প্রসঙ্গ : এসএসসির রেজাল্ট
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০১ ডিসেম্বর ২০২২, ২:০১:৩৭ অপরাহ্ন
মুহাম্মদ শরীফ উদ্দীন
এসএসসি/সমমান পরিক্ষার ফলাফল বের হয়েছে। কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শতভাগ, আবার কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শত এ+ পেয়ে নিজেরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন। আর কিছু প্রতিষ্ঠান যারা অতীতে রীতিমতো খারাপ ফলাফল করেছেন, বর্তমান সিলেবাসের সুবাদে একটু ভালো করেছেন বা পাসের হার বাড়িয়েছেন তাদের তুষ্টির মাত্রাটা বেশি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আমাদের কারো অজানা নয়, করোনা কালীন ১ম বছর এইচএসসি/ সমমান পরিক্ষার্থীদের অটোপাশ দেওয়া হয়েছিল। শুধু পাশ নয় অনেকেই ভাগ্য গুনে এসএসসি / সমমান পরীক্ষায় এ+ না পেয়েও এইচএসসি পরীক্ষায় এ+ পেয়েছেন। এসব শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ দিন নিজেদেরকে অটোপাশ নেশন হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এখন হয়তো তারা অনার্সের মত শ্রেনীতে ভর্তি হয়ে সেটার পরিচয় দিচ্ছেন। পরবর্তীতে মহামারি কালিন আরেক নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি আসল, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে, সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা। যেখানে ৩/৪ বিষয়ের হাতে গোনা ২/৩ অধ্যায় পড়লে পরীক্ষায় এ/এ+ মত ফলাফল অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এবারও সেই সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে সকল বিষয়ে সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা হয়েছে। সেই পরীক্ষা দিতেও শিক্ষার্থীদের অনিহা। তারা পড়তে চায় না, তবে তারা এ/এ+ চায়, সার্টিফিকেট চায়। অথচ শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো, আগামী প্রজন্মকে আদর্শ, যোগ্য ও দেশ প্রেমিক জাতি হিসেবে তৈরী করা। এই যে ৩টা জেনারেশন আমরা পেলাম সেই জেনারেশন আমাদেরকে, দেশ জাতিকে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভুগাবে। এর দায়ভার শিক্ষার্থীদের নয়, এটার জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সহজ হিসেবটা দেখুন, আগে যেখানে সমস্ত বই (১২/১৫ টি অধ্যায়) পড়ে পরীক্ষার প্রশ্নে ১১টা প্রশ্ন হতে ৭ টি সৃজনশীল, আর ৩০ টি নৈর্ব্যাক্তিক উত্তর করা বাধ্যতামূলক ছিল।এখন সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে ৬/৭ টি অধ্যায় রয়েছে।যেখানে, সৃজনশীল ১১ টি প্রশ্ন হতে ৪ টি, বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ৩০টি হতে ১৫ টি উত্তর করা বাধ্যতা মূলক করা হয়েছে। কিন্তু একটু কৌশলী হলে সর্বোচ্চ ৩/৪ টা অধ্যায় পড়ে ১১ টি প্রশ্ন হতে ৪ টি, বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ৩০টি হতে ১৫ টি উত্তর করা সম্ভব, এ+ নিশ্চিত । পাস মার্কের অবস্থা আরো করুণ। আগে যেখানে ৩৩ মার্ক পেয়ে পাশ করতে হত, এখন ১৭ মার্ক পেলে কেউ পাস করতে পারে। এখন যদি কেউ বহুনির্বাচনি ৩০টির মধ্যে ৬/৭ টির উত্তর করতে পারে, আর ১১টি সৃজনশীল প্রশ্নের মধ্যে ২টির উত্তর করতে পারে সে নিশ্চিত শুধু পাস নয়,ভালো গ্রেড পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর যারা একটু ভালো করে লেখা পড়া করবে সে তো নিশ্চিত এ+.এই আজব শিক্ষা ব্যবস্তার কারনে লেখাপড়ার সাথে জড়িত বিবেকবান মানুষ মাত্রই কষ্ট পান। লেখা পড়ার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট এই হিসেবটা বুঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হবে না। কথা হলো তাহলে এবারও কেন শিক্ষার্থীদের অনেকে ফেল করল।সহজ উত্তর, তারা পড়ে না,পড়তে চায় না, তবে তারা পাসের সার্টিফিকেট চায়।আর এই অভ্যাসটা শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা শিক্ষার্থীদের মাঝে গড়ে তুলেছেন। এই সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের মানসিকতা এখন শুধু শিক্ষার্থীদের মাঝে বিরাজ করছে না,কিছু কিছু শিক্ষকদের মাঝে চলে এসেছে। কতিপয় শিক্ষকও সেই সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ছেড়ে পুরো সিলেবাস হতে পড়াতে কমফোর্ট ফিল করেন না। শুনেছি ,একটি প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক এবারের চলমান বার্ষিক পরীক্ষায় প্রতিষ্ঠান বা বোর্ড কর্তৃক সিলেবাসে পরীক্ষা নিতে চান না।,তিনি সেই সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে ২/৩ টি অধ্যায় পরিক্ষা নিতে চান। কারণ, তারাও চান কম পড়িয়ে একটু আরামে শিক্ষা দিতে, শিক্ষা দেওয়ার চাইতে পাসের হার বাড়াতে, একটু ঘষামাজা দিয়ে হলেও নিজের উপর হতে দায়টা আদায় করতে। আর আদর্শ আর বিবেকবান শিক্ষক ছাড়া, দেশের কতিপয় কোচিংবাজ শিক্ষকদের মানসিকতা এমন যে, যদি তাদের হাতে প্রশ্নটা দেওয়া যায়, তাহলে আরো ভালো হত। কারন, সরকার কর্তৃক তদন্তে দেখা গেছে বিগত সকল একাডেমিক প্রশ্ন ফাঁসে এরাই জড়িত ছিলেন। তারাও চান, সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে কম পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের পকেট হতে টাকা টা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেদের হস্তগত করতে। এই যে আমরা ধোঁকাবাজি করে, একটা ধোঁকাবাজ জাতি তৈরি করছি, তারা যে আমাদেরকে ধোঁকা দিবে না, তার নিশ্চয়তা কি?
আগামী ২০২৩ সাল হতে পুর্বের পুরো সিলেবাস হতে পূর্ণ ৩ ঘন্টা, ১০০ নাম্বারের পরীক্ষা হবে। পরীক্ষার সময়, সিলেবাস, মানবন্টন,প্রশ্নের উত্তরের শর্তাবলী অনেক পরিবর্তন হবে। তখন পরীক্ষার ফলাফল তলানিতে যাওয়ার সমুহ সম্ভবনা আছে। সুতারাং যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এসএসসি বা সমমান পরিক্ষায় ভালো করেছেন অবশ্যই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য তবে এই ফলাফলে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে হবে না, আগামী দিনের প্রস্তুুতিতে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আর যারা ফলাফল খারাপ করেছেন তাদেরকে শিক্ষার্থীদের প্রতি আরো যতœশীল হতে হবে। সিলেবাস বা পরিক্ষা পদ্ধতির প্রতি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের অভ্যস্থ করতে হবে। শত ভাগ পাসের চেয়ে শত ভাগ ভালো ও যোগ্য মানুষ হতে, শত ভাগ এ+ চেয়ে শত গুন সুনাগরিক হতে আমাদের কে গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে এই শিক্ষা, জাতিকে ভালো কিছু উপহার দিতে পারবে না।
লেখক : কলামিস্ট, শিক্ষক।