জয়বাংলা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ নভেম্বর ২০২২, ৭:৫৮:১৪ অপরাহ্ন
রফিকুর রহমান লজু
স্লোগান কি রকম শক্তিধর তা আমরা একাত্তরে উপলব্ধি করেছি। পাকিস্তানি বর্বর হানাদারদের বিরুদ্ধে এক অর্থে বলতে গেলে আমাদের প্রধান অস্ত্র ছিল ‘জয়বাংলা’। জয়বাংলা বলে বাংলার দামাল ছেলেরা শত্রুদের বিরুদ্ধে অমিত বিক্রমে যুদ্ধ করেছে, বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। ‘জয়বাংলা’ ছিল প্রেরণার উৎস, শক্তি আর সাহসের আধার। ‘জয়বাংলা’ প্রথম উচ্চারণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একাত্তরের সাত মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য ঢাকার রেসকোর্স ময়দান কানায় কানায় ভর্তি ছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালি জনগণে। এই জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জনসভায় ভাষণ শেষ করে বঙ্গবন্ধু সব শেষে উচ্চারণ করেন ‘জয়বাংলা’। সেই থেকে ‘জয়বাংলা’র প্রচলন এবং সভা-সমাবেশ শেষে সবাই জয়বাংলা বলতে শুরু করেন। তখন থেকে ‘জয়বাংলা’ হয়ে যায় আওয়ামী লীগের স্লোগান। একাত্তর সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম লাভের পর এটা হয় দেশের জাতীয় স্লোগান। এক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে জানা যায়, বিশ্বের ১৬৬টা দেশে সাংবিধানিক স্লোগান রয়েছে এবং ১২টি দেশে নিজ নিজ দেশের জাতির পিতাকে স্লোগানে রেখে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভাষা স্মরণ সপ্তাহ পালনকালে বলেছিলেন ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা আছে। তাই জয়বাংলার আবেদনটা চিরঞ্জীব। ইতিহাস নিয়ে যারা চর্চা করেন তারা বলেন- ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জয়বাংলা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই আন্দোলনের এক নেতা পূর্ণচন্দ্র দাসের উদ্দেশ্যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেন ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থ’র ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতাটি। এই কবিতায় নজরুল ইসলাম প্রথম ‘জয়বাংলা’ ব্যবহার করেন। পাকিস্তানি আমলে ‘জিন্দাবাদ’ শব্দটি ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা পায়। সব সময় পাকিস্তান-জিন্দাবাদ বলা হতো। জিন্দাবাদ ব্যক্তির নামের সঙ্গে ব্যবহৃত হত; যেমন কায়দে আযম- জিন্দাবাদ, শহিদ আলকাছ জিন্দাবাদ। যারা পাকিস্তানপন্থি জিন্নাহপন্থি তারা সোৎসাহে পাকিস্তান-জিন্দাবাদ বলতেন। যারা পাকিস্তান-জিন্দাবাদ বলতেন না তারা নিজেদের বাঙালি বলতে গর্ববোধ করতেন। তারা পাকিস্তানি জাতীয় সংগীত গাইতেন না। বিপদে পড়লে ঠোঁট মেলাবার ভান করতেন। করাচি থেকে রেডিওতে খবর পড়ার সময় পাকিস্তানি পতাকা দেখানো হতো ও পাকিস্তানি জাতীয় সংগীত পাকছার জমিন বাদ….. বাজানো হতো, তথাকথিত পূর্বপাকিস্তানের জনগণ বাঙালিরা তখন রেডিও অফ করে দিতেন। তখন শুধুমাত্র খবর শোনার জন্য করাচি রেডিও অন করা হতো। খবর শেষে তখন পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ বলা হতো, আমরা তার আগেই রেডিওর সুইচ অফ করে দিতাম।
‘জয়বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান করার জন্য এক সময় হাইকোর্ট থেকেও রায় হয়। মন্ত্রিসভায় এ বিষয়ে আলাপ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় জয়বাংলা, বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হবে। সব জাতীয় দিবসগুলোতে এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদাধিকারীগণ এবং রাষ্ট্রের সব কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় বা সরকারি অনুষ্ঠানের বক্তব্য শেষে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করবেন। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্থাৎ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ বা এসেম্বলি সমাপ্তির পর, ক্ষেত্রমতে সভা-সেমিনারে ছাত্র-শিক্ষকগণ ‘জয়বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করবেন। এই প্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১৯ মার্চ একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ ‘জয়বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান করার পক্ষে রায় দেন। আসলে ‘জয়বাংলা’ কোনো দলীয় স্লোগান নয়, এটা জাতীয় স্লোগান। দেশের তরুণ-কিশোর যুবারা নিজেদের প্রাণ তুচ্ছ করে জয়বাংলা স্লোগান ধরেছেন, তা জাতীয় স্লোগানে পরিণত হয়েছে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশের রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠান থেকে জয়বাংলাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। পরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের এই অমিততেজি স্লোগান আবার সর্বক্ষেত্রে ফিরে এসেছে, প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কেউ কেউ জয়বাংলাকে সাম্প্রদায়িক লেবাস পরাতে হীন চেষ্টা করেছে। তাও ব্যর্থ হয়েছে স্বমহিমায়।