বিশ্বনাথে কার্তিক মিস্ত্রির ‘রসু খাঁ’ কু-কীর্তি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ ডিসেম্বর ২০২২, ৫:৩৩:০৭ অপরাহ্ন
৪ বছরের শিশুকে নির্যাতনের পর হত্যা সিআইডি’র তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য
আদালতে স্বীকারোক্তি
কাউসার চৌধুরী:
ধর্ষণের পরই হত্যা। ক্রমিক আকারে ঘটছিল ঘটনা। ধরা পড়ার পর প্রকাশ হয় সিরিয়াল কিলার হিসেবে। চাঁদপুরের সেই ‘রসু খাঁ’ কু-কীর্তি এখনো ভুলেনি মানুষ। সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায় কার্তিক চন্দ্র মিস্ত্রি ওরফে চানসি বাবুর (৬৫) কু-কীর্তি যেন মনে করিয়ে দিল রসু খাঁকে। রসু খাঁর অপরাধ-চরিত্রের কার্তিক মিস্ত্রিকে পাকড়াও করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
প্রায় সাড়ে ৩ বছর আগে চার বছরের এক শিশু কন্যাকে ধর্ষণের পর গলাটিপে হত্যা করেছিল কার্তিক মিস্ত্রি। আদালতে পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সে নিজেই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। উন্মোচন হয় বিশ্বনাথে কার্তিক মিস্ত্রির ‘রসু খা’ কু-কীর্তি। এতে হতবাক খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও।
কার্তিক চন্দ্র মিস্ত্রি ওরফে চানসি বাবু বরিশালের গৌরনদী উপজেলার আধুনা গ্রামের মৃত জগবন্ধু মিস্ত্রির পুত্র। সে স্বপরিবারে বিশ্বনাথ উপজেলার সিঙ্গেরকাছ বাজারে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে।
সিআইডি সিলেট জোনের পুলিশ পরিদর্শক আশরাফ উজ্জামান সিলেটের ডাককে এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, সে শিশুটিকে ধর্ষণ করে গলাটিপে হত্যা করে। অসংখ্য নারীর জীবন নষ্ট করেছে। ফার্মেসীর আড়ালে সে এসব কু-কর্ম বছরের পর বছর ধরে চালিয়ে আসছিল। শিশুকে হত্যার পর লাশ গুম করে রাখে। তদন্তে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। স্থানীয় পুলিশকে অনেক মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য নারীকে ধর্ষণের প্রমাণ মিলেছে। বিষয়গুলো সিআইডি তদন্ত করছে।
ধর্ষণ করতে শিশুকে গলা টিপে হত্যা
আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে কার্তিক চন্দ্র মিস্ত্রি ওরফে চানসি বাবু জানায়, ৪ বছরের ওই শিশু কন্যা ঘুম থেকে উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। এ সময় তাকে ধরে একটি রুমে নিয়ে যাই। তখনই মাথায় খারাপ চিন্তা চলে আসে। তার সাথে শারীরিক সম্পর্কের চেষ্টা করলে সে চিৎকার দিতে গেলে তার নাকে-মুখে হাত দিয়ে চাপ দিয়ে ধরে রাখি। তাকে ধর্ষণ করতে গেলে সে আরও জোরে চিৎকার করে। আমি তখন আরো জোরে তার নাক মুখ চেপে ধরি। একসময় তার শ্বাস বন্ধ হয়ে শরীর ছেড়ে দেয়। তখন বুঝতে পারি যে মেয়েটি মারা গেছে। পরে বারান্দা থেকে নাইলনের রশি এবং পুরাতন জামা (মেয়েদের কামিজ জাতীয়) এনে তার গলায় বেঁধে একটি রান্নাঘরের রুমে দেয়ালে থাকা লোহার রডের সাথে ঝুলিয়ে রাখি। আমি কেয়ারটেকার হওয়ার কারণে মার্কেটের ভাড়াটিয়াদের বাসাভাড়া সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখভাল করতাম। ঘটনার সপ্তাহ খানেক আগে যে রুমে তাকে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম ওই রুমের ভাড়াটিয়া চলে যায়। তাই বাসাটি খালি ছিল। পরে ওই রুমে ঝুলিয়ে রেখে আমার দোকানের পাশের পানের দোকানদার থেকে একটি পুরাতন তালা এনে খালি বাসায় তালা মেরে দেই যেন কেউ বুঝতে না পারে যে ওই রুমে মেয়েটি আছে।
সাইনবোর্ডের আড়ালে অপকর্ম
সাইনবোর্ডে লেখা ঔষধের দোকান বা ফার্মেসী। আছে কিছু হারবাল জাতীয় ও সামান্য এলোপ্যাথিক মেডিসিন। নাম সর্বস্ব এই ফার্মেসী দিয়েই আছেন দীর্ঘদিন ধরে। পরিচিত পেয়েছেন চাঁদসি ডাক্তার হিসেবে। প্রায় ৪০ বছর আগে বরিশালের কার্তিক চন্দ্র মিস্ত্রি ওরফে চানসি বাবু বিশ্বনাথ উপজেলায় বসবাস শুরু করে। সিঙ্গেরকাছ বাজারে এক লন্ডন প্রবাসীর মালিকানাধীন মতলিব মার্কেট নামক মার্কেটের কেয়ারটেকার হিসেবে প্রায় ১২ বছর ধরে কাজ করছিল কার্তিক। এখানেই রমরমা চলছিল তার সাইনবোর্ড সর্বস্ব ফার্মেসি ব্যবসা। ওই মার্কেটেই বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতো নিহত শিশু কন্যার দরিদ্র পরিবার।
