গোলাপগঞ্জে টিলা ধসে একই পরিবারের চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যু
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ জুন ২০২৫, ১:৩০:৩৫ অপরাহ্ন
গোলাপগঞ্জ প্রতিনিধি : টানা বৃষ্টিতে সিলেটের গোলাপগঞ্জে টিলা ধসে বসতঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় মাটিচাপায় একই পরিবারের চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার ৭ নম্বর লক্ষ্মণাবন্দ ইউনিয়নের বখতিয়ার ঘাট গ্রামে শনিবার দিবাগত রাত দেড়টা থেকে সোয়া ২টার মধ্যে এ ঘটনা ঘটে।
এতে নিহত ব্যক্তিরা হলেন— বখতিয়ার ঘাটের রিয়াজ উদ্দিন (৫০), স্ত্রী রহিমা বেগম (৩৪), মেয়ে সামিয়া খাতুন (১৫) ও ছেলে আব্বাস উদ্দিন (১৩)।
রোববার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে উপজেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী ও পুলিশের চার ঘণ্টার যৌথ প্রচেষ্টায় তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন গোলাপগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফয়সাল মাহমুদ ফুয়াদ।
স্থানীয়রা জানিয়েছে, অন্যান্য দিনের মতো বসতঘরের একটি কক্ষে দ্বিতীয় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন রিয়াজ উদ্দিন। শনিবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে প্রবল বৃষ্টিতে টিলার পাদদেশে অবস্থিত আধা পাকা বসতঘরের ওই অংশের ওপর মাটি ধসে পড়লে ভেতরে থাকা রিয়াজ উদ্দিনসহ চারজন চাপা পড়েন। চিৎকার শুনে স্থানীয়রা মাটি সরানোর চেষ্টা করেন, তবে তারা ব্যর্থ হন। এরপর খবর পেয়ে রাত ৪টার দিকে ফায়ার সার্ভিস, সোনাবাহিনী, পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের যৌথ প্রচেষ্টায় রোববার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে মরদেহগুলো উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
রোববার বাদ আছর উপজেলার ৭ নম্বর লক্ষণাবন্দ ইউনিয়নের বখতিয়ারঘাট গ্রামের করবস্থানে দাফন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিহত রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে হোসেন আলী।
পেশায় ট্রাকচালক হোসেন আলী (২৬) ভূষি নিয়ে হবিগঞ্জের শাববাজপুরে গিয়েছিলেন শনিবার রাতে। গিয়ে মাল নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। রাত ২টার দিকে খবর পান, পরিবারের চারজন টিলা ধসে মাটিচাপা পড়েছেন। এ খবর পাওয়ার পর বাড়িতে আসার চেষ্টা করেন হোসেন আলী। কিন্তু রাতে গাড়ি না পাওয়ায় ফিরতে পারেননি।
সেই সময়টা খুব কষ্টের ছিল জানিয়ে হোসেন আলী বলেন, “সকালে বাড়ি এসে দেখি, এরই মধ্যে মা আর ভাই-বোনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আর আমার চোখের সামনেই বাবার মরদেহ টেনে মাটির ভেতর থেকে বের করা হয়। সন্তান হিসেবে পরিবারের লাশ দেখা অনেক কষ্টের। এটা কাউকে বোঝাতে পারব না। একসঙ্গে চারটা লাশের ভার বহন করা যায় না ভাই।”
হোসেন আলী বলেন, “আমাদের পরিবার আগে টিলার উপরে ছিল। সাত বছর আগে এখানে ঘর বানিয়েছিলাম। যখন টিলার আরও উপরে ছিলাম তখন এ রকম কোনো কিছু হয়নি। এখন কেন হল বুঝতে পারতেছি না। আমরা টিলাও কাটিনি। আমাদের পরিবার ৩৫ বছর ধরে এখানে বসবাস করছেন।
“আমার আম্মা আর ছোট বোন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। বার বার আব্বার কথা বলতেছেন আর কান্না করতেছে। তবে তারা শারীরিকভাবে কোনো আঘাত পাননি।”
হোসেন আলীর চাচি ফাতেমা বেগম বলেন, “আমার ভাসুর দিনমজুর ছিলেন। তিনি দুই বিয়ে করেছেন। প্রথমে স্ত্রীর এক ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। আর দ্বিতীয় স্ত্রীর এক ছেলে, এক মেয়ে।”
তিনি বলছিলেন, “মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ছেলেকে বিয়ে করানোর কথা ছিল। তার আগেই তারা চলে গেলেন।”
অন্য দিনের মতো বসতঘরের একটি কক্ষে দ্বিতীয় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন রিয়াজ উদ্দিন। শনিবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে প্রবল বৃষ্টিতে টিলার মাটি, চালের টিন ও দেওয়াল ধসে পড়লে ভেতরে থাকা চারজন চাপা পড়েন।
চিৎকার শুনে স্থানীয়রা মাটি সরানোর চেষ্টা করেন। তখন মাটি নামার কারণে কেউ কিছু করতে পারছিল না।
পরে ফায়ার সার্ভিস, সোনাবাহিনী, পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের লোকেরা এসে মরদেহগুলো উদ্ধার বের করে আনেন।
টিলা ধসের সংবাদ পেয়ে সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মোহাম্মদ মাহবুব মুরাদ।
এ সময় তিনি বলেন, “আমাদের সতর্কবার্তা বেশ আগে থেকে দেওয়া হয়েছে। আমরা এই কার্যক্রম শীত মৌসুমে শুরু করেছিলাম। মানুষকে সচেতন করতে গতকালও এই এলাকায় মাইকিং করা হয়েছিল। এখন থেকে যারা নিরাপদ স্থানে সরে না যাবেন তাদের আমরা সরিয়ে নেব।”
গোলাপগঞ্জ উপজেলার ইউএনও (ভারপ্রাপ্ত) ফয়সাল মাহমুদ ফুয়াদ সাংবাদিকদের বলেন, নিহতদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বার প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করেন মরদেহগুলো বিনা ময়নাতদন্তে দাফন করার জন্য। উনাদের দাবির প্রতি সম্মান রেখে বাকি আইনি প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করে বাদ আছর নিহতদের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৮০ হাজার টাকা সহায়তা করা হয়েছে।
গত বছরের (২০২৪) ১০ জুন সিলেট নগরীর মেজরটিলা চামেলিবাগ এলাকায় টিলা ধসে শিশুসহ একই পরিবারের তিনজনের প্রাণহানি ঘটে।




