দুই স্ত্রীসহ স্বজনদের নামেও অবৈধ সম্পদ, ঢাকা, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনায় ২৫ বাড়ি
হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক সাবেক এমপি রতন ধরাছোঁয়ার বাইরে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ৪:৪৩:৩৭ অপরাহ্ন

কাউসার চৌধুরী :
প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। রূপকথার গল্পের মতো তার উত্থান। চেয়েছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হতে। কিন্তু নৌকার মনোনয়ন ভাগিয়ে, হয়ে যান সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য। তারপর আর ঠেকায় কে। টাঙ্গুয়ার হাওরসহ চার উপজেলার জলমহাল, বালুমহাল, সীমান্ত-বাণিজ্য থেকে শুরু করে স্থানীয় হাটবাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গড়ে তুলেন চাঁদাবাজির একচ্ছত্র আধিপত্য। একটানা তিনবার এমপি থাকার সুবাদে শুধু চাঁদাবাজি থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রাজধানী ঢাকা, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, মোহনগঞ্জে তার বিলাসবহুল ২৫টি বাড়ি। আছে দামী ব্র্যান্ডের ৫টি গাড়িও। তিনি একা নন, দুই স্ত্রী মাহমুদা হোসেন লতা ও তানভী ঝুমু, ভাইসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং স্বজনদেরও এই দুর্নীতির সহযোগী করেছেন।
পাঁচ বছর আগে তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদক
মাঠে নামলেও পরে আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে, ৫ আগস্টের পর রতনের দুর্নীতির তদন্তে দুদকের পরিচালক আবদুল মাজেদের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। দুদকের ওই টিম ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জ, ধর্মপাশা, তাহিরপুরে সরেজমিনে ঘুরে গেছে।
জানতে চাইলে অনুসন্ধান দলের সদস্য দুদকের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান ভূঁইয়া জানান, মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের বিরুদ্ধে আগেও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। ৫ আগস্টের পরে আরও কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সকল অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদকের একটি টিম তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করছে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা অভিযোগে অনুসন্ধান হয়েছিল। সেগুলোর তথ্য দুদকে আছে। এবার সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় অনুসন্ধান চলছে। আমরা সব জায়গায় সরেজমিনে যাব। তারপর অনুসন্ধান শেষে দুদকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।
ঢাকা-সুনামগঞ্জে ২৫ বাড়ি
স্থানীয়রা জানান, সুনামগঞ্জের মল্লিকপুরে পায়েল পিউ নামের একটি বিলাসবহুল বাড়ি কেনেন রতন। কিন্তু ৫ আগস্টের পরে বাড়িটির নাম পরিবর্তন করা হয়। নতুন নাম দেয়া হয় স্পর্শ স্পন্দন ড্রিম হাউস।
নিজের গ্রামের বাড়ি ধর্মপাশায় তৈরি করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি ‘হাওর বাংলা’। বাংলো বাড়ির আদলে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর দিয়ে নির্মিত বাড়ি দুটোর বাজার মূল্য ২০ কোটি টাকারও বেশি।
এছাড়াও পার্শ্ববর্তী নেত্রকোনা শহরে রতন তার পিতা-মাতার নামে একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য ৫০ কোটি টাকার জমি কিনেছেন। ছোট ভাই মোবারক হোসেন যতনের নামে কিনেছেন ২৫ একর জমি।
জানা গেছে, ধর্মপাশায় রতনের নামে আরও ৭টি বাড়ি রয়েছে। আছে পার্শ্ববর্তী মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরেও দুটো বাড়ি।
নেত্রকোনা শহরেও একটি বাড়ি আছে। রাজধানীর নিকেতনে তার নামে রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। সহোদর যতন মিয়ার নামে ৫০০ একর জমি কিনেন রতন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে তার সর্বমোট ২৫টি বাড়ি রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
এর বাইরে ঢাকার সাভারেও রয়েছে একটি বাড়ি। মোহনগঞ্জ পৌর এলাকায় বাড়ি তৈরি করতে কেনা হয় ২১০ শতক জমি। সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার হাজিপাড়ায় দ্বিতীয় স্ত্রী জিনাতুল তানভী ঝুমুরের নামে একটি বাড়ি রয়েছে। সহোদর মোবারক হোসেনকে স্থানীয় বাজারে জায়গা কিনে বাড়ি ও একটি স’মিল করে দেন রতন। আরেক সহোদর মোজাম্মেল হোসেন রুকনকে নওধারা গ্রামে একটি বাড়ি ও নেত্রকোনা শহরের বিজিবি ক্যাম্পের সঙ্গে চারতলা আরেকটি বাড়ি করে দেন রতন। আরেক ছোট ভাই মোবারক হোসেনকে মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরের হাসপাতাল রোডে জায়গা কিনে বাড়ি নির্মাণ করে দেন। পাশাপাশি সহোদরা মিনা আক্তার ও শাকুরা আক্তারকে সুনামগঞ্জ শহরে বাড়ি করে দেন রতন। তার আরেক সহোদরা আংরুজা আক্তারকেও নেত্রকোনায় জায়গা কিনে বাড়ি নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
গড়ে তুলেন সম্পদের পাহাড়
হঠাৎ রাজনীতিতে আসা মোয়াজ্জেম হোসেন রতন অবৈধ উপায়ে গড়ে তুলেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। ২০০৮ সালে নিজের স্বাক্ষরিত হলফনামায় রতন তার সম্পদের বর্ণনা দেন। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, স্ত্রী মাহমুদা হোসেন লতা ৪০ তোলা স্বর্ণের মালিক। আছে ৩৫ লাখ ২৩ হাজার ৭৫৪ টাকার জমি। নিজের মোট আয় ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৩ টাকা। মোট সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৮০ লাখ ৭৮ হাজার ৩২২ টাকা। ২০১৩ সালের ৭ নভেম্বর দেয়া হলফনামার চিত্র কিন্তু পুরো উল্টো।
৫ বছরের ব্যবধানে নিজ নামে সম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি স্ত্রী লতার পরিচয় হয় ব্যবসায়ী। হলফনামায় স্ত্রী লতাকে পায়েল টেক্স লিমিটেড এর পরিচালক উল্লেখ করা হয়। লতার মোট আয় ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। মোট সম্পদ ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তিনি ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা আয়করও দেন। এতে রতনের মোট আয় উল্লেখ করা হয়, ২০ লাখ ৩০ হাজার ২৬৪ টাকা, সম্পদের পরিমাণ ৪ কোটি ২৬ লাখ ৬৬ হাজার ৯০৮ টাকা। তিনি ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৮২৩ টাকা আয়কর দেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দেয়া হলফনামায় তিনি ৫২৩ দশমিক ২৭ একর কৃষি জমি, ৮ দশমিক ২৬ একর পরিমাণের অকৃষি জমি, একটি এ্যাপার্টমেন্ট এবং নিজের ও অংশীদারীত্বের ৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকার কথা উল্লেখ করা হয়।
সর্বশেষ গত বছরের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের হলফনামায় রতন উল্লেখ করেন, তার পেশা শিক্ষকতা, চিকিৎসা, আইন, পরামর্শক। বার্ষিক আয় কৃষি খাত থেকে ১১ লাখ ৯০ হাজার টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত থেকে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৯৫৬ টাকা, সংসদ সদস্য হিসেবে প্রাপ্ত অর্জিত ভাতা বাবদ আয় ২৫ লাখ ৫৩ হাজার ৪২৭ টাকা, অন্যান্য ১ কোটি ১২ লাখ ৮৩ হাজার ৯২৪ টাকা।
নির্মাণ করা হয় ৪৭টি অফিস
সূত্র জানায়, জেলা শহর সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগের স্থায়ী কোনো দলীয় কার্যালয় না থাকলেও সুনামগঞ্জ-১ আসনের চারটি উপজেলায় ৪৭টি অফিস নির্মাণ করেন রতন। উপজেলা সদরে একটি করে মোট চারটি অফিস ছিল। বাকি ৪৩টি ছিল গ্রাম এলাকায়। এসকল অফিস নির্মাণের জন্য সরকারের ভূমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমি থেকে এমনকি বহু নিরীহ মানুষের জমি দখল করে অফিস নির্মাণ করা হয়।
এসকল অফিস দলীয় কার্যক্রমের জন্য তৈরি করা হলেও ব্যবহার করতেন কেবল রতনের ঘনিষ্ঠজনেরা। ব্যবহার করা হতো এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, ৫ আগস্টের পরে দখল করা জায়গায় নির্মিত অফিস করায় ক্ষোভ থেকে এসব অফিসের অধিকাংশই ভাঙচুর করা হয়। এমনকি কয়েকটি অফিসকে শৌচাগার হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
রতনের চাঁদাবাজি – দুদক নীরব
জানা গেছে, রতনের নির্বাচনী এলাকা থেকে দৈনিক ৫০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হতো। চাঁদার অর্ধেক পেতেন রতন। সীমান্তে কয়লা আমদানিকারক গ্রুপ নামের প্রতিষ্ঠানটির ব্যানারে মাসে কোটি টাকা চাঁদাবাজি হতো।
তৃতীয় বারের মতো এমপি হওয়ার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান সোহেল এমপি রতনের বিরুদ্ধে দুদকে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। এ অভিযোগের অনুসন্ধান করে দুদক সত্যতা পাওয়ার পরে রতনকে দুদকে তলব করা হয়েছিল। তার বিদেশ যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞাও দেয় দুদক।
তবে শেষ পর্যন্ত রহস্যজনক কারণে দুদক নীরব হয়ে যায়। রতনের দুর্নীতির তদন্ত কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে পড়ে।
তার বিরুদ্ধে কানাডায় বাড়ি ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগের পাশাপাশি ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনেরও অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, বিদেশে বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগ ওঠা রতন সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার নওধার গ্রামের বাসিন্দা। তার পিতার নাম মৃত আব্দুর রশিদ। এসএসসি পাসের পর তিনি সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট-এ ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯৯৩ সালে ডিপ্লোমা-ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (পাওয়ার) টেকনোলজি পরীক্ষায় ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর জগন্নাথপুরে বেসরকারি টেলিফোন সংস্থা বিআরটিএ (বাংলাদেশ রুর্যাল টেলিকম অথরিটি লি:) এর প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। জগন্নাথপুরে কিছুদিন কর্মজীবনের পর সিলেটে আসেন। সিলেটে নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে তিনি চলে যান রাজধানী ঢাকায়। আর্থিক লেনদেনের কারণে মাত্র এক লাখ টাকার জন্যেও তার বিরুদ্ধে সিলেটের আদালতে মামলা হয়েছিল।
এ সকল বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের বক্তব্য জানতে চেয়ে তার সেলফোনে একাধিকবার কল দেয়া হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।