উপমহাদেশের প্রথম গ্রাজুয়েট একজন বাঙালি কবি কামিনী রায়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ৭:২০:১৭ অপরাহ্ন
রোমেনা রোজী :
`আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী `পরে
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।’
মানব-জীবনের লক্ষ্য ও কর্মকান্ডের মূল লক্ষ্য কি হওয়া উচিৎ তা-ই আমরা জানতে পারি এই কাব্যাংশ থেকে; মানুষের এই জীবনের আলেখ্যের মূল রচিয়তা কবি কামিনী রায়। স্কুলের ক্লাস এইটের পাঠ্যবইয়ের কবি কামিনী রায়ের ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ কবিতার মর্মার্থ আজও আমাদের চলার পথে দ্বিধার পাহাড় ডিঙোতে প্রেরণা জোগায়।
কবি কামিনী রায় ১৮৬৪ সালের ১২ অক্টোবর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের চন্দ্রদীপ (বরিশাল জেলা)-এর অন্তর্গত বাকেরগঞ্জ মহুকুমার ঝালকাঠির বাসন্ডা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত এক বৈদ্য পরিবারে জন্মেছিলেন কামিনী রায়। তাঁর পিতার নাম চন্ডীচরণ সেন এবং মাতার নাম বামাসুন্দরী দেবী; কামিনী রায় ছাড়াও তাদের আরেকটি কন্যা ও একটি পুত্র সন্তান ছিলো।ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত তাঁর বাবা চণ্ডীচরণ সেন ছিলেন বিচারক, লেখক ও ব্রাহ্ম সমাজের বিশিষ্ট নেতা। তাই বুঝি লেখাপড়ার মর্মটা বুঝেছিলেন ভালো করেই। একটু দেরিতে হলেও ১২ বছর বয়সে মেয়েকে ভর্তি করেছিলেন কলকাতার এক বোর্ডিং স্কুলে। কামিনী রায়ের শৈশবের দিনগুলি ছিল অনেক সুন্দর। ছোটবেলায় তাঁর পিতামহ তাঁকে কবিতা ও স্তোত্র আবৃত্তি করতে শেখাতেন। তাঁর মা গোপনে বর্ণমালা শিক্ষা দিতেন। কারণ তখনকার যুগে হিন্দু নারীদের লেখাপড়া গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
তাঁর পিতা বিচারিক পেশায় নিয়োজিত থাকলেও ব্রাহ্ম মতের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতি সেবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কামিনী রায়ের পড়াশুনার হাতেখড়ি তাঁর পরিবারের মধ্যেই, বিশেষত মায়ের কাছে। বাড়িতেই তিনি বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ এবং শিশুশিক্ষা শেষ করে নয় বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হন এবং ওই বছরই আপার প্রাইমারি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান অর্জন করেন। এরপর ১৪ বছর বয়সে তিনি মাইনর পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
১৮৮০ খ্রীস্টাব্দে তিনি কলকাতা বেথুন স্কুল হতে এন্ট্রান্স (মাধ্যমিক) পরীক্ষা ও ১৮৮৩ খ্রীস্টাব্দে ফার্স্ট আর্টস (উচ্চ মাধ্যমিক সমমানের) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বেথুন কলেজ হতে তিনি ১৮৮৬ খ্রীস্টাব্দে ভারতের প্রথম নারী হিসাবে সংস্কৃত ভাষায় স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এর পর তিনি বেথুন কলেজেই শিক্ষকতা শুরু করেন এবং পরে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।
সাহিত্য ক্ষেত্রে “রূপসী বাংলার” কবি জীবনান্দ দাশের পরেই প্রধান কবি কামিনী রায়। তিনি একাধারে ছিলেন একজন কবি, সমাজকর্মী এবং নারীবাদী লেখিকা; তদুপরি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক। তৎকালে মেয়েদের শিক্ষা বিরল ঘটনা ছিল। সেই সময়ে কামিনী রায় নারীবাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। লিখেছিলেন সব অসঙ্গতির বিরুদ্ধে ও নারী জাগরণের পক্ষে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বিশেষ করে নারীকল্যাণে তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। কামিনী রায় ভারতের প্রথম মহিলা অনার্স গ্র্যাজুয়েট এবং তিনি সব সময়ই শিক্ষানুধ্যায়ীদের ভালোবাসতেন, উৎসাহ দিতেন ও সহযোগিতা করতেন অন্য নারী সাহিত্যিকদের। তিনি ১৯২৩ সালে এক সম্মেলনে বরিশাল এলে কবি বেগম সুফিয়া কামালের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁকে লেখালেখির বিষয়ে প্রবল উৎসাহ দেন এবং মনোনিবেশ করতে বলেন। তিনি ১৯২২-২৩ সালে নারীশ্রম তদন্ত কমিশনের সদস্য ছিলেন। এছাড়াও বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে সাহিত্য শাখার সভানেত্রী ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সহসভাপতি ছিলেন।
তাঁর কবিতা পড়ে বিমোহিত হন সিবিলিয়ান কেদারনাথ রায়। ১৮৯৪ খ্রীস্টাব্দে কামিনী রায়ের সাথে সাথে কেদারনাথ রায়ের বিয়ে হয়। অথচ বিয়ের পর সংসারকেই কবিতা মেনে ছেড়েছিলেন কবিতা লেখা। তাঁদের ৩ টি সন্তান জন্মায়। প্রথম সন্তানটি জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই (১৯০০ সালের দিকে) মারা যায়, তার নাম জানা যায়-নি; অপর দুই সন্তানের নাম ছিলো লীলা রায় ও অশোকরঞ্জন রায়। ১৯০৩ সালে কামিনী রায়ের বোন কুসুম, ১৯০৬ সালে প্রথমে ভাই ও পরে বাবা মারা যায়। ১৯০৮ সালে তার স্বামী কেদারনাথ রায় ঘোড়ার গাড়ী উল্টে গিয়ে আঘাত পেয় মারা যান এবং এর কয়েক বছরের মধ্যে তিনি সন্তান লীলা ও অশোককেও হারান। এভাবে মাত্র ৭ বছরের মধ্যে প্রায় সকল আপনজনকে হারিয়ে তিনি একেবারে নিঃস্ব হয়ে ভেঙে পড়েন। প্রিয়জন হারানোর শোক ও দুঃখ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাঁর এই ব্যাথ্যাতুর হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি আমরা তাঁর রচনায় খুজে পাই।
করিতে পারি না কাজ/ সদা ভয় সদা লাজ/ সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,-/ পাছে লোকে কিছু বলে।’
কবি কামিনী রায়ের কবিতায় বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দ যেমন আশা-নিরাশা, হর্ষ-বিষাদ, অবসাদ, আর্তনাদ, সুখ-দুঃখ, স্বর্গ-মর্ত, ভয়, আলো-আঁধার, অশ্রু, জীবন-মরণ, মলিন, শোক, বেদনা, লাভ-ক্ষতি ইত্যাদির দিকে তাকালেই বোঝা যায় তিনি জীবনের ইতি ও নেতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং কবিতার বিষয়বস্তুর দিকে নজর দিলে দেখা যাবে যে তিনি জীবনের ব্যর্থতা, হতাশা, দুঃখ, বিষাদকেই প্রধান বিষয় করে তুলেছেন।
কবি কামিনী রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সংস্কৃত সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে খুব অল্প বয়স থেকে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি প্রথম কবিতা লেখেন। ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত ‘আলো ও ছায়া’ কামিনী রায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ, যার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন পাঠকসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। কামিনী রায় কবিতা লেখার শুরুতেই মধ্যযুগের নৈতিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং মহাজগতকে পরস্পর বিরুদ্ধ শব্দ দ্বারা চিনতে শিখেছিলেন। পৃথিবীকে ও তার বস্তুসমূহকে সাদা-কালো, আলো-আঁধার, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি বিপরীত শব্দ দিয়ে তিনি বুঝেছিলেন এবং পরপর বিপরীত শব্দগুলো দ্বারা কবিতার বাক্য গঠন করেছিলেন। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে; যেমন_ ‘কেউ হাসে, কাঁদে কেউ/…..দুঃখে-সুখ রয়েছে বাঁচিয়া’, ‘জীবন ও মরণের খেলা’, ‘ভাসাইয়া ক্ষুদ্র তরী, দিবালোকে, অন্ধকারে’, জীবন-মরণ একই মতন’, ‘মুক্তবন্দি’ ইত্যাদি অনেক ধরণের বাক্য তিনি ব্যবহার করেছেন। বাঙালি প্রায় সব কালেই সবকিছুকে এরকম পরস্পর-বিরুদ্ধ ভাব দ্বারা ব্যাখ্যা করেছে যা দ্বান্দ্বিক হলেও যান্ত্রিকতা-দোষে দুষ্ট ও অবৈজ্ঞানিক; সাদা-কালোর মাঝেও অনেক স্তর রয়েছে; মানুষ শুধু ভালো বা মন্দ নয়, সে আরো অনেক কিছু; আলো-অন্ধকার নিয়েই মানুষের জীবন নয়, জীবনের নানা দিকে রয়েছে বৈচিত্রের বর্ণিল সমাহার। এরকম বিস্তৃত জায়গাতে মানুষকে কামিনী রায় দেখেছেন সাদা চোখে একদেশদর্শি মানুষের চিন্তার মতো।
তাঁর কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সর্বাধিক। তিনি যেহেতু সংস্কৃতে পণ্ডিত ছিলেন, সেহেতু সংস্কৃত সাহিত্যের বিষয় অবলম্বনে রচিত তাঁর কবিতাগুলো অপেক্ষাকৃত উৎকৃষ্ট মানের। তাঁর কবিতায় জীবনের সাধারণ ঘটনাবলি হৃদয়ের সুকুমার অনুভূতির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। যদিও মনে করা হয়, তাঁর লেখায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব রয়েছে, তবু কামিনী রায়ের লেখার ঢং যে আলাদা, তা বোঝা যায় তাঁর সাহিত্য পড়লে।
সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নারী জাগরণে আসামান্য অবদান এবং তৎকালীন পশ্চাৎপদ সমাজের মধ্যে থেকেও প্রথম স্নাতক সম্মান ডিগ্রি অর্জন করায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কবি কামিনী রায়ের স্মরণে ১৯২৯ সাল থেকে ‘জগত্তারিণী পুরস্কার’ প্রবর্তন করে। তিনি ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় লিটারারি কনফারেন্সের সভাপতি ও ১৯৩২-৩৩ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
শেষজীবনে কবি কামিনী রায় ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের হাজারীবাগে বসবাস করতেন এবং এখানেই ১৯৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জীবন থেকে অবসর নেন ক্লান্ত কামিনী রায়।
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ আলো ও ছায়া প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ সালে; হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এর ভূমিকা লিখে দেন। কামিনী রায় একসময় ‘জনৈক বঙ্গমহিলা’ ছদ্মনামে লিখতেন।
তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ হলো- নির্মাল্য (১৮৯১), পৌরাণিকী (১৮৯৭), গুঞ্জন (শিশুকাব্য, ১৯০৫), ধর্ম্মপুত্র (অনুবাদ, ১৯০৭), মাল্য ও নির্মাল্য (১৯১৩), অশোকসঙ্গীত (সনেট, ১৯১৪), অম্বা (নাটক, ১৯১৫), বালিকা শিক্ষার আদর্শ (১৯১৮), ঠাকুরমার চিঠি (১৯২৪), দীপ ও ধূপ (১৯২৯), জীবনপথে (সনেট, ১৯৩০)। অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত ‘মহাশ্বেতা’ ও ‘পুণ্ডরীক’ তাঁর দু’টি প্রসিদ্ধ দীর্ঘ কবিতা। এ ছাড়া ১৯০৫ সালে তিনি শিশুদের জন্য গুঞ্জন নামের কবিতা সংগ্রহ ও প্রবন্ধ গ্রন্থ বালিকা শিক্ষার আদর্শ রচনা করেন।




