সুন্দর একটি পৃথিবী চাই
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১০ ডিসেম্বর ২০২২, ৬:০৮:৪২ অপরাহ্ন
জুঁই ইসলাম
সমাজের এক পক্ষ আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখছে আর অন্যপক্ষ দু’মুঠো ভাত জোটাতেই শরীরের ঘাম ঝরাচ্ছে। যা সত্যি নীতি বর্হিভূত। কাগজে কলমে নীতি, নিয়ম থাকলেও মানুষের আচার-ব্যবহারে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যপারে বড় বড় আমলা ব্যক্তিরা উদাসীন। আমাদের ঘুণে ধরা সমাজ আজ ঝরাজীর্ণ প্রায় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায়।
বিভিন্নভাবে মানবাধিকার লঙ্গিত হচ্ছে। খুন হচ্ছে মানুষ বিচার পাচ্ছে না অনেকেই। একে অন্যের সম্পত্তি জোর করে আদায় করে নিচ্ছে , সাধরাণ মানুষের জীবন নিয়ে যেখানে হররোজ ছিনিমিনি খেলা চলে সেখানে অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি হাস্যকর বটে। মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১০ ডিসেম্বর দিবসটি পালন করা হয় বিশ্বের অন্যন্য দেশের মতো আমাদের দেশেও।
প্রতিবছর তো দিবস আসে দিবস যায়। মানুষ কি তার সঠিক অধিকার পায়? ১০ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালন হয় দেশ-বিদেশে। কিন্তু ফলাফল কী।
দুনিয়ার প্রথম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনিই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম হিলফুল ফুজুল সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন। সে থেকে মূলত মানব কল্যাণে, জনগণের মানবতার অধিকার সুরক্ষার কর্মসুচি বাস্তবায়ন হতে থাকে। দেড় হাজার বছর পরে পৃথিবীর আজকের দিনে বিশ্বমানবতার জুলুম, নির্যাতন, নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানবধিকার সংগঠন জন্ম নিয়েছে। কিন্তু এসব সংগঠন কি আদৌ মানুষের অধিকার আদায় করতে পারছে? গণঅধিকার, ভোটাধিকার, ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক. রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক কোনো অধিকার আজকের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত নেই। পৃথিবীর নানা দেশে প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংগঠন দুনিয়ার অসহায় মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলে আসছে কিন্তু ফলপ্রসু কোনো সমাধান নির্যাতিত মানুষের পক্ষে আসছে না। অর্ধেক পৃথিবীর মানুষ দুনিয়ার এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার। কেউ রাজনৈতিকভাবে নির্যাতনের শিকার আবার কেউ আবার ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে।
জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে/ সে জাতির নাম মানুষ জাতি। এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত/ একই রবি শশী মোদের সাথী। ’মানুষ জাতি’ কবিতায় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত জাতি-ধর্ম-বর্ণের উধ্বে উঠে মানবপ্রেম, মানবাধিকার ও মানুষের আসল পরিচয় তুলে ধরেছেন। কিন্তু কবির কবিতা আজ কেবল বইয়েই রয়েছে। কথা বললেই গুম, খুন। আজকাল তো মানুষ প্রতিবাদ করার ভাষাও হারিয়ে ফেলছেন। চোখে দেখছেন অন্যায় হচ্ছে, সহ্য করতে পারছেন না। কিন্তু তারপরও মুখ দিয়ে ঠু শব্দ করছেন না যেনো মুখে তালা মারা জানের ভয়ে বা পরিবারের ক্ষতি হবে এই ভেবে আজ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারছেন না।
আমাদের দেশে দূর্নীতি এখন সয়লাব। যে কারণে মানুষ তার অধিকার থেকে বঞ্চিত। দেশে শিক্ষিতের হার বাড়ছে সেই তুলনায় চাকুরি নেই। যাদের মেধা আছে তারা চাকুরি পায় না। অযোগ্যতারাই অনেক সময় এগিয়ে থাকে দুর্নীতির কারণে।
মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র ১৯৪৮সালের ১০ ডিসেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এই ঘোষণা প্রদান করা হয়। প্রত্যেক মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৩০টি ধারা সম্বলিত এই সনদ ঘোষিত হয়। ‘যার মুখবন্ধে বলা হয়, মানব পরিবারের সকল সদস্যদের সমান ও অবিচ্ছেদ্য অধিকারসমুহ এবং সহজাত মর্যাদার স্বীকৃতিই হচ্ছে বিশ্বে শান্তি, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তি।’
ইসলাম ধর্মে মানবাধিকারের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (সা.) কতৃক মদিনা সনদ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এ সনদকে পৃথিবীর পূর্ণাঙ্গ লিখিত সংবিধান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এ সনদে মোট ৪৭টি অনুচ্ছেদ, মতান্তরে ৫২টি ধারা রয়েছে যেগুলোতে মানবাধিকারের বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করা হয়েছে। অথচ আজ আমরা ধর্মকে অনুসরণ না করে মানুষের অধিকারের বিষয়ে কর্ণপাতও করি না। যেনো এ বিষয়ে ঘুমে আছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। আজ যাদের ক্ষমতা আছে তারা দায়িত্বে থাকলেও কাজে নাই।
মানবাধিকারের ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে ম্যাগনা কাটাকে একটি মাইলফলক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এটি মানবাধিকারের মহাসনদ হিসেবে ইতিহাসে দেখা যায়। এটি ছিল মূলত ইংল্যান্ডের রাজা জন ও বিত্তশালী ব্যারনদের মধ্যে ১২১৫ সালে সম্পাদিত একটি চুক্তি। এতে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাউন্সিলের পূর্ব অনুমতি ছাড়া খামখেয়ালীভাবে জনগণের উপর কর আরোপ করা যাবেনা। রাজকর্মকর্তারা যথেচ্ছভাবে জনগণের ভূ-সম্পত্তি গ্রহণ করতে পারবে না। ব্যবসায়ীরা রাজ্যের মধ্যে ইচ্ছেমতো একস্থান হতে অন্য স্থানে চলাফেরা করতে পারবে। কোনো স্বাধীন মানুষকে বিচারিক রায় বা দেশীয় আইন ব্যতিত গ্রেপ্তার, কারারুদ্ধকারণ, সম্পত্তিচ্যুত, দীপান্তরিত বা নির্বাসিত কিংবা হয়রানির শিকার করা যাবে না। এই ম্যাগনা কাটা চুক্তির মধ্য দিয়েই সংসদীয় গণতন্ত্রের পাশাপাশি আইনের শাসনের ধারণার যাত্রা শুরু হয়। এই ঐতিহাসিক সনদেই বিশ্ব ইতিহাসে সর্বপ্রথম ঘোষণা করা হয় কোনো দেশের রাজাসহ সে দেশের সকলেই রাষ্ট্রীয় আইনের অধীন, কেউই আইনের উর্ধ্বে নন। প্রজাদের অধিকার ও রাজ্যের ক্ষমতা হ্রাসের যৌক্তিক এ দলিল পরবর্তীতে যুক্তরাষ্টসহ বহুদেশে মানবাধিকার ও জনগণের ক্ষমতায়ন গুরুত্বপূর্ণ পথনিদের্শক হিসেবে কাজ করছে।
মানবাধিকারের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ প্রত্যক নাগরিকের আছে। আমি অবাধ স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করি না তবে একজন মানুষের জীবন চলার পথে রাষ্ট্র বর্হির্ভূত কোন কাজ ছাড়া নাগরিক তার স্বাধীনতাভোগ করবে। কিন্তু সে স্বাধীনতা থেকে আমরা বঞ্চিত আজ। এ দেশের নাগরিকদের আজ ভোটের অধিকার নেই। একজন নাগরিক হিসেবে ভোট দিয়ে তার মতামত প্রকাশ করবো সেই মতামত প্রকাশের মাধ্যমটাও আজ প্রায় পঙ্গু। নতুন প্রজন্মের নাগরিকদের আক্ষেপ ভোটের মাঠে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেওয়ার স্বাদই গ্রহণ করতে পারেনি নতুন ভোটারা। পদ্মা আমাদের, ইলিশ আমাদের অথচ অতিরিক্ত দামের কারণে আমরা সাধারণ জনতা পদ্মার ইলিশ পাই না বিদেশি বাবুরা বড় বড় টাকা দিয়ে বা উপহার হিসেবে পেয়ে যান আমরা তার ঘ্রানও নিতে পারি না। যেখানে দেশের মানুষ জাতীয় মাছের দেখা পায় না সেখানে বিদেশি আথিতেয়তা কতটুকু মানানসই? এটাও মানবাধিকার পরিপন্তী। অতিরিক্ত দামের কারণে দেশের সাধারণ জনগণ খেতে পারে না অনেক কিছুই আজ অথচ বিদেশের মাটিতে বসে অনেকেই দেশের খাবার ভক্ষণ করেন।
বর্তমান পৃথিবী নানাভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে মানবতার বিপর্যয়ের জন্য লাখো কোটি ডলার খরচ করে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র মজুদ করা হচ্ছে। এদিকে মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার জন্য পৃথিবীর মজলুম মানুষের আহাজারি করছে, অন্যদিকে অসংখ্য জমি খালি পড়ে আছে। খাদ্যসামগ্রী উচ্ছিষ্ট করে ধবংস করা হচ্ছে। মুসলিম-অমুসলিম ধর্মীয় ভেদাভেদ না রেখে বলতে গেলে সব ধর্মের অনুসারীরা এ ধরনের মানব বিধ্বংসী কর্মকান্ডে লিপ্ত। বিশ্বে কাউকে সেক্ষেত্রে বারণ করতে পারছে না। ধর্মীয় বাণী, শিক্ষা, উদ্দেশ্য, শৃঙ্খলা সবকিছু সেখানে ব্যর্থ। আজকে এক দেশে অপর দেশের মানুষকে শধু ক্ষমতার দাপটে মানুষ মনে করছে না। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অসহায় মানুষগুলোকে ব্যবহার করে জীবননাশ করে দিচ্ছেন এমন ঘটনা প্রায় হচ্ছে কিন্তু কেন মানুষ মানুষকে স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহার করে মানুষকে খুন করবে? সৃষ্টির সেরাজীব মানুষ সেই মানুষগুলো যখন ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে একটা পরিবার ধ্বংস করে দেন যা মানবতাবিরোধী। ধনাট্য ব্যক্তি বা রাষ্ট্র বাস্তসম্মতভাবে মানুষের অধিকার ফিরে পাক সেদিকে এগিয়ে আসছেন না বিধায় দিনে দিনে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ছে।
আজ চারিদিকে দেখা যায় মানবতার পোশাকধারীদের কিন্তু যাদের হাত দিয়ে মানবতা ফেরি করার কথা তারা তাদের নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু আজকের বাস্তবতা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ মানুষ বঞ্চিত তাদের স্বীকৃত অধিকার থেকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসী লেখক জ্যাঁ জ্যাক রুশো মানুষের স্বাধীনতা ও মানবতা বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে তার লেখনী ব্যবহার করেন। জ্যাক রুশো তার বিখ্যাত ‘ঞযব ঝড়পরধষ ঈড়হঃৎধপঃ’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘‘স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার।’’ কিন্তু তবুও সর্বত্র মানুষ আজ শৃংখলিত।
তাই তো আজ শোনা যায় আকাশে-বাতাসে মানবতার আহাজারি। কে শুনবে কার কথা। কে দিবে সান্ত¦নার বাণী। মানবতার মুক্তির কোনো নেতা কি আজ বিশ্বে আছেন? যদি থাকত তাহলে আজকের দুনিয়ায় এভাবে অসহায়দের চিৎকারে বাতাস ঘণীভূত হত না। মজলুম মানুষ তাদের মুক্তির জন্য একজন নেতা চায়। তারা সুন্দরভাবে বাঁচতে চায়। বর্তমান বিশ্বে যা এখন খুব জরুরি। সত্যিকথা কথা হল সৃষ্টিকর্তা যেভাবে একজন মানুষের সৃষ্টির অধিকার নিয়ে সৃষ্টি করেছেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে সে অধিকার ক্ষমতাসীনদের কাছে এটাই সত্য।
মানবাধিকার দিবসে মানুষ তার মৌলিক অধিকার ফেরত চায়। ভোটাধিকার, নাগরিক অধিকার, রাষ্ট্রীয় অধিকার সমানভাবে সব মানুষের দুনিয়াব্যাপী ফেরত চায়। জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন দুনিয়ার সব প্রান্ত থেকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। জনগণের অধিকার, মজলুমের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আজকের দিনে বিশ্বব্যাপী সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশাই এখন সবার। মানবতাবাদীরা জেগে উঠুন। ঘুমন্ত বিবেবকে জাগিয়ে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হোন। জয় হোক মানবতার।
লেখক : কলামিস্ট।