রায়ে যা বলেছে হাইকোর্ট
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৫:৩৬:৪৮ অপরাহ্ন
ডাক ডেস্ক : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে বিচারিক আদালতের দেয়া রায়কে অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। সেই সাথে মামলার সব আসামিদের মুক্তি দেয়া হয়েছে। ডেথ রেফারেন্স নাকচ এবং আসামিদের আপিল মঞ্জুর করে হাইকোর্ট এ রায় ঘোষণা করে। সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে করা বিচারিক আদালতের বিচারকে বাতিল ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট।
ফলে লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টুসহ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া তারেক রহমানসহ এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাণ্ডপ্রাপ্ত সব আসামিদের খালাস পেয়েছেন। বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান এবং বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ের পরে তারেক রহমানের আইনজীবী ও বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক বলেছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে তারেক রহমানকে এ সাজা দেয়া হয়েছিল।
এই মামলায় আওয়ামী লীগের সময়ে যারা রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী হিসাবে কাজ করেছেন, চেষ্টা করেও তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি বিবিসি। কয়েকজনের মোবাইলফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
বিচারিক আদালতের রায় অবৈধ’
রোববার সকাল ১১টায় এ মামলার রায় ঘোষণা শুরু হয়। রায় ঘোষণা উপলক্ষে এজলাসে বিএনপিপন্থী জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। তবে আওয়ামী লীগের পক্ষের কোনো আইনজীবী বা যারা অতীতে রাষ্ট্রপক্ষে কাজ করেছেন, এমন কোনো আইনজীবী আদালতে ছিলেন না।
রায়ে আদালত বলেছে, এ মামলায় বিচারিক আদালত দোষীদের দুর্বল ও শোনা সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে রায় দিয়েছেন। সাক্ষীরা ঘটনার বর্ণনা করেছেন কিন্তু কে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছেন তা কোনো সাক্ষী বলেননি।লুৎফুজ্জামান বাবরের আইনজীবী শিশির মনির রায়ের পর বলেছেন, ‘কোনো সাক্ষীর সাথে কোনো সাক্ষীর বক্তব্যে মিল নাই। শোনা সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে রায় দেয়া হয়েছে।
তারেক রহমান, বাবরসহ সবাইকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ ধরনের মামলায় পরস্পর কেউ স্বচক্ষে দেখেছেন এ মর্মে কোনো এভিডেন্স নেই। যাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নেয়া হয়েছে তা নির্যাতনের মাধ্যমে নেয়া হয়েছে।’
একইসাথে ২১ আগস্টে গ্রেনেড কে সরবরাহ করেছে তা চার্জশিটে উল্লেখ করেননি কোনো তদন্ত কর্মকর্তা, এ কথাও রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিন আসামির আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘মুফতি হান্নান দুইটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। আদালতের ওপর প্রথম প্রশ্ন মুফতি হান্নান যে দ্বিতীয় কনফেশন দিয়েছেন এ ধরনের কোনো কনফেশন হয় কি-না, দিলে সাজা হয়েছে কি-না?
আইনজীবী শিশির বলেন, ‘আমরা আদালতে দেখিয়েছিলাম, ৪০০ বছরের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে এ ধরনের সাজা কাউকে কখনোই দেয়া হয়নি। আজ আদালত বললেন, দ্বিতীয় জবানবন্দি তিনি (হান্নান) যেটি দিয়েছিলেন, সেটিও পরে তিনি প্রত্যাহার করেন। এজন্য এ জবানবন্দির কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।
রায়ে আদালত আরো বলেছে, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী অভিযোগপত্র প্রাথমিকভাবে দাখিল করতে হয় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। সেখান থেকে তা যাবে সেশন (দায়রা) কোর্টে।
কিন্তু এখানে দ্বিতীয় যে অভিযোগপত্র সেটি সরাসরি সেশন কোর্টে দাখিল করা হয়। বিচারক এটি আমলে নিয়ে সরাসরি বিচার কাজ করেছেন। সুতরাং এ বিচার কাজ পরিচালনা ও সাজা দেয়া অবৈধ।
শিশির মনির জানান, ‘আইনে আছে আমলে গ্রহণ করবে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এখানে বিচারিক আদালত আমলে গ্রহণ করেছেন। হাইকোর্ট ডিভিশন বলেছেন এইটা বাংলাদেশের সকল সিদ্ধান্তের আলোকে অবৈধ হয়েছে। এজন্য ট্রায়ালটাকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন।
এ মামলায় ২২৫ জন সাক্ষী নেয়া হয়েছে। স্বীকারোক্তিম‚লক জবানবন্দী যারা দিয়েছেন তাদের টাস্কফোর্স সেল বা টিএফআই সেলে ২০০, ২২০, ২৬১ দিন পর্যন্ত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবী শিশির মনির।
তিনি বলেন, ‘ফলে তাদের কনফেশনের আইনগত কোনো ম‚ল্য নাই। এখানে যাদের রাখা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে তারা একজন বলেছে আরেকজনকে দেখেছে, শুনেছে। কিন্তু কী কথা হয়েছে কি ষড়যন্ত্র হয়েছে তার কোনো উত্তর দিতে পারে নাই।
এ মামলায় মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের।
এ রায়ের ফলে তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারবেন কী না এমন প্রশ্নে শিশির মনির জানান, ‘আরেকটি মামলা রয়েছে। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা। ওই মামলার শুনানি শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আশা করি ওই মামলায়ও একই ধরনের ফলাফল হবে।
তবে এ হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তারা বিচার পাবেন কী না এমন প্রশ্নে শিশির মনির তাদের প্রতি সহানুভ‚তিশীল জানিয়ে বলেন, ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যারা নিহত ও আহত হয়েছেন তাদের সকলের প্রতি অত্যন্ত সহানুভ‚তিশীল। কিন্তু প্রকৃত অপরাধী যদি রাষ্ট্রপক্ষ বের করতে না পারে তবে বিচারটা হবে কার? ১০০ মানুষও যদি খালাস পেয়ে যায় তবুও একজন নিরপরাধকে আমরা সাজা দিতে পারি না।
কিন্তু তারেক রহমান, বাবর যাকে ইচ্ছা তাকে সাজা দিতে পারবেন না। এজন্য যারা আহত হয়েছেন তাদের জন্য উচিৎ ছিল সুনির্দিষ্ট আসামি খুঁজে বের করা। তা না করে আমরা খুঁজেছি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। এর ফাঁকতালে বেরিয়ে গেছে সুনির্দিষ্ট আসামিরা।’
শিশির মনির বলেন, এ মামলায় ভুক্তভোগীদের জন্য ‘যথাযথ তদন্ত হবে কি-না টোটালি ডিপেন্ডস আপোন দ্যা স্টেট-সেটি রাষ্ট্র দেখবে।
বিএনপির আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল রায় ঘোষণার পর বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তারেক রহমানকে সাজা দেয়া হয়েছিল।
এ মামলায় তারেক রহমানকে যেভাবে জড়ানো হয়েছে তা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এই মামলায় মোট চারটি চার্জশিট দেয়া হয়েছে। প্রথম তিনটি চার্জশিটে তারেক রহমানের নাম ছিল না। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর চতুর্থ চার্জশিটে তারেক রহমানের নাম অন্তর্ভুক্ত করে।
আজ প্রমাণিত হয়েছে এই চার্জশিট আইন বহির্ভ‚ত ছিল। তাই এই চার্জশিটে যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল তারা এই মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন।’
কায়সার কামাল জানান, যারা এই মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন এবং আপিল করেছেন বা আপিল করেননি সবাইকে এই মামলা থেকে খালাস দেয়া হয়েছে।
এভাবে তারেক রহমান ন্যায়বিচার পেয়েছেন। আজ প্রমাণিত হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তারেক রহমানকে যে মামলায় সাজা দেয়া হয়েছিল, সেই মামলায় আইনগতভাবে মোকাবিলার মাধ্যমে তিনি আজ বেকসুর খালাস পেয়েছেন।
‘বিচারকে অবৈধ’ বলার কারণ হিসেবে বিএনপির সিনিয়র আইনজীবীদের একজন জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘২১ আগস্টে বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে জনসভার অনুমতি দেয়া হয়েছিল পাশের একটি ময়দানে। কিন্তু তারা সরকারকে না জানিয়ে স্থান পরিবর্তন করে রাস্তার মধ্যে সমাবেশ করেন।
স্বজনদের বক্তব্য
রায় ঘোষণার সময় এজলাসে বেশ কয়েকজন আসামির পরিবারের সদস্যরা ছিলেন।
লুৎফুজ্জামান বাবরের স্ত্রী তাহমিনা জামান রায়ের পর বলেন, ‘আল্লাহর দিকেই চেয়েছিলাম ন্যায়বিচারের জন্য। আল্লাহ আমাদের ন্যায়বিচার পেতে দয়া করেছেন। সেটাই আলহামদুলিল্লাহ।
মৃত্যুদণ।ডপ্রাপ্ত আরেকজন আসামি ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। কুষ্টিয়ার লেপ তোষকের একটি দোকান ছিল জাহাঙ্গীর আলমের। নামের ভুলের কারণে ১৭ বছর ধরে কনডেম সেলে থাকতে হয়েছে বলে জানান তার মেয়ে সাফা জুমানা। মেয়ে সাফা জুমানা বলেন, ‘আমি যখন একেবারেই ছোট, কথা বলতেও পারতাম না, আব্বুকে চিনতাম না, ডাকতে পারতাম-না তখন থেকেই আব্বু নাই।
আমার বয়স ১৭, আব্বুর জেলে থাকার বয়সও ১৭। আব্বুকে ভুলভাবে ধরা হয়েছে নামের জন্য।’ রাষ্ট্রে পরিবর্তনের কারণে ন্যায়বিচার আশা করেছিলেন বলে জানান মিজ জুমানা।