চা শিল্পের উন্নয়ন : বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ ডিসেম্বর ২০২২, ৫:৫১:৫১ অপরাহ্ন
মো. দিলওয়ার হোসেন বাবর
বাংলাদেশের কৃষি সেক্টরের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্য হচ্ছে চা। এই চা বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। চা রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। বিশ্বের বড় ১০টি চা বাগান রয়েছে আমাদের এই বাংলাদেশে। সুদূর অতীতকাল থেকেই আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, আমদানি বিকল্প দ্রব্য উৎপাদন এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাস করণে চা শিল্পের ভূমিকা অপরিসীম। দেশের জিডিপিতে চা শিল্পের অবদান শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ।
চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ১৬৭টি চা বাগান রয়েছে। এই ১৬৭টি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯১টি, হবিগঞ্জে ২৫টি, সিলেটে ১৯টি বাগান রয়েছে। তাছাড়াও চট্টগ্রামে ২২টি, রাঙামাটিতে ২টি এবং ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি চা বাগান রয়েছে। বাংলাদেশে চায়ের মোট ভূমির পরিমাণ ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪২২ দশমিক ৬৯ হেক্টর। চা বাগানে মোট চাষযোগ্য ভূমির পরিমাণ ১ লাখ ১৮৩ হাজার ৫৯৪ দশমিক ৪৩ একর। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, চা বাগানের মোট শ্রমিকের পরিমাণ ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯৭ জন। এদের মধ্যে অধিকাংশই নারী শ্রমিক।
চা বাংলাদেশের একটি অতিপুরাতন ও ঐতিহ্যবাহী শিল্প। এই চা শিল্পের সাথে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের চা শিল্প ও চায়ের সাথে জড়িত শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ সালের ৪ জুন প্রথম বাঙালি হিসেবে তৎকালীন চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে যোগদান করে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে সম্মানিত করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে বাংলাদেশের চা শিল্পের অসামান্য ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ সালের ৪ জুন থেকে ১৯৫৮ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে তৎকালীন সময়ের চা বোর্ডের উন্নয়নের পাশাপাশি চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন করে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন প্রকার যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু তৎকালীন সময়ে চা বোর্ডের নিজস্ব ভবন নির্মাণের জন্য ঢাকা শহরের মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় শূন্য দশমিক ৩৭১২ একর জমির ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধুর তত্ত্বাবধানে ও ব্যবস্থাপনায় উক্ত জমিতে চা বোর্ডের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়।
বঙ্গবন্ধু তাঁর সময়ে ১৯৫৭ সালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে টি রিচার্স স্টেশনের গবেষণা কার্যক্রম আরও জোরদার করে উচ্চ ফলনশীল জাতের (কেল) চা গাছ উদ্ভাবনের নির্দেশনা প্রদান করেন। চা এর উচ্চ কলম নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রথমে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এবং চায়ের রাজ্যখ্যাত সবুজ শ্যামলে ঘেরা শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া চা বাগানে উচ্চফলনশীল জাতের চারা রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু তৎকালীন টিএ্যাক্ট ১৯৫০ সংশোধনের মাধ্যমে চা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড (সিপিএফ) চালু করেন, যা এখনও চালু আছে এবং চা বোর্ডের কর্মকর্তা কর্মচারীরা এর সুফল ভোগ করছে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সৈনিকদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের ফলে আমাদের চা বাগানগুলো প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা পরবর্তীকালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই আমাদের এই ধ্বংসপ্রাপ্ত চা বাগানগুলোর দিকে নজর দেন। তিনি মৃতপ্রায় বাংলাদেশের লাভজনক ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্পটিকে আবার পুনরুজ্জিবীত করে লাভজনক ও টেকসই খাতের উপর দাড় করানোর জন্য সময়োপযোগী ও বাস্তবভিত্তিক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু এই উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে প্রথমেই স্বাধীন বাংলাদেশে ‘বাংলাদেশ টি ইন্ডাষ্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ (ইঞওগঈ) গঠন করেন। এর আওতায় তিনি যুদ্ধোত্তর মালিকানা বিহীন চা বাগানগুলোকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এক সূত্রে জানা যায়, তিনি তৎকালীন সময়ে ৩৯টি চা বাগান পুনর্বাসনের আওতায় নিয়ে আসেন এবং ১৯৭৫ সালের মধ্যে পরিত্যক্ত ৮টি চা বাগান মালিকদের মধ্যে হস্তান্তর করেন।
তৎকালীন সময়ে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে উন্নয়ন ও পুনর্বাসনমূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না। এর পরেও বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন উৎস হতে অর্থ সংগ্রহ করে জরুরি ভিত্তিতে দেশের চা বাগানগুলোকে কার্যকর করে চা শিল্পকে পুনর্গঠন করেছিলেন। চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু দেশের ধ্বংসপ্রাপ্ত চা বাগানগুলোকে পুনর্বাসনের জন্য ১৯৭২ সালে ‘ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ থেকে ৩০ লাখ ভারতীয় রূপী ঋণ এনে চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানি করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু পুনর্বাসন কার্যক্রম শেষ করে চা শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যও তৎকালীন সময়ে নানামুখী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। চা শিল্পকে তখন টিকিয়ে রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭২-৭৪ সাল পর্যন্ত উৎপাদনকারীদের জন্য নগদ ভর্তুকির