নির্বিকার প্রশাসন
তারাপুর চা বাগানের ভূমি দখল করে চলছে ঘর বাড়ি নির্মাণ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬:২০:০৬ অপরাহ্ন
নূর আহমদ
ক্রমশ বেহাত হয়ে যাচ্ছে তারাপুর চা বাগানের ভূমি। বাগানের মালিকানার পালা বদলের সূত্র ধরে পতিত সরকারের প্রভাবশালী চক্র এতোদিন দখল করে ঘর বাড়িসহ দোকান কোটা নির্মাণ করে আসছিলো।
দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও থেমে নেই বাগানের ভূমি দখল। অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী দোসররা স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্রকে ম্যানেজ করে স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে। আর সেই সুযোগ করে দিচ্ছেন বাগানের বর্তমান ব্যবস্থাপক রিংকু চক্রবর্তী।
তিনি স্বেচ্ছাসেবকলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুব্রত পুরকায়স্থের ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত। সম্প্রতি ভূমি দখলের অভিযোগ পেয়ে জেলা প্রশাসনের কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও তা ছিল ‘আইওয়াশ’ বলে দাবি স্থানীয়দের।
গতকাল রোববার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, দখলকৃত বাগানের ভূমিতে ঘর নির্মাণ কাজ অব্যাহত রয়েছে।
জানা যায়, তারাপুর চা বাগানের মালিকানা ছিল দেশের স্বনামধন্য টি প্ল্যান্টার দানবীর ড. রাগীব আলীর। কথিত সেবায়েত পংকজ দাস বাগান পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে দানবীর ড. রাগীব আলীর কাছে তারাপুর চা বাগানটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন।
বিগত আওয়ামী স্বৈরশাসনের আমলে স্থানীয় আওয়ামী প্রভাবশালী চক্রের রোষানলে পড়েন ড. রাগীব আলী। বিতর্কিত হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় সংগঠন ইসকনের হস্তক্ষেপে তৎকালীন প্রধান বিচারপতিরও চক্ষুশূল হন সিলেট তথা দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়নে অনন্য অবদান রাখা দানবীর ড. রাগীব আলী।
তারাপুর বাগান সংক্রান্ত মামলায় তাকে কারাবরণও করতে হয়। কিন্তু তারাপুর বাগানটি দানবীর ড. রাগীব আলীর বেহাত হয়ে যাওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে উঠেন আওয়ামী লীগের সনাতনী ধর্মাবলম্বী স্থানীয় নেতারা। এরপর বাগানের ভূমি দখল করে একের পর এক মার্কেট নির্মাণসহ স্থাপনা তুলতে থাকেন।
এদিকে, আদালত থেকে বাগানের দায়িত্ব পান সেবায়েত পঙ্কজ দাস। কিন্তু, ড. রাগীব আলী কারাগার থেকে বেরিয়ে রিভিউ করেন। এরপর আদালত পঙ্কজকে বাদ দিয়ে সেবায়েত পরিবারের একজনকে প্রতিনিধি হিসেবে রেখে আদালত থেকে কমিটি করে দেওয়া হয়। ওই কমিটিতে রয়েছেন-জেলা জজ, জেলা প্রশাসক, পুলিশ প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন, আইনজীবী সমিতিসহ বিভিন্ন দফতরের একজন করে প্রতিনিধি।
কিন্তু ওই কমিটি যেন অনেকটা টুটু জগন্নাথ। মাঝে মাঝে পরিদর্শন ছাড়া আর কোন কাজ নেই কমিটির। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের নিয়ে একের পর এক দোকান তৈরী করে ভূমি দখলের সুযোগ করে দিচ্ছিলেন বাগান ব্যবস্থাপক।
অপরদিকে, অভিযোগ উঠে সাম্প্রতিক সময়ে বাগান ব্যবস্থাপক রিংকু চক্রবর্তীর হাত ধরেই বাগানের ভূমি বেহাত হতে থাকে। বাগান ব্যবস্থাপক স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকায় মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কাউন্সিলর আফতাব হোসেন খানকে বাগানের ভ‚মি দখলের সুযোগ করে দেন।
আফতাব হোসেন খান তারাপুর চা বাগানের ভূমিতে গড়ে তুলেন আফতাব নগর হাউজিং। অভিযোগ রয়েছে, মন্দিরের উন্নয়ন ও শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার নামে গোপনে বিক্রি করা হচ্ছে তারাপুর চা বাগানের ভূমি।
ব্যবস্থাপক রিংকু চক্রবর্তী মূলত আওয়ামী লীগ নেতা জগদীশ দাসসহ সনাতনী আওয়ামী লীগ নেতাদের করা ছকে একের পর এক ভূমি বিক্রি করে যাচ্ছেন।
আবার ছাত্র জনতার বিজয়ের পর যারা নতুন করে দখলে নেমেছে; তাদের ব্যাপারেও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। আরো অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে মন্দির ও চা বাগানের শ্রমিকদের নাম ভাঙ্গিয়ে তারাপুর চা বাগানের টিলা কেটে দোকান কোটা নির্মাণ করে ভাড়া দেন রিংকু চক্রবর্তী।
স্থানীয় ৮নং ওয়ার্ডের সাবেক দাপুটে কাউন্সিলর জগদীশ দাসের মধ্যস্থতায় চলে দোকান বেচাকেনা। দোকান দেয়ার কথা বলে ব্যবস্থাপকের টাকা লেনদেনেরও প্রমাণ রয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে। কাউন্সিলর জগদীশ দাসের মধ্যস্থতায় সম্পাদিত একটি অঙ্গীকারনামাও দৈনিক সিলেটের ডাক-এর হাতে এসেছে।
অন্যদিকে, গত বুধবার জেলা প্রশাসনের একটি টিম বাগান এলাকা পরিদর্শন করে।
গতকাল রোববার হাজীপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সবুজ টিন দিয়ে ঘেরা এলাকায় প্রকাশ্যে ঘর নির্মাণ চলছে। এছাড়া, বাগান ব্যবস্থাপকের অফিসের পাশে নতুন করে মাটি ফেলতে দেখা যায়।
স্থানীয়রা জানান, বাগানের ভূমি বেদখল হওয়ার পিছনে রিংকু চক্রবর্তী ও চা শ্রমিক নেতা চৈতন মোদি, সুনিল মোদি, সংগীত রায়সহ শ্রমিক নেতারা জড়িত রয়েছেন। ৭ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা শরীফ বক্সের নেতৃত্বে তার সহযোগী আলাউদ্দীন বক্স, রুমেল বক্স, সুমন বক্স, রুক্কল বক্স, টিপুসহ একটি প্রভাবশালী চক্র ৫ আগস্টের পর অন্তত ২ কেদার জায়গা দখল করে।
এরা সকলেই শরীফ বক্সের আত্মীয় স্বজন। নতুন দখলদারদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত।
কিন্তু, স্থানীয় একটি স্বার্থান্বেষী মহলের সাথে গোপনে তারা এক হয়ে দখলদারী অব্যাহত রেখেছেন। শরীফ বক্স ও তার স্বজনার স্থানীয় হওয়ায় ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারছেন না। বিশেষ করে বাগান ব্যবস্থাপক রিংকু নিজে জড়িত থাকায় কোন দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারেও উদ্যোগী নয়।
পাঠানটুলা এলাকার বাসিন্দা মুহিবুর রহমান জানান, তিনি একজন সচেতন মানুষ হিসেবে দখলদারদের বিরুদ্ধে একটি দরখাস্ত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে দিয়েছিলেন। কোন কাজ হয়নি। তিনি বলেন, চোখের সামনে একটি বাগান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, বাগানটি রক্ষায় দ্রত ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
এদিকে, বাগান ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ের আশপাশে দোকান নির্মাণের জন্য মাটি ফেলেছেন পাঠানটুলা এলাকার রহীম খান। তিনি জানান, ব্যবস্থাপকের সাথে কথাবার্তা হওয়ার পর তিনি মাটি ফেলেছেন।
তবে দোকান নির্মাণের ইশারা এখনো পাননি। রহীম খান বলেন, ব্যবস্থাপক যেখানে বলবেন সেখানে ঘর বানাবেন। যদিও তিনি টাকা পয়সা লেনদেনের বিষয়ে স্বীকার করেননি।
