বাংলায় দুর্ভিক্ষ ও বর্তমান বাংলাদেশ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ডিসেম্বর ২০২২, ৫:৩৩:৪১ অপরাহ্ন
রতীশ চন্দ্র দাস তালুকদার
ভিক্ষার অভাব মানে দুর্ভিক্ষ-এ সমাসবদ্ধ শব্দটি আমাদের সবারই জানা। যেখানে ভিক্ষার আকাল দেখা দেয় সেখানে দুর্ভিক্ষ তার ভয়াল থাকা বিস্তার করে। ১৩৫০ বাংলা তথা ১৯৪৩ সালে তৎকালীন বাংলায় যে প্রলয়ংকারী দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল তা ইতিহাসে পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে অভিহিত হয়ে থাকে, সেই ভয়াবহ আকালের সময় কলকাতা, ঢাকাসহ বড় বড় শহরে হাজার হাজার ভুখানাঙ্গা মানুষ ‘ফেন দাওগো মা’ এই আকুল আকুতি জানিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরত। তখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, ভাতের সামান্য ফেন ছাড়া অন্যকিছু ভিক্ষুককে দেওয়ার সামর্থ্যও মানুষের ছিল না। বাণিজ্য করতে এসে এদেশের কিছু চক্রান্তকারীর যোগসাজশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বণিকের মানদন্ড যখন রাজদন্ড রূপে আবির্ভূত হয়, তখন তাদের শোষণ নির্যাতনে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে সত্তর ও আশির দশকে বাংলায় ভয়াল দুর্ভিক্ষ আঘাত হানে। এর ফলে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
অধিকাংশ ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন, ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বে বাংলা ছিল সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা স্বর্ণপ্রসূ বঙ্গভূমি, তখন এদেশ ছিল আর্থিকভাবে খুব সমৃদ্ধ এবং এখানে কখনো দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যায়নি। তবে অর্থনীতিবিদগণ এমতের বিরোধিতা করেন। তারা বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন ও প্রাচীন কাব্যগাথা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় দুর্ভিক্ষের নির্ভরযোগ্য প্রমাণ রয়েছে। তবে মধ্যযুগের রাজা বাদশারা এ দেশকেই স্বদেশভূমি ভাবতেন। প্রজাপীড়ন করে সংগৃহীত সম্পদ বিলাস ব্যসনে, বিভিন্ন স্থাপনা যেমন রাজপ্রাসাদ, মসজিদ, মন্দির নির্মাণে ব্যয় করতেন। ফলে দেশের আমজনতাই উপকৃত হতো। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন,
‘Taxation raised by a Ring is like the moisture of the earth sueked up by the sun, to be returned to the earth as fertlising rain.’
কিন্তু ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন প্রতিষ্ঠার পর খাজনা আদায়ের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায় এবং আদায়কৃত অর্থ মানুষের কল্যাণে ব্যয় না করে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে ইংল্যাণ্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে এদেশের মানুষ নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হতে থাকে এবং ১৭৬৯-৭০ সাল অর্থাৎ ১১৭৬ বাংলায় খরায় ফসলের ক্ষতি হওয়ায় ভয়ানক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ দুর্ভিক্ষ ইতিহাসের পাতায় ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে লিপিবদ্ধ আছে। এ মন্বন্তরে বাংলার একতৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে যায়। তারপর আশির দশকের মাঝামাঝি আবার বাংলায় দুর্ভিক্ষ প্রবলভাবে থাবা বিস্তার করে এবং এই দুই দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসে দেশের অর্ধেক মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এ দেশসহ বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে পাঠানো অর্থ সম্পদে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে ইংল্যাণ্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটে। তখন সেদেশের মানুষের জীবনমান উন্নত হয়। কিন্তু তাদের উপনিবেশ সমূহের মানুষ বার বার খাদ্যাভাবের কঠোর আঘাতে পর্য্যুদস্ত হয়েছে। প্রায় দুশবছরের ইংরেজ শাসনকালে অনেকবারই এদেশে দুর্ভিক্ষ হানা দিয়েছে এবং বহু মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে। সর্বশেষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ১৯৪৩ সালে যে প্রলয়ংকরী আকাল দেখা দিয়েছিল এর ভয়াবহতার তুলনা ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের পূর্বে বাংলায় চাউলের দাম ছিল মণপ্রতি ৪ টাকা, কিন্তু ১৯৪৩ সালে এ দাম গিয়ে দাঁড়ায় মণপ্রতি ১৬ টাকায়। বিখ্যাত সাংবাদিক মধুশ্রী মুখার্জি পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে গবেষণা করে দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক যুদ্ধের দুঃসময়ে বাংলার মানুষের কথা চিন্তা না করে এদেশ থেকে তাদের সাম্রাজ্যভুক্ত অন্যান্য দেশে চাল রপ্তানি করেছে। ফলে এ দেশে খাদ্যঘাটতি ঘটেছে। আবার জাপানিরা বার্মা দখল করার পর জাপানি বাহিনীর অগ্রগমন রোধ করতে হাজার হাজার নৌকা জব্দ করে ধ্বংস করেছে। পরিণতিতে, বার্মা থেকে খাদ্য আমদানি যেমন বন্ধ হয়েছে, সেই সাথে দেশের অভ্যন্তরে খাদ্য পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ফলশ্রুতিতে দুর্ভিক্ষের প্রকোপ প্রকট আকার নিয়েছে এবং ধারণা করা হয়, প্রায় ৩.৮ মিলিয়ন মানুষ দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে।
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে চার্চিল যে ন্যাক্কারজনক ও ঘৃণ্য মন্তব্য করেছিলেন তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। তিনি ভারতে উচ্চহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকেই দায়ী করেছিলেন এবং বলেছিলেন ‘ওহফরধহ’ং বিৎব নৎববফরহম ষরশব ৎধননরঃং’. খাদ্যঘাটতির ফলে এ দুর্ভিক্ষ হয়েছে এ ধরনের প্রশ্নের উত্তরে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ঐড়ি রভ ঃযব ংযড়ৎঃধমবং বিৎব ংড় নধফ, গধযধঃসধ এধহফর ধিং ংঃরষষ ধষরাব’. পঞ্চাশের মন্বন্তরের ন্যায় এমন প্রাণঘাতী ও হাহাকারময় আকাল নিয়ে যে ব্যক্তি এমন জঘণ্য উক্তি করতে পারেন, তিনি যে একজন মানবিকতা বিবর্জিত ঘোর সাম্রাজ্যবাদী তা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। ইণ্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনলজী (ওওঞ) গান্ধীনগরের একদল বিজ্ঞানী ১৮৭৩ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত যে যে বছরে বাংলা এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, সে বছরের খরা ও অনাবৃষ্টির বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন। সেসময় গ্রামাঞ্চল তো দূরের কথা, অনেক বড় শহরেও বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না। তাই ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে জমি সেচের সুযোগ ছিল অকল্পনীয়। ফলে যে বছর খরা ও অনাবৃষ্টি হতো, সে বছর ফসল উৎপাদনে বিঘ্নিত হতো এবং দেশে চরম খাদ্যাভাব দেখা দিতো।
গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন ১৮৭৩ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত যে ছয় বছর দেশে আকাল দেখা দিয়েছিল তার মধ্যে প্রথম পাঁচটির সাথে খরার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল ১৯৪৩ সালের মহামন্বন্তর। এ বৎসর ফসল উৎপাদন স্বাভাবিক ছিল। ড. বিমল শর্মার নেতৃত্বে গঠিত বিজ্ঞানীদলের অভিমত, মহাযুদ্ধের সময় বাংলার মানুষের খাদ্য সমস্যা নিরসনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকারের নীতি ব্যর্থতাই (চড়ষরপু ভধরষঁৎব) এ দুর্ভিক্ষের অনুঘটক। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিককার এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিককার কয়েকটি দুর্ভিক্ষের সময় অনাবৃষ্টির ফলে ফসলহানি ঘটেছিল। তবে এটাও সত্য সাম্রাজ্যবাদী সরকার মানুষের জীবন বাঁচাতে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে হাজার হাজার মানুষ অনাহারে, অর্ধাহারে ও অপুষ্টিতে প্রাণ হারিয়েছে। আসলে ঔপনিবেশিক সরকার তো তাদের প্রজাদের মানুষ বলে গণ্য করতো না। পঞ্চাশের মন্বন্তরের পর উইনস্টন চার্চিল যেমন ভারতের মানুষকে খরগোস বলে তিরস্কার করেছিলেন, ঠিক তেমনি তাঁর পূর্বসূরীরাও তাদের বিশাল সাম্রাজ্যের মানুষকে নিশ্চয় তাই ভাবতেন।
