ঢাকার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, পুলিশের তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য
ওমরাহ’র আড়ালে স্বর্ণ চোরাচালান
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৫৮:৩৯ অপরাহ্ন

কাউসার চৌধুরী :
সিলেটের ট্রাভেল ব্যবসায়ী শাহীদ আহমদ ওরফে শাহিদ হাতিমী রাজধানী ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোলাচালানসহ ধরা পড়ার ঘটনায় তোলপাড় চলছে। ওমরাহর আড়ালে তিনি একাধিকবার স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে এসেছেন বলে ইতোমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। তিনি ওমরাহ গ্রুপ নিয়ে সৌদি গমন করেন। আর ফিরতি ফ্লাইটে তাকে স্বর্ণসহ গ্রেফতার করে ঢাকার কাস্টমস হাউস। দৈনিক সিলেটের ডাক’র অনুসন্ধানে স্বর্ণ চোরাচালানের এ ঘটনার চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের বিমানবন্দর থানার ওসি তাসলিমা আক্তার সিলেটের ডাককে এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
আদালতে স্বীকারোক্তি
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রেফতারের পর শাহিদ আহমদকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দু’দিনের রিমান্ডে আনে পুলিশ। ঢাকার বিমানবন্দর থানা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেন।
দু’দিনের রিমান্ডের পর ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন। জবানবন্দিতে তিনি একাধিকবার স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে এসেছেন বলে স্বীকার করেন। জবানবন্দিতে তিনি স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। পুলিশ বর্তমানে পুরো বিষয়টির তদন্ত করছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।
স্বর্ণসহ যেভাবে কাস্টমস’র হাতে
পুলিশ সূত্র জানায়, গত ৪ জানুয়ারি শনিবার সকাল সাড়ে আটটায় সৌদি আরবের জেদ্দা থেকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট (ফ্লাইট নং- উঝ ৩৬২) শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ওই ফ্লাইটের যাত্রী ছিলেন শাহিদ আহমদ। এরপর সকাল প্রায় ১০ টার দিকে তিনি বিমানবন্দরের গ্রীন চ্যানেল অতিক্রমকালে বিমানবন্দর কাস্টমস’র সন্দেহ হলে তার সাথে থাকা ব্যাগেজ স্ক্যান করা হয়। স্ক্যানিংকালে তার বহনকৃত কাঁধ ব্যাগে বেশকিছু স্বর্গের চুড়ি সদৃশ বস্তুর উপস্থিতি পাওয়া যায়। এরপর শুল্ক গোয়েন্দার সহযোগিতায় তার আরও একটি ব্যাগ উদ্ধার করে স্ক্যানিং করলে সেটিতেও স্বর্ণের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। পরে বিমানবন্দরের ইনভেনটরি কাউন্টারে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে তার একটি লাগেজ ও একটি ব্যাগ থেকে সর্বমোট ১ হাজার ৭৯৮ গ্রাম স্বর্ণ জব্দ করে কাস্টমস হাউস। এ সময় স্বর্ণসহ তাকে কাস্টমস আটক করে।
১ কোটি ৭৭ লাখ টাকার স্বর্ণ
কাস্টমস হাউস ঢাকার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. হাসিবুর রহমান স্বাক্ষরিত জব্দ তালিকায় ওই চোরাচালানের স্বর্ণের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়। এতে বলা হয়, ৭২৮ গ্রাম ওজনের ২৪ ক্যারট স্বর্ণের চুড়ি ৫১টি, এক হাজার দুই গ্রাম ওজনের ২১ ক্যারট স্বর্ণের চুড়ি ৬৪টি, ৪৫ গ্রাম ওজনের ২১ ক্যারট স্বর্ণের চেইন ৯টি, দুই গ্রাম ওজনের ২১ ক্যারট স্বর্ণের আংটি ২টি, ৫ গ্রাম ওজনের ২১ ক্যারট স্বর্ণের কানের দুল ১টি, ১৬ গ্রাম ওজনের ২১ ক্যারট স্বর্ণের ভাঙা টুকরো ১টিসহ স্বর্ণের চুড়ি, চেইন, আংটি, কানের দুল ও ভাঙা টুকরোসহ সর্বমোট ১ কেজি ৭৯৮ গ্রাম স্বর্ণ জব্দ করে কাস্টমস। জব্দকৃত স্বর্ণের বাজারমূল্য ১ কোটি ৭৭ লাখ ৪০ হাজার ৬০০ টাকা। এ সময় একটি পাসপোর্ট (যার নং- অ০৭৬৩০৩১৩), একটি রেডমি মোবাইল ফোন, বোর্ডিং পাস, একটি ছোট ব্যাগ ও একটি ল্যাগেজও জব্দ করা হয়।
ওমরাহর আড়ালে স্বর্ণ চোরাচালান
এ ঘটনায় কাস্টমস হাউস ঢাকার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. হাসিবুর রহমান বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-০১। তারিখ ০৪/০১/২০২৫। মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামির এহেন কার্যকলাপ কাস্টমস আইন, ২০২৩ এর ধারা ২(২৪) অনুসারে চোরাচালান হিসাবে বিবেচিত এবং একই আইনের ধারা ১৭ এবং ৩৩ অনুযায়ী সংঘটিত অপরাধ।
উল্লেখ্য, আসামী কোনরূপ ঘোষণা প্রদান করেনি। আটককৃত স্বর্ণ ক্রয়ের অর্থ কিভাবে পরিশোধিত হয়েছে তার স্বপক্ষে কোন প্রমাণাদি না থাকায় তা বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭ এর ধারা-৮ এর লঙ্ঘন। উক্ত আসামী বলবৎ ১৯৫০ সালের আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইন এর ধারা-৩(১), তথা আমদানি নীতি আদেশ ২০২১-২০২৪ এর অনুচ্ছেদ ২৫ (১২)ক-স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার নম্বর ঋঊ ঈওজঈটখঅজ ঘঙ-০৬, উধঃব-০৩-০২-২০২০ এর লঙ্ঘনে অপরাধে ১৯৭৪ সনের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ধারা ২৫-বি এর ১ (বি) মোতাবেক আটক করা হয়। কাস্টমস আইন, ২০২৩ সালের ১৮০ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বর্ণিত আসামিকে আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে নিয়মিত মামলা রুজুর উদ্দেশ্যে আটক পূর্বক বিমান বন্দর থানায় সোপর্দ করা হয়।
পুলিশ বলছে, তাকে সরাসরি চোরাচালান আইনের অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। তিনি নিজেও ওমরাহর আড়ালে স্বর্ণ চোরাচালান করতেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
কে এই শাহীদ আহমদ
স্থানীয় সূত্র জানায়, শাহীদ আহমদ মূলত শাহিদ হাতিমী নামেই পরিচিত। তিনি সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার ডেমা গ্রামের আব্দুস সালামের পুত্র। তিনি সিলেট নগরের বন্দরবাজারের রংমহল টাওয়ারের চতুর্থ তলার হাতিমী ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী। এছাড়াও তিনি যুব জমিয়তের সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক।
তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ যা বললেন
ঢাকা মহানগর পুলিশের বিমানবন্দর থানার ওসি তাসলিমা আক্তার সিলেটের ডাককে বলেন, রিমান্ডে এনে শাহীদ আহমদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য দিয়েছেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বিমানবন্দর থানার উপ-পরিদর্শক এস এম মাইনুল ইসলাম জানান, স্বর্ণসহ কাস্টমস শাহীদ আহমদকে আটক করে। এ ঘটনায় কাস্টমস মামলা করে। পরে তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি জিজ্ঞাসাবাদে স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে তথ্য দিয়েছেন।
আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি একাধিকবার সৌদি থেকে স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে আসেন। স্বর্ণ চোরাচালান সম্পর্কে আদ্যপান্ত তথ্য দিয়েছেন। পুলিশ তার জবানবন্দির সূত্র ধরে তদন্ত করছে বলে তিনি জানিয়েছেন।