ফুলের পাপড়িতে কবরের দেওয়াল
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ ডিসেম্বর ২০২২, ৮:০৬:১৩ অপরাহ্ন
আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্
কিশোর মজুমদার লিখেছেন- ‘জীবনকে দামি উপহার হিসেবে দেখো, অভিযোগ করো না, আনন্দ পাবে।’ এবার আসি মূল কথায়। নাম মনজুর। অফিসের ছোট্ট একটা ফাইলে পুরো নাম ছিলো মনজুর আহমদ মামুন। বাবা-ইমান হুসেন ও মা-আফিয়া বেগম তাকে মামুন নামেই ডাকেন। তার বাড়ি পূর্ব হাঁটিলা উদিরপাড়, চাঁদপুর। থাকে রুস্তমপূর শাহপরাণ, সিলেটে। মনজুর মানে ‘নিরাপদ’। আমার কাছে কেমন জানি তাকে নিরাপদই মনে হয়। হয়তো জীবনকে দামি উপহার হিসেবে দেখে বলে মনজুর ডাকলেই-মামুন পর্যন্ত যেতে হয় না। পায়ের মাপে যতোদূর যায়, রিকশার প্যাডেল যতো জোরে ঘুরে, ততোটুকু সময় নিয়ে মনজুর হাজির। স্যার, ‘বেড নম্বর বলেন’। রোগীর বেড ও মোবাইল নম্বর বলেন! বলেন; মোবাইলে যেনো পাই।’
মনজুর রোজগেরে পরিবারের ৪ ভাই, ২ বোনের মধ্যে তৃতীয়তে অভিষিক্ত অল্প বিদ্বানের বিরাট শিক্ষিত মানুষ। পেশায়-এ পেশা, ও পেশা। শেষে স্ন্যাকবারের দু টি বার এর ভাড়ায় চালিত মালিক। মানুষের জন্য, প্রাণের জন্য মানবিক মানুষ।
কথা টানলে মনজুরের মানবিক পরিচয় হচ্ছে অপেশাদার রক্তদাতা। মানুষের জন্য একজন মানুষের যা করার দরকার, সে শ্রম ও রক্ত দিয়েই করে। দিনে দিনে ২৭ এর ঘরে বয়েস হলেও ‘ও’ নেগেটিভ রক্ত দেওয়া হয়ে গেছে ২৮ বার। তার ভাই মাসুম আহমদ ৩৩ বছর বয়েসে-‘ও’ নেগেটিভ ৩৪ বার। মাকসুদ আহমদ ৩০ বছর বয়েসে- ‘ও’ নেগেটিভ-১২ বার। মারুফ আহমদ ২৩ বছর বয়েসে-‘ও’নেগেটিভ ১৪ বার। বোন-ইভা আক্তার ১৯ বছর বয়েস হলেও একবারও দেন নি। ইনা আক্তার ১৭ বছর বয়েসে ‘বি’ রক্ত ধারণ করেও সময় না হওয়ায় দিচ্ছেন না। ভাগ্নে কাওসার আহমদ ‘বি’ নেগেটিভ রক্ত ধারণ করে ২৬ বছর বয়েসে ৪ বার রক্ত দিয়েছেন। সব মনজুরের সহযোগিতায়।
‘স্বপ্ন’ রক্তদান সমাজ কল্যাণ ফাউন্ডেশন নামক সংগঠন করতে করতে পুরো পরিবারকেই রক্তদানে পাগলপারা মানুষ গড়া তার আরেকটা ক্রেডিট। তাদের একটিমাত্র পরিবারেই সব নেগেটিভ রক্তের ভান্ডার। ও নেগেটিভ। এ নেগেটিভ। এ.বি নেগেটিভ। মজার ব্যাপার হলো, তার বাবাও ‘ও’ পজেটিভ। মা ও ছেড়ে যাচ্ছেন না, তিনিও ধারণ করছেন ‘বি’ নেগেটিভ। মনজুর আমি ‘অণু’র অবলম্বন। মনজুর কোন দল করে কি না জানি না। পেছনের বারোমাসি রেকর্ড যদি থেকে থাকে থাকুক, আমি বাজিয়ে দেখি না। আমি দেখি হুইসেল দেওয়ার সাথে সাথে সে দৌঁড়ালো কি না।