১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশও এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়েছিল। এ দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে অনেকগুলি বিষয় চিহ্নিত করা যায়। ১৯৭১ সালে পাকহানাদার বাহিনী এদেশের রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্টসহ প্রায় সকল অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয় যা যুদ্ধপরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ২-৩ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়নি। ফলে ১৯৭৪ সালে জুন মাস থেকে যখন দীর্ঘস্থায়ী বন্যা দেখা দেয় তখন দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং সেই সাথে আউশ ও আমন ধান উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিউবাতে পাট রপ্তানির অজুহাত দেখিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২.২ মিলিয়ন টন খাদ্য সাহায্য হঠাৎ করে স্থগিত করে দেয়। তবে সরকারের কাজকর্মের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও সে দুর্ভিক্ষের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছিল তা বোধ হয় অস্বীকার করা সম্ভব নয়। সে সময় সীমান্ত দিয়ে খাদ্যশস্য চোরাচালানের খবরও প্রচার হতো। এ আকালে বর্তমান রংপুর বিভাগটিই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তখন সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন স্থানে লঙ্গরখানা খুলে কয়েক মিলিয়ন মানুষের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হত, কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক মানুষ অনাহারে বা অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে মৃত্যুবরণ করে। ১৯৭৪ সালের এ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর স্থায়ী সরকারের একটি ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হয়।
চীনের উহান থেকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে আবির্ভূত মারণ ভাইরাস করোনার ছোবলে প্রায় দুই বছরের অধিককাল সারা বিশ্ব ছিল বিধ্বস্ত ও পর্যুদস্ত। এখনও যে বিলীন হয়ে গেছে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির পরিসংখ্যানে যাহাই উল্লেখ থাকুক না কেন, এটা অনেকেই বিশ্বাস করেন প্রায় ১০০ কোটি মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং আনুমানিক ১ কোটি মানুষ এর মারণাঘাতে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছেন। এর অভিঘাতে বিশ্বের অর্থনীতিতে নেমে এসেছে বিশাল ধস। কোভিড পূর্বকালে আমাদের দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল বিশ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু এখন অনেকেই অনুমান করেন, এ হার হয়তো ৪০% এর উপরে উঠে গেছে। এছাড়া দেশে আয় বৈষম্যও প্রকট আকার ধারণ করেছে। তবে পরিতাপের বিষয় এই যে, কোভিডের তীব্রতা প্রশমিত হয়ে আসতে না আসতেই মনুষ্যসৃষ্ট এক মহাদুর্যোগ সারা পৃথিবীকে তছনছ করে দিচ্ছে। প্রাক্তন এক পরাশক্তির হৃত আসন ফিরে পাওয়ার অভিলাষে এবং বর্তমান একমাত্র পরাশক্তির প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় অনাকাক্সিক্ষত এক যুদ্ধে বিশ্বের অর্থনীতি আজ মহাসংকটের সম্মুখীন। অনভিপ্রেত রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, সেই সাথে কলকারখানায় উৎপাদনও বিঘ্নিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, কৃষিতে সেচের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
আমরা জানি, রাশিয়া হলো বিশ্বের প্রধান গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ। এছাড়া ইউরিয়া সারের প্রায় ২৫% রাশিয়া রপ্তানি করে থাকে। ফলে বিশ্বব্যাপি সারের যোগানও বাধাগ্রস্ত হবে এবং এর প্রভাবে বাংলাদেশের মত দেশের কৃষি উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাবে। শস্য ভাণ্ডার বলে খ্যাত রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বিশ্বের চাহিদার প্রায় ৩০% গম এবং ৮০% সূর্যমুখী তেল রপ্তানি হয়। যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে এবং দরিদ্র ও উন্নয়নশীল অনেক দেশেই খাদ্য ঘাটতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ) আশঙ্কা করছে, বিশ্বের প্রায় ৪৫টি দেশে ২০২৩ সালে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে এবং কোন কোন দেশে দুর্ভিক্ষও হতে পারে। ঋঅঙ এর পূর্বাভাসকৃত ৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নামও রয়েছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০২৩ সালের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে জনগণকে বার বার সতর্ক করছেন এবং অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির তাগিদ দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য নিয়ে অবশ্য কেউ কেউ বিরূপ সমালোচনা করেন, তবে আমার কাছে এ সতর্কবার্তা ইতিবাচক বলেই মনে হয়। বৈশ্বিক এ মহাদুর্যোগের মধ্যে আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণ এক সংকট ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। দেশে জাতীয় নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে হবে বলে ধারণা করা হয়, কিন্তু এখন থেকেই সরকারি দল ও বিরোধীদল বড় বড় সমাবেশ করে সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র বাক্যবান নিক্ষেপ করে চলেছে। কেউ বলছে, আন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারকে হঠিয়ে দেবো, আবার সরকারি দল বলছে আগামীতে দেশে ‘খেলা’ হবে। এই ‘খেলা হবে’ স্লোগানটি জনপ্রিয় করেছেন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের একজন মুখ্যমন্ত্রী। তবে আমাদের সরকারি দলেরই একজন বর্ষীয়ান নেতা যিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যুবনেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, তিনি ‘খেলা হবে’ এই রাজনৈতিক স্লোগান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মহাসমাবেশ করছে এটা ঠিক, কিন্তু এতে দেশের সাধারণ জনগণ কতটা সম্পৃক্ত হচ্ছে এটা বোধ হয় ভেবে দেখছে না। দেশের আমজনতার এখন ‘দিনে আনি দিনে খাই’ অবস্থা। তারা দুই দলের আন্দোলনের মধ্যে চিড়ে চ্যাপ্টা অবস্থায় ঈশপের গল্পের সেই ব্যাঙের মত ডাক পাড়ছে।
যে মহাবিপর্যয় ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে দশ নম্বর বিপদ সংকেতের আভাস দিচ্ছে, তা থেকে উত্তরণ তখনই সম্ভব হবে যদি যুদ্ধের দামামা স্তব্ধ হয়। কিন্তু এর তো কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছেন। তাই আগামী বছর দেশের অর্থনীতিকে বিপদমুক্ত রাখতে হলে অবশ্যই কৃচ্ছতার পথে হাঁটতে হবে। দেশের খাদ্য উৎপাদন অনেক বেড়েছে, সুতরাং দেশের খাদ্য সংকট মোকাবেলার একমাত্র ভরসা আমাদের কৃষক সমাজ। তবে বীজ সেচের পানি ও সারের সহজলভ্যতা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। দেশে আমন উৎপাদন আশানুরূপ হয়েছে কিন্তু বোরো ধান যাতে নির্বিঘ্নে কৃষকের গোলায় উঠতে পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমন ও বোরো উৎপাদন যথার্থ হলে হয়ত দেশে খাদ্য সংকট হবে না, তবে যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে অনেক শিল্প শ্রমিক বেকার হবে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত অনেক লোক কর্মহীন হয়ে পড়বে। তাদের হয়ত খাদ্য কিনে খাওয়ারও সামর্থ্য থাকবে না। ড. অমর্ত্য সেন ‘চড়াবৎঃু ধহফ ভধসরহব’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবে হয় না, হয় ক্রয়ক্ষমতার অভাবে এবং খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে’। সুতরাং ক্রয়ক্ষমতা হারানো প্রতিটি মানুষের খাদ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা সরকারকে করতে হবে। তাহলে হয়ত মহাসংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব হতে পারে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, এমসি কলেজ।