খাদ্য সমস্যা ও শব্দদূষণ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ ডিসেম্বর ২০২২, ৬:০৪:৫২ অপরাহ্ন
রফিকুর রহমান লজু
পৃথিবী ভালো নেই। বিশ্বে শান্তি নেই। যুদ্ধ, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, খাদ্যাভাব, রোগবালাই পৃথিবীকে অস্থির-অশান্ত করে রেখেছে। বিশ্বের ৮০০ কোটি মানুষ পৃথিবীর দেশে দেশে শান্তির অন্বেষণে ব্যাপৃত আছেন। সমস্যা সংকুল বিশ্ব নয়, মানবিক বিশ্বের প্রত্যাশা সকলের। সত্য, সুন্দর কল্যাণ এবং ন্যায়-নীতির এক সুস্থ পৃথিবীর প্রত্যাশা পৃথিবীর সকল মানুষের। এরকম এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছে বিশ্ববাসী।
বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সতর্কবার্তা আছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্য সংকটজনিত কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। দুনিয়া ব্যাপী দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যাভাব সামাল দেওয়া খুবই কঠিন।
পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষের মধ্যে ৩০০ কোটি মানুষের সুষম খাবার যোগাড়ের সামর্থ নেই। এর অর্থ এই মানুষগুলো দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে, ক্ষুধার জ্বালায় কষ্ট পাচ্ছে, দুর্ভিক্ষের অশনি সংকেত শুনতে পাচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে প্রদত্ত এক বার্তায় জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এই মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আমরা কঠিন সময় পার করছি। গত তিন বছরে বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘বিশ্বে প্রায় ১০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির মধ্যে দিন যাপন করছে, যেখানে অনাহার এবং মৃত্যু প্রতিদিনকার বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে।’ কোভিড-১৯ মহামারি, জলবায়ু সংকট, পরিবেশ বিপর্যয়, সংঘাত এবং ক্রমবর্ধমান অসমতার কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষগুলো আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ খাদ্য, সার ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে। মহাসচিব গুতেরেস আরও বলেছেন, ‘এ বছর আমাদের এই বিশ্বে সবার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য রয়েছে। কিন্তু আগামী বছরের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনে কৃষকের জরুরি ভিত্তিতে সুলভমূল্যে সার দরকার।’ তাই এ বছরের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘কাউকে পিছনে ফেলে রাখা যাবে না, অধিক উৎপাদন, অধিক পুষ্টি, আরও ভালো পরিবেশ এবং আরও ভালো জীবন।’
শব্দদূষণ শহরবাসীর আর এক সমস্যা। ব্যস্ত রাস্তায় বা যানজটে যানবাহনের বিশেষ করে মোটর সাইকেল ও সিএনজি’র হর্ণ মারাত্মক শব্দদূষণের সৃষ্টি করে। মোটর সাইকেল আরোহীরা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে হর্ণ বাজিয়ে রাস্তার পাশের দোকান ও ভাসমান হকারদের নাভিশ্বাস তুলেন।
শব্দদূষণ আসলেই একধরনের শব্দ সন্ত্রাস। মান-ইজ্জতের ভয়ে সন্ত্রাসীদের যেমন কিছু বলা যায় না, নিরবে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সহ্য করতে হয়, তাদের উৎপাত সহ্য করতে, তেমনি শব্দদূষণের জ্বালাও সইতে হয়।
এক তথ্য জরিপে জানা যায়, সিলেটে শব্দদূষণে আক্রান্তদের মধ্যে ৩১ শতাংশ পেশাজীবী। ঢাকা ও সিলেটসহ সবকটি সিটি কর্পোরেশনে প্রায় ৪২ ভাগ রিকশাচালকই এই শব্দদূষণের শিকার। বিশ্বের প্রায় ৪৩২ মিলিয়ন বা ৪৩ কোটি ২০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পেশাগত কারণে শব্দদূষণের শিকার। শুধু সড়কেই নয়, আবাসিক এলাকা বা নীরব এলাকা হিসেবে স্বীকৃত হাসপাতাল এলাকায়ও রাত-দিন উচ্চ শব্দে বাজছে গাড়ির হর্ণ। নির্মাণ কাজ, গ্রিল-টাইলস, কাটা, মেশিনে ইট ভাঙা, মাইক, জেনারেটরের শব্দে ঘরের মধ্যেই টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। ক্রমেই শব্দের মাত্রা বেড়ে চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অতিরিক্ত শব্দদূষণ শুধু শ্রবণশক্তিই নষ্ট করে দিচ্ছে না, বাড়িয়ে তুলছে হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি ও মানসিক রোগসহ নানা শারীরিক ও মানসিক জটিলতা। এর ফলে কমে যায় সন্তান জন্মদানের ক্ষমতাও, লোপ পায় মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতাও। লেখাপড়ায় শিশুদের মনোযোগ ও মেধা হ্রাস পায়। শব্দদূষণ উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। শব্দদূষণে প্রথম আক্রান্ত হয় কান বা শ্রবণশক্তি। অতিরিক্ত শব্দ মানসিক রোগের উৎস হিসেবে কাজ করে।
দেশজুড়েই শব্দদূষণ এক নীরব ঘাতক। শুধু যানবাহনের হর্ণ নয়, বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ কাজের মিক্সার মেশিন, মাইকে দৌরাত্ম্য কিংবা কলকারখানার আওয়াজ থেকে সৃষ্টি হচ্ছে অসহনীয় শব্দদূষণ। বিয়ে, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানসহ নানা সামাজিক-রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে উচ্চ শব্দে মাইকে গান বাজানো একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতারা, ছাত্রনেতারা উপস্থিত থাকেন। মজার ব্যাপার যে, তাদের বাড়ির অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গান বাজানো হয়। রাতে মাইকের আওয়াজে ঘুমের ব্যাঘাত হয়। ছাত্রদের পড়ায় অসুবিধার সৃষ্টি হয়।
দেশে প্রচলিত আছে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আইন অমান্য করলে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান আছে। এছাড়া, মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ১৩৯ এবং ১৪০ নম্বর ধারায় নিষিদ্ধ হর্ণ ব্যবহার ও আদেশ অমান্য করার শাস্তি হিসেবে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থ দণ্ডের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশ হাইকোর্ট ২০০২ সালের এক আদেশে সব প্রকার যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ণ ও বিরক্তিকর হর্ণ ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। সরকারি বিধিমালায় আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবল। হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবল শব্দমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
জীবনে সমাজে সমস্যা আছে, সমস্যা থাকবে। খাদ্য সমস্যা থাকবে। রোগ জরা থাকবে। এরকম হাজারো সংকট থাকবে। সকল সংকটের মূলে নৈতিকতাবোধের চরম অবক্ষয় ও মনুষ্যত্বের পরাজয়। মানুষের মর্যাদা ও মূল্য মারাত্মকভাবে অবহেলিত। নৈতিক ও মানবিক সংকটাবস্থা সমগ্র বিশ্ব পরিস্থিতির বেলায়ই প্রযোজ্য। বিপুল বিত্তের মধ্যে সর্বত্র দেখা দিয়েছে চিত্তের এক মহাশূন্যতা। নৈতিক-মানবিক দিক থেকে মানুষ ক্রমান্বয়ে হতে চলেছে নিঃস্ব। নীতি-নৈতিকতার কোন বালাই নেই। তা সত্ত্বেও মানবতার জন্য লড়তে হবে, মানবতার জয়গান গাইতে হবে। দার্শনিকেরা যুগে যুগে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ সাধন এবং নৈতিকতার প্রেরণায় মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন। মানবতার স্থায়ী কল্যাণ, শান্তি ও প্রগতির সংকীর্ণ স্বার্থ এবং অন্ধ প্রবৃত্তির বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছেন।
যত অসুবিধা থাকুক, প্রতিবন্ধকতা থাকুক আমাদের সত্য, সুন্দর ন্যায়ের দিকেই আগাতে হবে, পৃথিবীকে সুন্দর করতে হবে, মানবিক বিশ্বের আরাধনা করতে হবে। বিশ্ব দর্শন দিবসে এরকম এক মানবিক বিশ্বের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন দর্শনশাস্ত্রের শিক্ষক প্রফেসর আবুল কালাম আজাদ। দার্শনিকরা সর্বদা সত্য-সুন্দর-কল্যাণ এবং ন্যায়নীতির অনুসন্ধান ও অনুশীলন করেছেন আজীবন। মহামতি সক্রেটিস, ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্রে, বাট্রন্ড রাসেল, বাংলাদেশের দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব প্রমুখের মানবিক বিশ্বের প্রত্যাশা ছিল।
সূত্র ও সহায়তা
১. সুষম খাবারের সামর্থ নেই ৩০০ কোটি মানুষের : জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস, বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৭.১০.২০২২
২. মানবিক বিশ্বের প্রত্যাশা : প্রফেসর আবুল কালাম আজাদ, সিলেটের ডাক ১৭ নভেম্বর, ২০২২
লেখক: কলামিস্ট ও প্রাক্তন শিক্ষক