মানুষের একটি দল করার অনুমতি থাকলেও বেশি অংকেই এ দলের মানুষ হতে না পারলে কেউ কেউ এ দল করেই জীবনের শেষ বাড়ির ঠিকানা লেখায়। আমার কেমন জানি মনে হয়, মামুন হয়তো সে দলেরই লোক। আর সে দলের নাম-মানুষ। যারা বুঝে ‘মানুষ মানুষের জন্যে’। তাই সাবেকির খুব জুনিয়র এ কলিগটিকে আমি খুব স্নেহে মান্য করি। তার চোখ অন্যের বরাবর ওঠে কি না জানি না। আমার সকাশে তার বিনয়ী চোখ ঝুলে থাকে মাটি বরাবর। আমি চোখ তুললে সে নামায়। কথা বললে, ঈগলু আইসক্রিমের মতো গলতে থাকে। অর্থাৎ বাচনে বিনয়ী। দানে উৎসাহী। কাজে দক্ষ। অর্থে অপরিপক্ক হলেও মানুষের জন্য কিছু করতে হিমালয় সমকক্ষ।
কারণ মামুন অর্থেই নয়, কাজেও নিরাপদ। এ জন্য মামুন হাত পাতলেই আমি তাকে নিয়ে খুব নিরাপদ হয়ে উঠি। কেনোনা খুব ‘অণু’ এ দান নিয়ে মনজুর হকার্স মার্কেটের নানা বর্ণিল জামাকাপড়। ফুটপাতের লাল, নীল স্যান্ডেল। ছোটো কোন লেইসফিতার কাঁধের বাক্সের ভেতরের আহলাদি জিনিস কিনতে উদগ্রীব হয়ে যায়। সে হকার্স মার্কেট থেকে নানান মাপের জামা কিনে। পায়জামা কিনে। ফুটপাত থেকে নানা বয়েস মেপে জুতা কিনে। লেইসফিতার বাক্স থেকে ছোটো ছোটো মেয়ে শিশুর চুড়ি কিনে। এরপর তার ডান হাত, বাম হাতের মানুষ ও আমি খুব ‘অণু’কেও নিয়ে রেলস্টেশনে বসিয়ে বাচ্চাদের সাথে ইফতার করিয়ে মাপের সাথে খাপ খাইয়ে ঈদের খুশি বিলিয়ে দেয়। যা এ পর্যন্ত করা হয়ে গেছে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। বন্যা এলে চাল ডালের প্যাকেটের দাম নির্ধারণ করে খুব ছোট চাঁদায় মানুষকে মানুষের জন্যে নিয়ে যায়। সীমিত সাধ্যে বিপদি মানুষের জন্য বুকে সাহস ঢেলে দেয়।
কথায় আছে, ভালোবাসলে ভালোবাসা মিলে। তার জন্য কি না জানি না হঠাৎ মনজুর আহমদ মামুনের ফোন ‘আমার সময় দেওয়া সময়ে নয়, অফিস শেষে আপনার সময় নিয়ে একবার আমাকে দেখে যাবেন, স্যার।’
তার এমন ফোনে, মনের আকাশকে বলি; দেখতো গুনে, ৭ রং হলো কি না? ৬ রং হলে কিন্তু রঙধনু বলে না। কেনো না, মনজুর ফোন দিয়েছে মানে-রং ৭ টিই থাকবে!
অপেক্ষায় ছিলো। আমাকে পেয়ে আগু পিছু সমান্তরাল হেঁটে যেখানে নিয়ে গেলো। তার নাম ‘জলসাঘর’। স্থান সিলেট শহরের আম্বরখানা। ‘জলসাঘর’ নাচ কিংবা গানের নয়, এ টি স্নেক্সবার। তার এখান থেকে অনলাইন অর্ডার গ্রহণসহ স্পট সুবিধা ও বিদ্যমান। এখানে জলপান, চাউমিন, গরম পিৎজার চামচ হাতে নিয়ে জিরোতে-জিরোতে নানা স্বাদের একেবারে ফ্রীতে বই পড়া যায়।
চমকটি হচ্ছে বই পড়ে পড়া শেষ হোক বা শুরু হোক। পছন্দ হয়েছে বইটি! শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথে বইটি প্যাকেট করে একান্ত ফ্রীতেই বইটি দিয়ে দেওয়া হয়।
এই হচ্ছে আকাশ মনের মনজুর। এ জন্য ছেলেটিকে ছাড়তে রাজি নই। তার সাময়িক সময়কে শ্রদ্ধায় মুড়িয়ে সে কী ছিলো খুঁজি না।
তবে ভবিতব্যে এ জাতীয় মানুষকে দেখি পরের জন্য যতো জমি রেখে যাক না কেনো। এসব মানুষের সাড়ে তিন বাড়িতে মাটির দেওয়াল কাজে লাগে না। সমুদয় দোকানের, বিশাল বাগানের ফুলের পাপড়িতেই দেওয়াল হয়ে যায়!
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক