মসজিদ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় সংস্কার
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জুন ২০২৫, ৮:৪৫:৩৪ অপরাহ্ন

মাওলানা ওলীউর রহমান :
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে মসজিদের ইমাম ও খতিবদের। বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে আলেম-উলামাদের উপর বিভিন্নভাবে যেসব নির্যাতন ও নীপিড়ন হয়েছিলো এতে বাদ যাননি মসজিদের ইমাম ও খতিবরাও। অনেক ইমাম ও খতিব জুমআর বয়ানে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেন নাই। দেশের গুরুত্বপূর্ণ মসজিদগুলোর খতিবদের জুমুআর বয়ানকে বিভিন্নভাবে মনিটরিং করা হতো। বয়ানের কোনো কথা সরকারের বিপক্ষে গেলেই সাথে সাথে তাকে নাজেহাল বা গ্রেফতার করা হতো। ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই বাংলা ট্রিবিউনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা গেছে জুমুআর নামাজে সরকারি খুতবা পাঠ না করায় নোয়াখালির কবিরহাট উপজেলার সুন্দলপুর ইউনিয়নের বেলাল হোসেন নামক এক ইমামকে গ্রেফতার করেছে কবিরহাট থানা পুলিশ। সে সময় থানার একটি সূত্র জানিয়েছিলো যে, সরকারের অনুমতি হলে ইমাম বেলাল হোসেনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হবে। ২০২১ সালে ব্রহ্মণবাড়িয়ায় একই দিনে দু’জন ইমামকে গ্রেফতার করা হয়। এভাবে দীর্ঘ ১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের কারণে দেশের ইমাম খতিবগণ অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। যার দরুন তারা জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে কৌশলে জুমুআর বয়ানে জনগণকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য উদ্ভুদ্ধ করেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিদায় হলেও তাদের জায়গাগুলো দ্রুত অন্যরা দখল করে নিচ্ছে। ২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের পর থেকে সারা দেশে বহু ইমাম মুয়াজ্জিন এবং খতীবকে নাজেহাল করা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রায় চার লক্ষ মসজিদের মিম্বর আধুনিক ও বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফ্রম। এখানে কর্মরত আছেন প্রায় ১০ লক্ষ ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিন ও খাদিম। তারা যুগ যুগ ধরে নানা রকম বৈষম্য ও অমানবিকতার মধ্য দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এই বিশাল জনশক্তির প্রতি বরাবরই বিমাতা শোলভ আচরণ করা হয়েছে। অথচ চার লক্ষ মসজিদের এই প্লাটফ্রমকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারলে বিভিন্ন দিক থেকে সমাজ ও রাষ্ট্র উপকৃত হতো। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে পাড়া মহল্লায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মসজিদগুলো। কোনো একটি পাড়া বা মহল্লায় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকলেও একটি মসজিদ পাওয়া যাবে। তাই নগর-মহানগরের সাথে মফস্বল এলাকার সেতুবন্ধন ও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলো এই মসজিদ সমূহ। মসজিদ সমূহের সাথে যেহেতু সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্পর্ক থাকে তাই মসজিদের মিম্বরগুলোর মাধ্যমে খুব সহজেই গোটা জাতির কাছে কোনো বার্তা পৌঁছে দেয়া সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন মসজিদ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার আদি যুগের যে নিয়ম আমাদের দেশে প্রচলিত আছে তা ব্যাপকভাবে সংস্কার করে একটি যুগোপযোগী নীতিমালার আলোকে মসজিদগুলোকে পরিচালিত করা। একই সুতোয় মসজিদগুলোকে গন্থিত করা।
২০০৬ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করলেও এর কোনো কার্যকারীতা নেই, এই নীতিমালাকে কেউ অনুসরণ করে না। এই নীতিমালাকে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক করতে হবে। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ- ১. মসজিদ পরিচালনা পদ্ধতি এবং ২. ইমাম, মুয়াজ্জিনসহ মসজিদে কর্মরত জনশক্তির জীবনমান, তাদের মর্যাদা ও অধিকার।
আমাদের দেশের মসজিদ সমূহ পরিচালিত হচ্ছে পঞ্চায়েতী নিয়মে সাধারণ মানুষের আর্থিক অনুদানে। গ্রামে গঞ্জে অধিকাংশ মসজিদের কোনো পরিচালনা কমিটি নেই, গ্রামের মুরুব্বী মাতেব্বররা যেভাবে ভালো মনে করেন সেভাবেই মসজিদ পরিচালনা করেন। শহর ও শহরতলীর অধিকাংশ মসজিদের পরিচালনা কমিটি থাকলেও মসজিদগুলো পরিচালিত হয় নিজেদের ইচ্ছামত। দেশের অধিকাংশ মসজিদ যারা পরিচালনা করেন তারা মসজিদের মর্যাদা ও ইমাম, মুয়াজ্জিন খতীবগণের সন্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে তেমন কিছু জানেনা বা এরকম মানসিকতা লালন করেন না। অধিকাংশ জায়গায় এলাকার প্রভাবশালী লোকেরা মসজিদ কমিটির সভাপতি/ মোতাওয়াল্লী, সেক্রটারি বা বিভিন্ন পদপদবী গ্রহণ করেন এবং এই পদপদবির পরিচয়কে তাদের ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করলেও মসজিদের উন্নয়ণ এবং ইমাম মুয়াজ্জিনগণের ভালো-মন্দের প্রতি তেমন খেয়াল করেন না। কেউ কেউ মসজিদ কমিটির বিভিন্ন পদ পদবিকে আকড়ে ধরেন সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে। এমনকি সঠিকভাবে মসজিদের প্রতি তদারকি নেই, জবাবদিহিতা নেই, হিসাব-কিতাবও নেই। স্বৈরাচারী আচরণ করেন সাধারণ মুসল্লিদের সাথে। এমনকি ইমাম মুয়াজ্জিনদের সাথেও। অনেক মসজিদের দায়িত্বশীল সুদি ব্যবসা করে, ঘুষ নিয়ে এলাকায় বিচার শালিশ করে থাকেন, তার কাজে কর্মে মনে হয় না যে, তিনি মসজিদ কমিটির একজন দায়িত্বশীল। মসজিদ আল্লাহর ঘর, এখানে কমিটির সভাপতির যে অধিকার বিশ্বের যে কোনো মুসলমানের সমান অধিকার রয়েছে। মসজিদ কমিটির দায়িত্বশীল একটি সন্মানের জায়গা। তাই মসজিদ কমিটির দায়িত্বশীল হবেন এমন মানুষ যিনি হবেন নামাজী, সৎ ও পরহেজগার। যিনি প্রয়োজনে মসজিদের খেদমতে নিজেকে আত্মনিয়োগ করবেন, আযান এক্বামত দিবেন প্রয়োজনে ইমামের দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। সকল অনিয়মের জঞ্জাল থেকে মসজিদগুলোকে বের করা দরকার।
মাঝে মধ্যে পত্রিকায় ইমাম নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় এবং ইমামের যোগ্যতা চাওয়া হয় হাফিজ, মাওলানা, মুফতি, ক্বারী, সু-ললিত কন্ঠের অধিকারী, বিবাহিত ইত্যাদি। একজন মানুষ যদি এতোগুলো যোগ্যতার অধিকারী হয় তাহলে বর্তমান সময়ে তার বেতন কত টাকা হওয়া দরকার? কিন্তু বেতনের কলামে লেখা হয় আলোচনা স্বাপেক্ষে। অর্থাৎ দর দাম করে যতটুকু কম দেওয়া যায়। ইমাম নিয়োগের ইন্টারভিউ নেওয়া হয় এক আজীব তরিকায়। ইন্টারভিউ বোর্ডে দু’একজন আলেম থাকলেও মোতাওয়াল্লি, সেক্রেটারীরাই বেশি প্রশ্ন করেন। ইন্টারভিউ এর সময় এলাকার ছোট বড় অনেক লোক উপস্থিত থাকেন, যা একজন আলেমের মান মর্যাদার পরিপন্থী। মাদরাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায়ের ডিগ্রি প্রাপ্ত একজন আলেমকে ইমাম নিয়োগ পরীক্ষায় এমন লোকও প্রশ্ন করে যে কিনা ঠিক মত একটি সূরাও সহীহ করে পড়তে পারবে না। এই অপমানজনক ইন্টারভিউ পদ্ধতি পরিহার করা প্রয়োজন এবং একটি সন্মানজনক পদ্ধতিতে ইমাম মুয়াজ্জিনগণের নিয়োগ পরীক্ষা নেয়া প্রয়োজন।
ইমাম মুয়াজ্জিনগণকে বিদায় করার পদ্ধতিটাও বেশ অপমানজনক এবং অমানবিক। তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে ইমাম মুয়াজ্জিনকে বিদায় করে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও কোনো নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা করা হয়না অধিকাংশ মসজিদে। বিশ্ব ইজতেমায় যাওয়ার জন্য মাসের মধ্যখানে বেতন চাওয়ায় সিলেটে এক ইমামকে মোতাওয়াল্লী অশালীন ভাষায় গালাগালি করে বিদায় করেন। দোয়ার মধ্যে মোতাওয়াল্লীর ছেলের নাম উল্লেখ না করার কারণে ইমামকে বিদায় করা হয়েছে। এরকম তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে একজন ইমাম বা মুয়াজ্জিনকে মুহুর্তেও মধ্যে বিদায় করে দেওয়া হয়। এই আধুনিক যুগেও মসজিদগুলো চলছে একরকম বুনো আইনে।
ইমাম মুয়াজ্জিনদের যে বেতন দেওয়া হয় তাও একেবারে অল্প। কেনো কোনো ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মত নয়। একটি মহল্লার মসজিদের ইমাম বা মুয়াজ্জিনের যে বেতন নির্ধারণ করা হয় তা দিয়ে ঐ মহল্লার সবচেয়ে দরিদ্র যে পরিবারটি আছে সেই পরিবারের ১০ দিনের বাজার খরচও চলবে না। তারপরও ইমাম মুয়াজ্জিনগণ বেতন বৃদ্ধির কথা বললে চাকরীও চলে যেতে পারে। মোটামোটি এভাবেই চলছে দেশের লক্ষ লক্ষ মসজিদ। অন্য দিকে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয় বিদেশে, কোনো কোনো মন্ত্রী এমপি ও সরকারী কর্মকর্তা শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বেগম পাড়া সহ সম্পদের পাহাড় তৈরী করেন অথচ সরকারীভাবে ইমাম মোয়াজ্জিনদের বেতন ভাতা চালু করার কথা বললে নানা রকম অযুহাত পেশ করা হয় বিভিন্ন মহল থেকে। কথায় আছে ‘রাজ্য চলে রাজার চালে”- আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তারা ইমাম মুয়াজ্জিন, মসজিদ মাদরাসা সম্পর্কে একরকম খয়রাতী মানসিকতা পোষণ করেন। সাধারণ মানুষও এই মানসিকতা লালন করে। এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। মসজিদ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন। এতে উপকৃত হবে গোটা সমাজ।
লেখক : তরুণ আলেম, প্রাবন্ধিক।