এইচএসসি পরীক্ষায় সিলেট বোর্ডে ফল বিপর্যয়ের কারণ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ৯:৪৪:৪৩ অপরাহ্ন
আনাস হাবিব কলিন্স :
উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় সিলেট বোর্ডে ফল বিপর্যয় ঘটেছে। পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোতেই নেমেছে ধস। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সিলেট বোর্ডের ফলাফলে এ চিত্র ফুটে উঠেছে।
ফলাফল বিপর্যয় নিয়ে শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা বলছেন, উত্তরপত্র মূল্যায়নের নির্দেশনায় দুর্বলতা, প্রশিক্ষণবিহীন পরীক্ষক দ্বারা উত্তরপত্র মূল্যায়ন, নিবন্ধনধারী শিক্ষকের অভাব, শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভীতির কারণে বিগত সাত বছরের মধ্যে এমন ফলাফল এসেছে। বিপর্যয় থেকে উত্তরণে এখনই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান তারা।
এদিকে, বোর্ড কর্তৃপক্ষ ফল বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে ইংরেজী ও আইসিটি বিষয়ে পাসের হার কম হওয়াকে দায়ী করছেন। এবারের পরীক্ষায় ইংরেজী বিষয়ে পাসের হার ৬৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। গত বছর এই বিষয়ে পাসের হার ছিল শতভাগ। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন পাসের হার আইসিটিতে ৮০.৮৭ শতাংশ। গত বছর ছিল ৮৭.৭৮ শতাংশ।
ফলাফল প্রসঙ্গে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী জানান, মানসম্মত শিক্ষকের অভাব, বিজ্ঞান শিক্ষায় অনাগ্রহ, অভিভাবকদের অসচেতনতা, সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী প্রবণতা খারাপ ফলাফলের পেছনে প্রভাব ফেলছে। এবার ইংরেজিতে অনেক শিক্ষার্থী কৃতকার্য হতে না পারায় সিলেটে পাসের হার কমেছে। সেই সাথে মানবিকের তুলনায় বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে শিক্ষার্থী কম থাকায় ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বোর্ড চেয়ারম্যান স্বীকার করেন, দুর্গম হাওরাঞ্চল ও গ্রামের অনেক প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি শিক্ষকের অভাব রয়েছে। শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আরো বলেন, সিলেটে এবছর যে ফলাফলটা এসেছে এটা সিলেটের বাস্তব চিত্র। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেখেন এবং তারপরের ফলাফলগুলো দেখেন আবার ২০২০ সাল থেকে ফলাফল থেকে বুঝে যাবেন এগুলো কিভাবে তৈরি করা হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যায় না, ইংরেজি ভালো করে বুঝে না। যার কারণে ফল খারাপ হচ্ছে। মফস্বল এলাকাগুলোয় ভালো ইংরেজি শিক্ষক নেই। তাছাড়া, শহরের মতো কোচিংয়ের সুবিধাও শিক্ষার্থীরা পায় না। ফলাফল নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মুহ: হায়াতুল ইসলাম আখঞ্জি বলেন, এসএসসি’র পর এইচএসসিতেও সিলেট শিক্ষা বোর্ডে ফল বিপর্যয়ের ঘটনা উদ্বেগজনক। এ ব্যাপারে শিক্ষক অভিভাবকসহ সচেতন মহলকে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নতুবা সিলেট অঞ্চলে শিক্ষার অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সিলেট শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব প্রফেসর কবির আহমদ বলেন, মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের কাংখিত ফলাফল অর্জিত হচ্ছে না। শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে বাংলাদেশ এক্সামিনেশন ডেভেলপমেন্ট ইউনিট (বেডো’র) প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
জামালগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান চৌধুরী বলেন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে আন্তরিকতার ঘাটতির কারণে ফলাফল বিপর্যয় ঘটছে। এসব সমস্যা দূরীকরণে অভিভাবকদের ভূমিকা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
এমরান আহমদ চৌধুরী মোহন নামে এক অভিভাবক বলেন, করোনা মহামারীর পর থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে অটোপাস প্রবনতা বিরাজ করছে। তাছাড়া, ইন্টারনেটের অপব্যবহার শিক্ষা কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী জানান, এসব দুর্বলতাকে চিহিৃত করে বোর্ড কর্তৃপক্ষ কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে এসএসসি পর্যায়ে পরীক্ষকদের ৬টি ব্যাচের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। অচিরেই উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষকদের প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান। তিনি আরো বলেন, ৫ আগষ্টের পর শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের সম্পর্কটা আগের মতো নেই। একজন শিক্ষার্থী একজন শিক্ষককে নির্দেশ দিচ্ছে, তাহলে একজন শিক্ষক কিভাবে পাঠদান নিবেন। এসব বিষয়েও খোঁজ নেয়ার দরকার বলে মনে করেন তিনি।
এবারের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, হিসাববিজ্ঞানে পাসের হার ৬৮ দশমিক ১১ শতাংশ (গত বছর ছিল ৭৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ), পদার্থবিজ্ঞানে ৮৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ (গত বছর ৯৬ দশমিক ৪২ শতাংশ), উচ্চতর গণিতে ৭৯ দশমিক ০২ শতাংশ (গত বছর শতভাগ), ইতিহাসে ৮১ দশমিক ৭৫ শতাংশ (গত বছর শতভাগ), বাংলায় ৯০ দশমিক ০২ শতাংশ (গত বছর শতভাগ), রসায়নে ৮৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ (গত বছর শতভাগ), জীববিজ্ঞানে ৯৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ (গত বছর শতভাগ), অর্থনীতিতে ৮৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ (গত বছর শতভাগ), সমাজবিজ্ঞানে ৯৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ (গত বছর শতভাগ), যুক্তিবিদ্যায় ৯০ দশমিক ৬৪ শতাংশ (গত বছর ৯৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ), মনোবিজ্ঞান: ৮৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ (গত বছর শতভাগ), ভূগোলে ৯৫ দশমিক ৬১ শতাংশ (গত বছর ৯৮ দশমিক ২৯ শতাংশ); পরিসংখ্যানে ৭৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ (গত বছর শতভাগ). ইসলামের ইতিহাসে ৯৮ দশমিক ৯০ শতাংশ (গত বছর শতভাগ) এবং কৃষি শিক্ষায় ৯২ দশমিক ৮০ শতাংশ (গত বছর শতভাগ)।
প্রসঙ্গত, সিলেট শিক্ষা বোর্ডে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় ৬৯ হাজার ১৭২ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। এর মধ্যে পাস করেছে ৩৫ হাজার ৮৭১ জন। পাসের হার ৫১.৮৬ ভাগ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ হাজার ৬০২ জন শিক্ষার্থী, যা গত বছরের তুলনায় ৫ হাজার ৯৬টি কম। গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৬ হাজার ৬৯৮ জন।