স্বীকারোক্তিতে কার্তিক জানায়, আমি বাচ্চা ডেলিভারির কাজ করতাম। আমার দোকান থেকে মেডিসিন দিতাম আর ধাত্রী মহিলা প্রসব কাজ সম্পূর্ণ করতো। তবে, সাইনবোর্ডের আড়ালে নানা অপকর্মও চালিয়ে আসছিল কার্তিক ।
কু-কীর্তিতে আরেক রসু খা
সিআইডি সূত্র জানায়, কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই সে ডেলিভারি কাজে ধাত্রী নিয়ে গ্রামে গ্রামে ছুটে যেতো। স্বাভাবিক হলে বলত, ঠিক আছে আর একটু সমস্যা হলেই সিলেটের কোনো হসপিটাল বা ক্লিনিকে পাঠিয়ে দিত। ফার্মেসিতে মূলত গর্ভপাত করানোই ছিল তার মূল কাজ। নাম সর্বস্ব ফার্মেসির ভেতরে আরেকটি কক্ষ ছিল। তাতে সাজানো পরিপাটি বিছানাও ছিল। এখানে আসা নারীদের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে নারীদের ধর্ষণ করতো। এ পর্যন্ত তার নিকট অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে সিআইডি নিশ্চিত হয়েছে। ধর্ষণের পর কোনো নারীকে হত্যা না করলেও এবার চার বছরের শিশু কন্যাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে।
সিআইডি বলছে, এ হচ্ছে আরেক ‘রসু খা’। তদন্তে এমন চিত্রই মিলেছে। গ্রেফতারের পর তার নোটবুকে বিভিন্ন ধাত্রী মহিলার মোবাইল নম্বর পাওয়া গেছে। কার্তিক চন্দ্র মিস্ত্রি ওরফে চানসি বাবু স্ত্রী-সন্তানদেরকে সাথে নিয়ে সিঙ্গেরকাছ বাজারে ঘটনাস্থল থেকে একটু দূরে একটি বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করতেন। তিনি ৫ কন্যা সন্তানের জনক। তার ৩ কন্যা মাস্টার্স পাশ করেছেন। আরেক কন্যা মাস্টার্স পরীক্ষার্থী এবং অপর কন্যা নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত বলে জানা গেছে।
অবশেষে সিআইডির জালে বন্দি
শিশু কন্যার লাশ উদ্ধারের পর প্রথমে বিশ্বনাথ থানা পুলিশ মামলার তদন্ত করে। মামলার সাক্ষী হিসেবে কার্তিক চন্দ্র মিস্ত্রি ওরফে চানসি বাবু পুলিশের নিকট ১৬১ ধারায় জবানবন্দিও দেয়। এরপর সিআইডির নিকটও একইভাবে বক্তব্য দেয়। সিআইডির পরিদর্শক আশরাফ উজ্জমানের তদন্তেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। প্রথমে সিআইডির এ তদন্ত কর্মকর্তাকেও নানাভাবে বুঝানোর চেষ্টা চালায়।
কার্তিক জানায়, ঘটনার সময় সে সিলেট শহরে তার মেয়ের বাসায় ছিল। পরে ঘটনাটি সে শুনেছে। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া যায়, ঘটনার সময় সে ঘটনাস্থলেই ছিল। ঘটনার পর তার আপন ভাই পরিমল ও ভাতিজা তপনসহ বিভিন্নজনকে ফোন করে কথা বলেছে। স্বাভাবিকভাবে এত সকালে তার ফোন থেকে কারও সাথে কল করার নজির না থাকলেও কেবলমাত্র ঘটনার দিন এভাবে কথা বলেছে। এরপর সিআইডি তাকে ধরতে জাল ফেলে। বয়স্ক হওয়ার পরেও নারীদের সাথে সখ্যতার বিষয় নিয়ে অগ্রসর হয় সিআইডি। এরপর নিশ্চিত হওয়ার পরপরই গত ২৭ নভেম্বর রোববার বিকেলে সিঙ্গেরকাছ বাজার থেকে তাকে গ্রেফতার করে সিআইডি। গ্রেফতারের পর প্রথমে ঘটনা অস্বীকার করে। এরপর সিআইডির হাতে থাকা তথ্য প্রযুক্তিসহ প্রমানাদি তাকে দেখানোর পর সে অকপটে ঘটনার বর্ণনা দিতে থাকে। পরদিন সোমবার ধর্ষণের পর শিশুকে হত্যার বর্ননা দিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
সিলেটের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টেট মো. আলমগীর হোসেন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
প্রসঙ্গত, সিঙ্গেরকাছ বাজারে এক দরিদ্র ভ্যানচালক স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস করতেন। ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল সকালে ভানচালকের স্ত্রী ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার ৪ বছরের শিশু কন্যাটি ঘরের মধ্যে নেই। চঞ্চল শিশু কন্যাটি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দরজার সামনে খেলাধুলা করত। কিন্তু ওই দিন সকালে সে ঘুম থেকে উঠলেও তার আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিলনা। পরে পার্শ্ববর্তী একটি খালি রুমে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় শিশুর দাদা বাদী হয়ে বিশ্বনাথ থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর-০১। তারিখ -০২/০৫/২০১৯। ময়নাতদন্তে তাকে ধর্ষণের পর হত্যার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করলেও ওই বছরের ডিসেম্বরে মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়েছিল।