ন্যায়পরায়ণ শাসকের মর্যাদা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ ডিসেম্বর ২০২২, ৭:১৫:১৪ অপরাহ্ন
মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
মহান আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা কর্তৃত্বশীল বা শাসক তাদের আনুগত্য কর’ (সূরা নিসা: আয়াত-৫৯)। উক্ত আয়াতে শাসকের আনুগত্য করাকে নাগরিকের জন্য ফরজ ঘোষণা করা হয়েছে। শাসকের আনুগত্য জনগণের উপর অপরিহার্য ঘোষণা করে হযরত আবু হুরায়রা (রা:) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল সে যেন আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি আমার নাফরমানী করল, বস্তুত সে আল্লাহর নাফরমানী করল। আর যে ব্যক্তি আমীর বা শাসকের আনুগত্য করল, সে আমারই আনুগত্য করল। প্রকৃতপক্ষে ইমাম বা শাসক হলেন ঢালস্বরূপ, তাঁর পশ্চাতে থেকে যুদ্ধ করা হয় এবং তাঁর দ্বারা নিরাপদে থাকা যায়। সুতরাং যে শাসক আল্লাহর প্রতি ভয়ভীতি রেখে তাঁর বিধান মোতাবেক শাসন চালায় এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে এর বিনিময়ে সে প্রতিদান লাভ করবে। কিন্তু যদি সে আল্লাহর বিধানের বিপরীত কোন কাজ করে তাহলে তার গুনাহ ও সাজা তার উপর বর্তাবে (বুখারী ও মুসলিম)। শাসকের আনুগত্য করা নাগরিকের উপর ফরজ ঘোষণা করে হযরত উম্মুল হুসাইন (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, যদি কোন বিকলাঙ্গ কুৎসিত ক্রীতদাসকেও তোমাদের শাসক নিযুক্ত করা হয় এবং সে তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী শাসন করে, তবে তোমরা অবশ্যই তার আদেশ-নিষেধ মেনে চল এবং তার আনুগত্য কর’ (মুসলিম ২য় খন্ড: পৃষ্ঠা-১২৫, মিশকাত শরীফ : পৃষ্ঠা- ৩১৯)।
একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক আল্লাহর অতি প্রিয় বান্দাহ। ইসলামের দৃষ্টিতে একজন ন্যায়পরায়ণ শাসকের মর্যাদা অতি উর্ধ্বে। ন্যায়পরায়ণ শাসকের সুমহান মর্যাদা সম্পর্কে অগণিত হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কিত কয়েকখানা হাদীস নিম্নে উপস্থাপন করা হল :
(১) হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (স.) ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন ন্যায়পরায়ণ শাসকই হবেন আল্লাহর কাছে সমস্ত লোকের চেয়ে প্রিয়তম এবং তাঁর নিকটতম মর্যাদার অধিকারী। আবার কিয়ামতের দিন অত্যাচারী ও জালিম শাসকই হবে আল্লাহর কাছে সমস্ত মানুষের চেয়ে ঘৃণিত ও কঠোরতম আজাবের অধিকারী’ (তিরমিজী)। (২) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) ইরশাদ করেন, ‘ন্যায়পরায়ণ শাসক বা বিচারক আল্লাহর কাছে তাঁর ডান পার্শ্বে নূরের নিম্বরের উপর অবস্থান করবে। অবশ্য আল্লাহতায়ালার উভয় পার্শ্বই ডান। তারাই সে সমস্ত শাসক বা বিচারক, যারা নিজেদের বিচার-বিধানে, নিজেদের পরিবার পরিজনে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ইনসাফ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে’ (মুসলিম)। (৩) হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন সহনশীল ন্যায়পরায়ণ শাসকই হবেন আল্লাহর কাছে সমস্ত বান্দার চেয়ে উত্তম মর্যাদার অধিকারী। আর কিয়ামতের দিন নিষ্ঠুর অত্যাচারী শাসকের স্থান হবে আল্লাহর কাছে সমস্ত মানুষের চেয়ে নিকৃষ্ট’ (মিশকাত শরীফ : পৃষ্ঠা-৩২৩)। (৪) হযরত আয়শা (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা কি অবগত আছ যে, কিয়ামতের দিন সকলের আগে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর আরশের ছায়ায় কোন শ্রেণির লোকেরা স্থান পাবে? সাহাবাগণ বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অধিক জ্ঞাত। তখন তিনি বললেন, ঐ সমস্ত লোকেরা যাদেরকে হক কথা বলা হলে তৎক্ষণাৎ তা কবুল করে। আর যখনই ন্যায্য হক ও অধিকার চাওয়া হয়, সাথে সাথেই তা দিয়ে দেয় এবং মানুষের উপর অনুরূপভাবে শাসন করে যেরূপ নিজের উপর শাসন করে অর্থাৎ শাসন ও বিচার ব্যাপারে নিজের ও অপরের মধ্যে পার্থক্য করে না’ (মুসনদে আহমদ)। (৫) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সাত ব্যক্তিকে আল্লাহপাক ছায়া দিবেন নিজের ছায়ায়। যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না। (১) ন্যায়পরায়ণ শাসক। (২) সেই যুবক যে বর্ধিত হয়েছে আল্লাহর ইবাদতে। (৩) সেই ব্যক্তি, যার অন্তর লেগে থাকে মসজিদের সাথে যখন সে তা হতে বের হয় যতক্ষণ না তাতে ফিরে আসে। (৪) সে দুই ব্যক্তি, যারা একে অন্যকে ভালোবাসে আল্লাহর ওয়াস্তে, উভয় মিলিত হয় তাঁর জন্য এবং উভয় পৃথকও হয় তাঁর জন্য। (৫) সে ব্যক্তি, যে নির্জনে স্মরণ করে আল্লাহকে, আর অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে তার দু’চোখ। (৬) সে ব্যক্তি, যাকে কোন সম্ভ্রান্ত সুন্দরী নারী আহ্বান করে, আর সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। (৭) সেই ব্যক্তি, যে দান করে কোন দান, আর গোপন করে তাকে, এমনকি তার বাম হাত জানে না তার ডান হাত কী দান করে’ (বুখারী ও মুসলিম)।
ন্যায়পরায়ণ শাসকদেরকে আল্লাহপাক অতি উচ্চ আসনে সমাসীন করেছেন। তাদের মর্যাদা অটুট রাখার জন্য আল্লাহপাক একটি চূড়ান্ত বিধান রেখে দিয়েছেন, সেই বিধানটি হচ্ছে- কোন কোন সময় সত্য মিথ্যা যাচাই করা সম্ভব হয় না। এমন অবস্থায় শাসক বা বিচারক সত্য ও ন্যায়ের উপর অবিচল থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করার পরও যদি সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারেন তবুও তিনি সওয়াব পাবেন। অর্থাৎ ন্যায়পরায়ণ শাসক বা বিচারক ভুল করলেও সওয়াব পাবেন। এ সম্পর্কে রাসূলে পাক ইরশাদ করেন, ‘কোন শাসক বা বিচারক সর্বাত্মক চেষ্টা করার পর সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হলে তার জন্য দুটি পুরস্কার রয়েছে। পক্ষান্তরে সর্বাত্মক চেষ্টা করার পরও ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হলে তার জন্য একটি পুরস্কার রয়েছে’ (মুসলিম শরীফ ২য় খণ্ড : পৃষ্ঠা- ৭৬, মিশকাত শরীফ : পৃষ্ঠা-৩২৪)। ন্যায়পরায়ণ শাসকের মর্যাদা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। তাই সকল শাসকদেরকে ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা উচিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।