তবে সূত্র জানায়, এরই মধ্যে টাকা পয়সা লেনদেন হয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য রহীম খানকে ব্যবস্থাপক সুযোগ দিতে পারছেন না।
তারাপুর চা শ্রমিক পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি চৈতন বলেন, ৫ আগস্ট হাজীরপাড়ার রুমেল বক্স বাগানের প্রায় ২ কেদার জায়গা দখল করে নেয়। দেশের পরিস্থিতি ভালো না থাকায় আমরা কিছু করতে পারিনি।
তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের লোকজনকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছি। সেনাবাহিনীর কাছেও অভিযোগ দিয়েছি। আমরা গরীব মানুষ বাগান রক্ষা না হলে খাবো কি? চৈতন আরো বলেন, সবাই রুমেল এর নাম বলছে, শুনেছি তার সাথে ১৫/২০ জন আছে।
তারাপুর চা শ্রমিক পঞ্চায়েত কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুনীল মোদির বিরুদ্ধে অভিযোগ তার বোনের বিয়েতে টাকার প্রয়োজন হলে দখলদারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজে থেকে বাগানের ভূমি দখলে সহযোগিতা করেন।
তবে বিষয়টি অস্বীকার করে সুনীল। তিনি বলেন, ২শ’ বছরের বাগান। বাগান আমরাই সৃজন করেছি, আমরা বিক্রির সাথে জড়িত থাকবো কিভাবে। তিনি দাবি করেন, যা বলা হচ্ছে তা ষড়যন্ত্র।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শরীফ বক্স দাবি করেন, সবুজ টিন দিয়ে ঘেরা যে জায়গায় ঘর বাড়ি নির্মাণ চলছে-এর পাশেই তার বাড়ি। যারা ঘর বাড়ি নির্মাণ করছেন তাদের মধ্যে তার স্বজনরাও রয়েছেন।
তবে ওই জায়গাটি ২০১৭ সালে পংকজ দাসের কাছ থেকে ৩৫ বছরের জন্য লিজ নেয়া। পাড়ার কয়েকজন মিলে লিজ এনেছিল, এখন তারা ঘর বাড়ি নির্মাণ করছে বলে জানান শরীফ বক্স।
তিনি আরো দাবি করেন, বেশ আগে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। ৫ আগস্টের পর বাসা বাড়িতেই থাকতে পারেননি, আবার জায়গা দখল করবেন কিভাবে। যা প্রচার হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ ব্যাপারে রুমেল বক্সের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
অন্যদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছকু স্থানীয় এক বাসিন্দা দাবি করেন, পংকজ দাসের স্বাক্ষর জাল করে কাগজ তৈরী করা হচ্ছে। জাল কাগজ দেখিয়ে জায়গাটিকে হালাল করা চেষ্টা করছে দখলদার চক্র।
তারাপুর চা বাগানের ব্যবস্থাপক রিংকু চক্রবর্তী দাবি করেন, ৫ আগস্টের পরে সবমিলিয়ে ১০/১৫টি দোকান বেদখল হয়েছিল, আমরা তা উদ্ধার করেছি। করের পাড়ায় যে দোকানগুলো বানিয়ে দেয়া হয়, সেগুলোও বেহাত হয়েছিলো।
স্থানীয়ভাবে মীমাংসা করে উদ্ধারের প্রক্রিয়া চলছে। হাজীপাড়ায় ভূমি দখলের বিষয়টি সেনাবাহিনীকে অবহিত করা হয়েছে। এয়ারপোর্ট থানায় দুটি জিডি করা হয়েছে।
তার দাবি আইনি পদক্ষেপ চলমান রয়েছে। রিংকু চক্রবর্তী বলেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কারো সাথে তার সংশ্লিষ্টতা নেই, আফতাবনগর হাউজিং তিনি যোগদানের আগেই হয়েছে। রিংকু বলেন, প্রকৃতপক্ষে সাড়ে ৪শ’ শ্রমিকের মজুরি দেয়ার সামর্থ্য নেই।
এর জন্য কিছু দোকান নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। কমিটির অনুমোদন নিয়ে তা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি টিম ঘটনাস্থল ভিজিট করে এসেছে। শিগগিরই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।