সংকটের আবর্তে হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ ডিসেম্বর ২০২২, ৪:৫৭:২৩ অপরাহ্ন
হবিগঞ্জ থেকে মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল : শিক্ষকসহ নানা সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ। প্রায় ৫ বছর ধরে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের উদ্যোগ যেমন এগোয়নি, তেমনি শিক্ষক থেকে শুরু করে নানা শূন্যতার মধ্য দিয়ে চলছে এই কলেজটি। সমস্যা সমাধানে কলেজ কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাঁপ করলেও এর কুলকিনারা পাচ্ছেন না।
হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালের দু’তলায় অস্থায়ী ক্যাম্পাসে ৫০জন শিক্ষার্থী নিয়ে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের যাত্রা শুরু হয় ২০১৮ সালে ১০ জানুয়ারি।
কলেজ সূত্র জানিয়েছে, মোট ৯৬টি অনুমোদিত পদ রয়েছে। তন্মধ্যে শিক্ষকের পদের সংখ্যা ৭৬টি। কর্মরত আছেন মাত্র ৩৫জন।
জানা যায়, এ প্রতিষ্ঠানে এনাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিষ্ট্্ির, ফার্মাকোলজি, প্যাথলজি, মেডিসিন, কার্ডিওলজি, জেনারেল সার্জারী, পেডিয়াটিক্স, গাইনী এন্ড অবস্, এনেস্থেশিয়ালজিসহ ১১টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অধ্যাপক পদের সবকটিই শূন্য। তবে অনুমোদিত পদের বহির্ভূত রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং বিভাগে একজন অধ্যাপক কর্মরত রয়েছেন। সহযোগি অধ্যাপকের পদ ১৯টি। এনাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিষ্ট্রি, ফার্মাকোলজি, মেডিসিন, জেনারেল সার্জারী, গাইনী এন্ড অবস্, এনেস্থেশিয়ালজি সহ মোট ১২টি পদ শূন্য। এরমধ্যে কর্মরত আছেন বায়োকেমিষ্ট্রি, পেডিয়াটিক্স, অর্থোপেডিক্স, সার্জারী, মাইক্রোবায়োলজি (২জন) ও প্যাথলজি বিভাগে (২জন) সহযোগি অধ্যাপক।
সহকারি অধ্যাপকের ১৯টি পদের মধ্যে ১৬ জন কর্মরত আছেন। ফিজিওলজি, প্যাথলজি, মাইক্রোবায়োলজি, কার্ডিওলজি এন্ড সিসিইউ, নেফ্রোলজি, সাইকিয়াট্রিক, অফথালমোলজি, নাক কান গলা, রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং ডেন্টিষ্ট্রি বিভাগে কোন শিক্ষক নেই। এসব বিভাগে সহকারি অধ্যাপকের পদ শূন্য থাকলেও কোন কোন বিষয়ে আবার অনুমোদিত ১টি পদের বিপরীতে নিয়ম বহির্ভূত একাধিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, ফার্মাকোলজিতে ৩জন, গাইনী এন্ড অব্স ২জন, এ্যানেস্থেশিওলজি ২জন, পেডিয়াটিক্স ২জন। প্রভাষকের ২৪টি পদের মধ্যে ১০জন কর্মরত। প্যাথলজি, ফার্মাকোলজি, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে ৩জন করে প্রভাষক থাকার কথা কিন্তু ওই বিভাগে একজন শিক্ষকও নেই। এছাড়া বায়োকেমিষ্ট্রি বিভাগে ২জন, কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগে ১জন, ফরেনসিক বিভাগে ২জনের পদ শূন্য রয়েছে। প্যাথলজি বিভাগে কিউরেটরের পদটি শূন্য রয়েছে। এছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারির ২০টি পদের মধ্যে কর্মরত আছেন ৭জন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর হবিগঞ্জ নিউ ফিল্ডে এক জনসভায় ভাষণ দেন। এ সময় হবিগঞ্জ সদরে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি জানালে তিনি তা মেনে নেন। ২০১৫ সালে ১২ জানুয়ারি মেডিকেল কলেজটি প্রশাসনিক অনুমোদন পায়। বর্তমানে ৫টি ব্যাচে প্রায় আড়াই শতাধিক শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছেন। ২০১৬ সালে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবু সুফিয়ান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদ লাভ করেন। ২/৩ বছর যেতে না যেতেই প্রায় ১৫ কোটি টাকা মূল্যের বই, আসবাবপত্র ও মেডিকেল সামগ্রী ক্রয়ে টেন্ডার কেলেংকারি নিয়ে পত্রপত্রিকা বেসরকারি টিভি চ্যানেলের শিরোনাম হয় এই কলেজটি। দুদক ওই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করে।
বিরাজমান সংকট প্রসঙ্গে কলেজের ৫ম বর্ষের ছাত্র মোশাহিদ চৌধুরী জানান, ‘আমরা শুধু পাস করার জন্য পড়ছি। বছর শেষে ডাক্তার হবো। কিন্তু ‘হাতে কলমে’ যে শিক্ষা পাওয়ার কথা, তা পাচ্ছি না। একটি মেডিকেল কলেজে শিক্ষকের পাশাপাশি ব্যবহারিক শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সুবিধা থাকা জরুরী। কিন্তু এই মেডিকেল কলেজে শিক্ষক সংকটসহ নানা সমস্যা রয়েছে। হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে শিক্ষকের সাথে ওয়ার্ড ঘুরে রোগি দেখার সুযোগ তেমন হয়ে উঠেনি। কারণ চিকিৎসকের অভাবে অধিকাংশ রোগিকেই সিলেট বা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে দেয়া হয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানান, এমন পরিস্থিতি হবে আগে জানলে এই কলেজে ভর্তি হতাম না। এখন মাইগ্রেশনের সুযোগ নেই। অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, ৫/৬ জন শিক্ষক সংযুক্তিতে রয়েছেন। তারা বেশিরভাগ সময় গড়হাজির থাকেন।
এদিকে, ৫ বছরে মেডিকেল কলেজের স্থান নির্ধারণ এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
কলেজ সূত্র জানায়, দেশে নতুন ৬টি নতুন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণের জন্য একটি ডিপিপি তৈরী হয়েছে। প্রায় দেড় বছর আগে একটি টিম হবিগঞ্জ শহরতলীর রিচি এলাকায় হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য প্রস্তাবিত প্রায় ৩০ একর ভূমির হাইড্রোলজিক্যাল ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক পরীক্ষা শেষ করেছে। এরপর কাজের কাজ কিছুই এগোয়নি।
এদিকে, সদর আধুনিক হাসপাতালের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থান সংকুলান না হওয়ায় বিপাকে রয়েছেন কলেজের সংশ্লিষ্টজনেরা। একইভাবে কলেজের কারণে হাসপাতালে রোগিদের চিকিৎসা সেবাও বিঘ্নিত হচ্ছে।
এদিকে, প্রায় দুই মাস আগে শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
অধ্যক্ষ ডা. সুনির্মল রায় এক মাসের মধ্যে কিছু সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত করেন। যোগাযোগ করা হলে অধ্যক্ষ সুনির্মল রায় বলেন, কলেজের আড়াই শতাধিক ছাত্রছাত্রী’র জন্য বর্তমান ক্যাম্পাসটির স্থান সংকুলান হচ্ছেনা। প্রতিবছর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। সদর হাসপাতালে দিন দিন রোগির চাপ বাড়ছে। রোগি সংকুলান করতে না পারায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাস ছাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। শিক্ষক, ছাত্রদের আবাসন থেকে শুরু করে সবকিছুরই সংকট রয়েছে। সমস্যা নিরসনে স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগে দৌড়াদৌড়ি করছি। কলেজ ক্যাম্পাসের জন্য ৩০একর ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব রয়েছে। মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য বিভাগের উর্ধবতন কর্মকর্তারা পরিদর্শন করেছেন। সয়েলটেষ্ট হয়েছে। এরপর কী হয়েছে আমার জানা নেই।