পরিবেশ দূষণ ও টেকসই পরিকল্পনা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ ডিসেম্বর ২০২২, ৬:০৩:১০ অপরাহ্ন

হিমাংশু রায় হিমেল
জলবায় সংকটের কারণে আজ সারা বিশ্বে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ একটি দারিদ্র ও অধিক জন সংখ্যার দেশ। বাংলাদেশে ৩২ শতাংশ মৃত্যুর জন্য পরিবেশ দূষণ দায়ী। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে যেসব দুর্যোগ বাড়ছে, পরিবেশদূষণ তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ নিজস্ব সম্পদ দিয়ে এই পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে, কিন্তু জলবায়ুর বিপদ বেড়ে যাওয়ায় তা করা সম্ভব হচ্ছে না। দূষণে প্রতি এক লাখ শিশুর মধ্যে ১৬৯ জন অকালে মারা যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ বায়ু দূষণ। কারণ বাংলাদেশে প্রায় শতভাগ মানুষ বেশির ভাগ সময় দূষিত বায়ুর মধ্যে বাস করে। এছাড়া পানি দূষণের কারণে ডায়রিয়া, কলেরাসহ নানা ধরনের রোগ বাড়ছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মশাবাহিত ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার মতো রোগে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এসব রোগে আক্রান্ত হওয়াসহ নানা কারণে মানুষের মধ্যে উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্নতা বাড়ছে। গত সপ্তাহে বিশ^ ব্যাংক থেকে প্রকাশ করা কান্ট্রি ক্লাইমেট ও ডেভেল-পয়েন্ট শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এত বলা হয়, আর্থিক হিসাবে এসব মৃত্যুর ক্ষতির পরিমাণ ৪ লাখ ৪০ হজার কোটি টাকা। এর বাইরে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার কারণে বাংলাদেশে অনেক মানুষের মৃত্যু ও সম্পদের ক্ষতি হয়। জলবায়ুর এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের বছরে ১ হাজার ২৫০ কোটি ডলার দরকার হবে। যার সংস্থান করা দেশটির একার পক্ষে সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বেসরকারি খাতকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিবেদনের মূল বিষয় বস্তু তুলে ধরেন বিশ^ ব্যাংকের দক্ষিণ এয়িার বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার। বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুর সংখ্যা ১০০ শতাংশ কমিয়ে এনেছে। এখান থেকে বিশে^র অনেক দেশের শেখার আছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের পক্ষে এই পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। কান্ট্রিক্লাইমেট ডেভেলপমেন্টের প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশের বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাকে অগ্রাধিকার, আর্ন্তজাতিক তহবিল থেকে অর্থসংগ্রহের চেষ্টা, কার্বন কর আরোপ এবং বেসরকারি খাতকে এক্ষেত্রে বিনিয়োগ বড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। তাঁরা বলেন, এটা না হলে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দরিদ্র মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর ডেনডেন চ্যান বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে বাংলাদেশের ২০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া ১০ হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছেন ৩৫ জন। তবে বাংলাদেশের খুব দ্রুত ১০ লাখ মানুষকে সাত হাজার ঘুর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ কমে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘূর্নিঝড়ের কারণে দেশে বছরে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ক্ষতি হচ্ছে। যেভাবে ঘূর্ণিঝরের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে এই ক্ষতি আরও বাড়তে পারে। বায়ুদূষণে জিডিপির ৮ শতাংশ নষ্ট হচ্ছে। যেভাবে ঘূর্নিঝড়ের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে এই ক্ষতি আরও বাড়তে পারে। বায়ুদূষণে জিডিপির ৮ শতাংশ নষ্ট হচ্ছে। সামাগ্রিক ভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়বে। এছাড়া ২০৫০ সালের মধ্যে কৃষি খাতে জিডিপি এক তৃতীয়াংশ আর বন্যার কারণে কমবে ৯ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস ও বৃষ্টিপাত ৪ শতাংশ বাড়লে উপকূলে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা ২৭ সেন্টিমিটার বা এর বেশি বাড়তে পারে। এতে উপকূলে সম্পদহানি দ্বিগুণ হতে পারে। যা বছরে ৩০ কোটি ডলারের সমপরিমান। এছাড়া খাওয়ার পানি, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য খাত ঝুঁকিতে পড়বে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের চারটি অঞ্চল বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে। অঞ্চলগুলো বরেন্দ্র এলাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, উপকূল ও হাওর এলাকা। জেলা হিসেবে ধরলে হাওরের ময়মনসিংহ জেলার পশ্চিমাংশ, রংপুরের পূর্বাঞ্চল এবং খুলনার দক্ষিণাংশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে আছে। নিয়মিত ভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, এমন এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের তাই এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার সার্মথ্য বাড়াতে হবে।
পরিবেশ দূষণের বিষয়টি এতটাই ভয়াবহ যে এর হাত থেকে রাষ্ট্র ও সমাজের কেউ রেহাই পায়না। আবার এই দূষণ সব সময় রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যেও থাকেনা, গোটা অঞ্চল তথা সারা বিশে^ ছড়িয়ে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অঞ্চল তথা সারা বিশে^র ছড়িয়ে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দরিদ্র দেশ গুলোর মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, যদিও এতে তাদের ভূমিকা সবচেয়ে কম। বিশ^ ব্যাংকের প্রতিবেদনের উদ্বেগজনক তথ্য হলো, পরিবেশদূষণ আমাদের উন্নয়নের গতিও থামিয়ে দিয়েছে। ঘূণিঝড়ের কারণে প্রতিবছর ১০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয় এবং পরিবেশ দূষণের জিডিপির ৮ শতাংশ খোয়া যায়। এই সর্বনাশের বিরুদ্ধে সরকার টেকসই কোনো পদেক্ষপ নিতে পেরেছে, তা দৃশ্যমান নয়। একসময় ঢাকা শহর থেকে পরিবেশ দূষণকারী পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। হালে দূর্দান্ত প্রতাপে তা ফিরে এসেছে। পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের সব উন্নয়ন হতে হবে পরিবেশ সহায়ক। উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক সম্পদ তথা বন, নদী, জলাভূমি, সৈকত ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না। শিল্পকারখানা করার ক্ষেত্রে পরিবেশ আইন শতভাগ মেনে চলতে হবে। আইন অমান্য কারীরা যত ক্ষমতাবানই হোক, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক : পরিবেশ কর্মী