ব্যবস্থা করেছিলেন। তাছাড়াও তিনি চা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ভর্তুকিমূলে চা বাগানগুলোতে সার সরবরাহের ব্যবস্থাও করেছিলেন, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। তিনি শ্রমিকদের শ্রমকল্যাণ নিশ্চিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার শাসন আমলে চা শ্রমিকদের বাসস্থান প্রদান, সুপেয় পানির ব্যবস্থাকরণ, বেবী কেয়ার সেন্টার তৈরি, প্রাথমিক শিক্ষা, রেশন প্রদান ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের চা মালিকদের ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা সংরক্ষণের বিষয়ে অনুমতি প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু চা শিল্পের কার্যক্রম আরও শক্তিশালী যুগোপযোগী করণের নিমিত্তে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ টি রিচার্স স্টেশনকে বাংলাদেশ টি রিচার্স ইনস্টিটিউটে পরিণত করেন। বর্তমানে যা ‘বিটিআরআই’ নামে পরিচিত।
পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরি ও তারই তনয়া আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশের চা শিল্পের উন্নয়নের পাশাপাশি চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করে এই দেশের মূল জনস্রোতের সাথে তাদেরকে একত্রিভূত করার জন্য নানামুখী পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যার কার্যক্রম এখনও অব্যাহত আছে এবং চা শ্রমিকরা তার সুফল ভোগ করছে।
দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ক্রমাগত নগরায়ন জনগণের শহরমুখীতা, গ্রাম পর্যায়ে শহরের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি গ্রামীণ মানুষের রুচি ও অভ্যাসের পরিবর্তন, তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ইত্যাদির কারণে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্তবতার আলোকে চায়ের গুণগত মান বৃদ্ধি ও নতুন নতুন জায়গা চা চাষের আওতায় এনে চায়ের মোট উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এই উদ্দেশ্যে সমগ্র বাংলাদেশ চা আবাদের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর, লালমনির হাট, জামালপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় মোট ১০,১৭২ হেক্টর ক্ষুদ্রায়তনের চাষযোগ্য জমি চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে এই প্রকল্পের আওতায় ২০০০ সালে উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়ের তেতুলিয়ায় ২০০৫ সালে, পার্বত্যচট্টগ্রামে ২০০৭ সালে, ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী ও লালমনির হাটের হাতিয়াবান্দায়, ২০১৪ সালে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে ও দিনাজপুরের বীরগঞ্জে ক্ষুদ্র পর্যায়ে চায়ের চাষ শুরু হয়।
বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের আন্তরিকতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রয়োজনীয় নীতি ও কৌশল প্রণয়ন, সর্বোপরি তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের ফলে দেশের উত্তর জনপদের পঞ্চগড়ে চা চাষ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। চট্টগ্রাম ও সিলেটের পরে পঞ্চগড় দেশের অন্যতম চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ১৯৯৯ সালে উত্তরবঙ্গে চা চাষের পরিকল্পনা করা হয়। পরবর্তীতে ২০০০ সালে সেখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চায়ের চাষ শুরু হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর হতেই মূলত চা শিল্পের উন্নয়ন, চায়ের গুণগত মানের পরিবর্তন এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। বর্তমান সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ও ধারাবাহিক রাষ্ট্র পরিচালনায় চা শিল্পের উন্নয়নে গতি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। বর্তমানে চায়ের উৎপাদন ৩১.৩৮ মিলিয়ন কেজি থেকে বেড়ে ৬৭ মিলিয়ন কেজিতে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে ২০১২ সালে যেখানে চা উৎপাদন হয়েছিল ৬২ দশমিক ৫২ মিলিয়ন কেজি, সেখানে ২০২১ সালে রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হয় ৯৬ দশমিক ৫১ মিলিয়ন কেজি।
বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের চায়ের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। সূত্র মতে, বর্তমান বিশ্বে ২৩টি দেশে বাংলাদেশের চা রপ্তানি হয়ে থাকে। গত পাঁচ বৎসরে দেশ থেকে মোট ১৫০ কোটি ২৪ লাখ ৭০০ কোটি টাকার চা বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। এই সময় দেশ থেকে গড়ে চা রপ্তানি হয় ২২ কোটি ৫৬ লাখ টাকার। এতে বাড়ছে রপ্তানি আয় এবং সমৃদ্ধ হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি।
বর্তমান সরকার চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য ইতোমধ্যে ১৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছে। বিভিন্ন এনজিও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকার শিশুদের শতভাগ ভর্তির উপর জোর দিচ্ছে। চা শ্রমিক ও তাদের সন্তানদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সরকার একটি রোড ম্যাপও প্রণয়ন করেছে এবং সেই অনুপাতে কাজ করছে। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় ৫০ হাজার শ্রমিককে বছরে ৫ হাজার টাকা করে ভাতা দিচ্ছে। তাছাড়া সরকার তাদের প্রতি মাসে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, স্বামী নিগৃহীত ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও শিক্ষা উপবৃত্তিও দিচ্ছে। সম্প্রতি চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরী ১২০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা করা হয়েছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদেরকে তৈরি ঘর দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি করেছেন। আশা করি এতে চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত হবে, চা শিল্পের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটবে এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।