ৫ পুলিশসহ ৬ জনের নাম
তদন্তে রায়হান হত্যার ঘটনায় ৫ পুলিশসহ ৬ জনের নাম উঠে আসে। ৬ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। ৬ আসামিরা হলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ থানার বাগইর গ্রামের মো. জাফর আলী ভুঁইয়ার পুত্র দারোগা আকবর হোসেন ভূঁইয়া (৩২), হবিগঞ্জের মোহনপুরের মৃত আমির হোসেনের পুত্র দারোগা হাসান উদ্দিন (৩২), ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার চামারুল্লা গ্রামের মৃত আতাউল করিমের পুত্র এএসআই আশেকে এলাহী (৪৩), সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার উক্তচন্দ্র গ্রামের অনিল কুমার দাসের পুত্র কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস (৩৮), হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার একডালা গ্রামের আব্দুন নুরের পুত্র কনস্টেবল হারুনুর রশিদ (৩২) ও সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বড়দেও (শমসেরনগর) গ্রামের ইছরাইল আলীর পুত্র সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান (২৬)।
আসামিদের মধ্যে আকবর হোসেন ভূঁইয়া, আশেকে এলাহী, টিটু চন্দ্র ও হারুনুর রশিদ সরাসরি রায়হান হত্যাকান্ডে অংশ নেয়। হাসান উদ্দিন ও আব্দুল্লাহ আল নোমান রায়হানকে পালিয়ে যেতে সহায়তাসহ আলামত নষ্ট করে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
ফিরে দেখা রায়হান হত্যাকান্ড
২০২০ সালের ১১ অক্টোবর ভোর রাতে নগরীর আখালিয়ার নেহারীপাড়ার বাসিন্দা রায়হান আহমদ বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নির্যাতনের শিকার হন। রাত ৩টা ৯ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে স্বাভাবিক অবস্থায় রায়হানকে ফাঁড়িতে ধরে আনে পুলিশ। সকাল ৬টা ২৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে রায়হানকে ফাঁড়ি থেকে বের করা হয়। ৬টা ৪০ মিনিটে ওসমানী হাসপাতালে নেয়া হয় এবং ৭টা ৫০ মিনিটে মারা যায় রায়হান। মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্যে দারোগা আকবরের নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যরা রায়হানকে পিটিয়ে হত্যা করে। ওইদিনই ময়না তদন্ত শেষে তার লাশ দাফন করা হয়।
শরীরে ১১১ আঘাতের চিহ্ন
পরে স্থানীয় এলাকাবাসীসহ সিলেটের সর্বস্তরের লোকজন রায়হানের খুনীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনে নামেন। এরপর ১৫ অক্টোবর কবর থেকে রায়হানের লাশ উত্তোলন করে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুনরায় ময়নাতদন্ত করা হয়। নির্যাতনে রায়হানের হাতের দু’টি আঙ্গুলের নখ তুলে ফেলে দারোগা আকবর। রাতভর নির্যাতনে রায়হানের শরীরে ময়নাতদন্তে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৪টি আঘাত ছিল গুরুতর। নির্যাতনের সময় রায়হানের আর্তচিৎকারে ফাঁড়ির পার্শ্ববর্তী কুদরত উল্লা রেস্ট হাউসের বর্ডারদেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। নির্মম এই হত্যাকান্ডের পর ঘাতকদের গ্রেফতারের দাবিতে দলমত নির্বিশেষে সিলেটবাসী আন্দোলনে নামেন। সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন, মিছিল-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। বৃহত্তর আখালিয়াবাসী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেন।
রায়হান হত্যার পরের দিন রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-২০। ধারা ৩০২/৩৪ দন্ডবিধি তৎসহ নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ১৫(১)(২)(৩)২০১৩। প্রথমে কোতোয়ালী থানার এস আই আব্দুল বাতেন মামলাটি তদন্ত করেন। পরে তুমুল সমালোচনার মুখে ১৩ অক্টোবর পুলিশ সদর দপ্তর মামলাটি কোতোয়ালী থানা থেকে পিবিআই’র কাছে স্থানান্তর করে ।
এদিকে, ঘটনার পর আকবর হোসেন ভূঁইয়া সীমান্ত হয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। ঘটনার ২৮ দিন পর ৯ নভেম্বর সোমবার সকালে কানাইঘাটের ডনা সীমান্ত এলাকায় ভারতের অভ্যন্তরে খাসিয়াদের হাতে আটক হয় আকবর। পরে তাকে বিজিবি আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। ওইদিনই তাকে গ্রেফতার করে সিলেটে নিয়ে আসা হয়।