ছাত্র জীবনে পরীক্ষার গুরুত্ব
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ ডিসেম্বর ২০২২, ৭:১৮:০৭ অপরাহ্ন
প্রাণ কান্ত দাস
আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন জনপ্রিয় একটি বাক্য প্রচলিত ছিল, সেটা হলো- ‘ছাত্র জীবন সুখের জীবন, যদি না হয় Examination’। এই Examination-ই ছাত্রজীবনের মূল ভিত্তি। অতীতে এই Examination বা পরীক্ষা পদ্ধতি আজকের তুলনায় অনেকটা কঠিন ছিল বিধায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রীতিমত উপস্থিত থাকত ও লেখাপড়া করত। এমনকি কোন শিক্ষার্থী সারা বছর কোন কারণে রীতিমত লেখাপড়া করতে না পারলেও অন্য সকল শিক্ষার্থীর মত তাকেও পরীক্ষার পূর্বে দিন রাত কঠোর পরিশ্রম করে লেখাপড়া করতে হত। এর কাছে শীত গরম সবই তুচ্ছ ছিল। তখন শুধু পড়া আর পড়া- এটাই ছিল একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ জন্যই বলা হয় ‘ছাত্রানং অধ্যয়ং তপ:’। তখন শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মনোযোগী রাখার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কঠোর শাস্তির বিধান ছিল। কেহ পরীক্ষায় ফেল করলে কখনো তাকে পরবর্তী ক্লাসে প্রমোশন দেওয়া হত না। কাজেই পরীক্ষায় পাশ বা ফেল শিক্ষার্থীদের নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল। তাই সকল শিক্ষার্থীকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রীতিমত উপস্থিত থাকতে হত। কেহ অনুপস্থিত থাকলে শাস্তির বিধান ছিল। এর ফলে ছাত্র-শিক্ষকের সকলের উপস্থিতির মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরব ও মুখরিত হয়ে ওঠত। এভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি আন্তরিক বন্ধন ছিল।
কালের বিবর্তনে দেশে বিভিন্ন সময় শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন অধ্যাদেশ জারীর ফলে শিক্ষার্থীদের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। এর ফলে দেশের কিছু সংখ্যক প্রসিদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত প্রায় সবগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি হ্রাস পেয়েছে। এবং লেখাপড়ার প্রতিও অনেকটা অমনোযোগী হয়ে পড়ছে।
১৯৮৭ সালে এরশাদ আমলে স্নাতক শ্রেণি থেকে ইংরেজী তুলে দেওয়ার ফলে ডিগ্রি পাস পরীক্ষায় পাশের হার দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তীকালে এর ফলে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি শিক্ষকের স্বল্পতা দেখা দেয়। এই সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার ফলে আবার স্নাতক শ্রেণিতে ইংরেজি চালু করা হয়। এর ফলে পরীক্ষায় পাশের হারও আবার হ্রাস পায়। এছাড়া বিএনপি আমলে ১৯৯২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় রচনামূলক ও বহুনির্বাচনী (গঈছ) প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করা হয়। এর ফলে পরীক্ষায় পাশের হার হুড় হুড় করে বৃদ্ধি পায়। পরীক্ষায় এই পাশের হার দেখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করলেন ‘শিক্ষায় এবার জোয়ার এসেছে’। এই সহজ শিক্ষা পদ্ধতি চালু করার ফলে অনেক শিক্ষার্থী পাঠ্যপুস্তকের রচনামূলক প্রশ্নোত্তরের পড়া বাদ দিয়ে শুধু গঈছ দিয়েই অতি সহজে পরীক্ষায় পাশ করতে থাকে। পরীক্ষা পাশের এই হিড়িক দেখে পরবর্তীকালে এই পদ্ধতি সংশোধন করা হয়। এর ফলে পরীক্ষায় পাশের হারও সাথে সাথে হ্রাস পায়।
উক্ত অধ্যাদেশ দুটি থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, পরীক্ষা পদ্ধতি কঠিন হলে পরীক্ষায় পাশের হার কম হয় এবং পরীক্ষা পদ্ধতি সহজ হলে শিক্ষার্থীরা কম লেখাপড়া করেও পরীক্ষায় পাশ বেশি করে। ডিগ্রি পাস পরীক্ষায়ও একই অবস্থা বিদ্যমান। সেখানে ২০ নম্বরের ইনকোর্স পদ্ধতি চালু করার ফলে শিক্ষার্থীরা অতি সহজে ঐ নম্বর পেয়ে থাকে। আর একটি বিষয়ে বাকী (১০০-২০) বা ৮০ নম্বরের পরীক্ষায় পাশ করতে (৩৩-২০) বা ১৩ নম্বর অর্জন করতে শিক্ষার্থীদের তেমন লেখাপড়া করতে হয় না। এভাবে স্নাতক শ্রেণিতে পরীক্ষা পদ্ধতি সহজ করার ফলে শিক্ষার্থীরা অতি সহজেই পরীক্ষায় পাশ করে থাকে। সুতরাং এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া নির্ভর করে পরীক্ষা পদ্ধতির উপর।
আগামী বৎসর থেকে আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি মহোদয় দেশে দীর্ঘদিনের প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে নূতন শিক্ষা পদ্ধতি হিসেবে মূল্যায়ন পদ্ধতি পর্যায়ক্রমে চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রণ করেছেন। গত ২২ নভেম্বর ২০২২ তারিখের ‘দৈনিক প্রথম আলোর’ শেষ পৃষ্ঠায় একটি শিরোনাম হলো, জিপিএ ভিত্তিক ফল ওঠে যাচ্ছে, বদলাবে প্রশ্নও’- এতে বলা হয়েছে ‘আগামী বছর থেকে বাস্তবায়িত হতে যাওয়া নূতন শিক্ষাক্রমে প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হচ্ছে। এটা দুই ভাগে বিভক্ত হবে। এক ভাগের মূল্যায়ন হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই, শিখনকালীন নানা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। আর এক অংশের মূল্যায়ন হবে সামষ্টিকভাবে। এখানে পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও তা এখনকার মত শুধু কাগজ কলম নির্ভর পরীক্ষা হবে না। এসাইনমেন্ট, উপস্থাপন, যোগাযোগ, হাতে কলমের কাজ ইত্যাদি বহুমুখী পদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে, এখনকার মত জিপিএ ভিত্তিক ফল প্রকাশ হবে না।’
নূতন শিক্ষা পদ্ধতি একটি যুগোপযোগী যুক্তি নির্ভর আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন পদ্ধতি- এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই, কিন্তু এই পদ্ধতি আমাদের দেশে শহরাঞ্চলে প্রসিদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনই প্রয়োগ করা সম্ভব হলেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এত দ্রুত বাস্তবে প্রয়োগ করা কতটুকু সম্ভব হবে- তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। কারণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমনিতেই লেখাপড়ার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম। এমতাবস্থায় উপবৃত্তি ও পরীক্ষায় ফেলের ভয় দেখিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে লেখাপড়া ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানমুখী করা হয়। এছাড়া ২০১০ সালে দেশে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তনের ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের রীতিমত উপস্থিতি ও লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগ আরো হ্রাস পেয়েছে। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি একটি উন্নতমানের শিক্ষা পদ্ধতি হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের রীতিমত উপস্থিতির অভাবে দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় নাই। এর ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা নিজেদের মনগড়া উত্তর পরীক্ষার খাতায় লিখে পরীক্ষায় পাশ করে যাচ্ছে।
কাজেই একটি শিক্ষাপদ্ধতি যতই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হোক না কেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের রীতিমত উপস্থিতি সর্বাগ্রে নিশ্চিত করা না গেলে তা কোন সুফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। তাই এই পদ্ধতি প্রয়োগের পূর্বে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রীতিমত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি না থাকলে কাদের উপর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে? কিছু সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নয় বরং দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতে এই পদ্ধতি পূর্ণাঙ্গভাবে প্রয়োগ করা যায়- সেই ব্যবস্থা আগেই নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এই পদ্ধতি প্রয়োগ সফল হবে এবং আমাদের দেশ ও জাতির কল্যাণ বয়ে আনবে।
লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট।