হারিয়ে যাচ্ছে মক্তব শিক্ষা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ ডিসেম্বর ২০২২, ৮:০৩:৫২ অপরাহ্ন
![হারিয়ে যাচ্ছে মক্তব শিক্ষা হারিয়ে যাচ্ছে মক্তব শিক্ষা](https://sylheterdak.com.bd/wp-content/uploads/2022/08/dak-po-sompadokio2-4.jpg)
মোহাম্মদ ছয়েফ উদ্দিন
পবিত্র কোরআনে নাযিলকৃত প্রথম শব্দ ‘ইক্রা’। এর অর্থ ‘পড়’। পড়লেই জানতে পারবে। শুনে জানার চেয়ে পড়ে জানাই উত্তম। শুনা সাক্ষীর চেয়ে দেখা সাক্ষীর সাক্ষ্য বেশি গ্রহণযোগ্য। এ জন্য মামলায় eye-witness এর গ্রহণযোগ্যতা বেশি।
কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গল্প, পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, ধর্মীয় গ্রন্থ ইত্যাদি আমরা সচরাচর পড়ে থাকি। বিষয়গুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হয়। আবার ঘরে বসে কিংবা গ্রন্থাগারেও পাঠকরা যায়।
গ্রাম-বাংলা তথা শহরের পুরনো ঐতিহ্য সকাল বেলার মক্তবে ধর্মীয় শিক্ষা দান কার্য আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। প্রায় প্রতি বাড়িতে মক্তবে শিক্ষা দান কার্য প্রচলিত ছিল। বাড়ির ক্ষুদে শিক্ষার্থীর দল ভোরে মৌলভী সাহেবের কাছে পড়তে বসত। ওরা পবিত্র কোরআনের ছোট সূরাগুলো মুখস্ত করত। সূরা ফাতেহা থেকে সূরা ঝিলজাল পর্যন্ত স্বল্প সময়ে অনায়াসে মুখস্ত করে ফেলত। পাশাপাশি কালেমা। বিভিন্ন দোয়া দরূদ, নামাজ পড়ার নিয়ম ও নিয়ত। নামাজে পঠিত দোয়া-দরূদ মুখস্ত করত। তারপর কায়দা, সিপারা পেরিয়ে পবিত্র কোরআন মজিদ শুদ্ধ করে তেলাওয়াত করার নিয়ম কানুন শিখে ফেলত। বাড়ি তথা সমাজের স্বচ্ছল-অস্বচ্ছল সব শ্রেণির ছেলেমেয়েরা ধনী-গরীব ভেদাভেদ ভুলে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠত।
একই পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থা পাড়া-মহল্লার মসজিদগুলোতে প্রচলিত ছিল। মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জেনগণ বাচ্চাদেরকে পড়াতেন। এ পদ্ধতিতে শিশুকালেই তাদের মনে ধর্মীয় শিক্ষার ভিত্তি গড়ে উঠত। মক্তবে শিক্ষা আজ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখনকার ছেলেমেয়েরা ‘মক্তব’ নামটি হয়তো জানেই না। অবশ্য মসজিদে এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো চালু রয়েছে। তবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।
শহর কিংবা গ্রামে করহফবৎ এধৎঃবহ নামে স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সকাল ০৮ টায় ক্লাস শুরু হয়ে দুটোয় ছুটি হয়। স্কুলের ক্লাসে যোগদান করতে সকাল বেলার ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের কোমলমতি শিশুরা। ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে মক্তব শিক্ষা।
ভোরে ঘুম থেকে ওঠে বইয়ের বোঝা কাঁধে নিয়ে ওদেরকে বোয়া কিংবা অভিভাবকের হাত ধরে যেতে হয় স্কুলে। ফেরার পর ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য কেউ কেউ মৌলভীর টেবিলে হাজির হয়, অনেকেই আবার বিষয়টি ভুলে গিয়ে ধর্মীয় মৌলিক শিক্ষা ছাড়াই বেড়ে ওঠে। সঠিকভাবে নামাজ কালাম না শিখে বে-আমলি হয়, ওদের চরিত্র ঠিক থাকবে কী করে? কারণ শিক্ষা আলো স্বরূপ, শিক্ষাহীন মানুষ পশুসম।
স্কুল-কলেজে পড়ুয়াদের ক্লাস শুরু হয় সকাল ১০ টায়, ক্লাসে যোগদান করতে ওদেরকে ভোরে ওঠার প্রয়োজন হয় না। ওদের ক্লাস সকাল ৮ টায় শুরু হওয়া প্রয়োজন ছিল। (অবশ্য কিছু প্রতিষ্ঠান এ সময়টি গ্রহণ করেছেন)। ওদের দেহ সুগঠিত। বেশি পরিশ্রম তথা ভোরে শয্যা ত্যাগ করার জন্য ওদের দেহ প্রস্তুত। ওদের ওপর নামাজ ফরজ। ভোরে শয্যা ত্যাগ করলে ফজরের নামাজ পড়া যায়। বিষয়টি একদম উল্টো বলা যায়। অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা শিশুদের ওপর চাপিয়ে না দিয়ে বড়দের ওপর দেওয়া যায়। ভোরের সময়টুকু শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য বরাদ্দ করা প্রয়োজন। ওদেরকে ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষার সুযোগ করে দিতে হবে সর্বাগ্রে। তাদেরকে পর্যাপ্ত ঘুম ও খেলাধুলার সুযোগ করে দিতে হবে। বিদ্যালয়ে খেলাচ্ছলে শিশুরা যা পারে শিখবে। বাড়তি বইয়ের বোঝা ওদের ওপর চাপানো যাবে না।
গ্রামে কিংবা শহরে সকাল ১০ টায় শিশুদের ক্লাস শুরু করা প্রয়োজন। বাসা-বাড়িতে সকালে মক্তবের শিক্ষাদান কার্য পুরোপুরি চালু করতে হবে। মসজিদগুলোতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে হবে। এভাবে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন যুব সমাজ গড়ে তোলার আশা করা যায়।
আগেকার দিনে প্রায় বাড়িতে প্রত্যুষে বয়স্কদের কোরআন তেলাওয়াতের ধ্বনিতে পাড়া মহল্লা মুখরিত হতো। ওরা ফজরের নামাজ কায়েম করে দীর্ঘ সময়ব্যাপী কোরআন তেলাওয়াত করত। বর্তমানে এ ধরনের কোরআন চর্চা কমে গেছে। মানুষ ওহঃবৎহবঃ, ফেসবুক ইত্যাদিতে নিমজ্জিত। মহামূল্যবান সময় নষ্ট হয়, টেরই পায় না। এগুলো নেশায় পরিণত হয়েছে। রাতের ঘুমকে হারাম করে দেয়। অবশ্য প্রয়োজনে ইহা ব্যবহারে আপত্তি নাই। যাক্গে, এসব ভিন্ন কথা। আমার আলোচনার আজকের বিষয় ইহা নয়।
প্রতিটি গৃহে কোরআনের আলো পৌঁছে দিতে হবে। মক্তব-শিক্ষাদান পদ্ধতি কুরআন শিক্ষায় বৃহৎ ভূমিকা পালন করে। কোরআন মানবজাতির জন্য শিক্ষাস্বরূপ। কোরআনের সুমধুর স্বরে মন ভরে যায়। মনে প্রশান্তি আসে। কোরআন তেলাওয়াতে মানষিক দুশ্চিন্তা দূর হয়।
মুমিন হওয়ার জন্য আলেম হতে হবে, এমন নয়। কোরআন শুদ্ধ করে পড়া, মাতৃভাষায় অর্থ বুঝার চেষ্টা করা, এর মৌলিক শিক্ষা গ্রহণ করা ও বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে মোমিন হওয়া যায়। আজ আমরা কোরআনের মৌলিক শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। তাই বিশেষ করে যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে। ফলস্বরূপ ধর্ষণ, ব্যভিচার, বেহায়াপনা, বেপর্দা পনা, মারামারি, মিথ্যাচার ইত্যাদি অপকর্ম বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ খ্রিস্টাব্দ সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ঘটে যাওয়া স্বামীর হাত থেকে তোলে নিয়ে স্ত্রী (নববধূ) কে গণধর্ষণের ঘটনা গোটা জাতির বিবেকে আঘাত হানে। এ অপরাধের বিরুদ্ধে মানববন্ধন সহ নানাভাবে প্রতিবাদ জানানো হয়। দোষীদের দ্রুত শাস্তি প্রদানের দাবি ওঠে।
মুসলমানের সন্তানেরা এ ¬ধরনের নিকৃষ্ট ঘটনা ঘটাতে পারে না। শুধু নামে মুসলমান হলে চলবে না। কাজের দ্বারা মোমিনের পরিচয় দিতে হয়। নৈতিক অবক্ষয় ঠেকাতে হবে। সর্বোপরি প্রতিটি মানুষকে কোরআনের আলোয় আলোকিত করতে হবে। এ জন্য অন্তত সকাল বেলার কোরআন শিক্ষার আসর ‘মক্তবে শিক্ষাদান’ পদ্ধতির প্রচলন পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন।