কালজয়ী নারী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ডিসেম্বর ২০২২, ৫:৪০:৩৬ অপরাহ্ন
ফজলুর রহমান ফজলু
দানবীর ড. রাগীব আলীর পত্নী বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী এক কালজয়ী নারী। তিনি আপন কর্মে দুনিয়াতে অমরতার ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। আমি দানবীর রাগীব আলীকে বাস্তবে যতটুকু জানি বেগম রাবেয়া সম্পর্কে ততটুকু জানিনা। তবে লোকমুখে বেগম রাবেয়া সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি তাতে বুঝতে পেরেছি, বেগম রাবেয়া সত্যিকার একজন গুণবতী মহিলা। সত্যবাদিতা, পরোপকারিতা, বদান্যতা, আতিথিয়তা সর্বোপরি মানব প্রেম, সেবা, ও কল্যাণে স্বীয় প্রতিভাবলে তিনি এক কালজয়ী মহীয়সী রমণী। এ সম্পর্কে দানবীর ড. রাগীব আলীর কোম্পানী বাংলোর একজন বয়স্ক লোককে জিজ্ঞাসা করলে তিনি আমাকে যা বলেন, আপনি তো শুধু রাগীব আলীর মানবপ্রেম দেখেছেন বেগম রাবেয়ার মানবতা দেখেন নি। সত্যি বলতে দানবীর রাগীব আলীর চেয়েও আর্ত মানবতা, বদান্যতা সবকিছুতেই বেগম রাবেয়া ছিলেন অগ্রগণ্য। তিনি দুঃখির মুখে হাসি ফুটাতেন, নিজের হাতে কাজ করতেন, স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়তা করতেন। বেগম রাবেয়া ছিলেন পরেজগার, নামাজী, পতীপ্রেমী। দানবীর রাগীব আলীর সর্বকাজে তিনি সার্বিক সহযোগিতা করতেন। পরের ছেলে সন্তানদের তিনি নিজের সন্তানের মত আদর করতেন। বাগানের শ্রমিকদের সাথে ছিল তাঁর আত্মিক সম্পর্ক। তিনি নিজ হাতে তাদের মুখে অন্ন তুলে দিতেন। রোগে শোকে তাদের খবর রাখতেন। বেগম রাবেয়ার মধ্যে কোন অহংকার ছিল না। তিনি নিতান্ত সাধাসিধে জীবন যাপন করতেন। দেশের শ্রেষ্ঠ শিল্পপতির পত্নী হয়েও সর্বাবস্থায় অতি সাধারণ কাপড় পরিধান করতেন। বিলাস জীবন ছিল তার কাছে অনর্থক।
১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে বিয়ে করার জন্য বিলাত থেকে দেশে এলাম। শুরু হলো পাত্রী খোঁজা। বেশ কয়েক জায়গায় পাত্রী দেখা হলো। কিন্তু একদিকে মিললে অন্য দিকে মিলেনা। বাবা-মার ইচ্ছে পাত্রীর বংশ ভাল হতে হবে। পাত্রী শিক্ষিত হতে হবে, সুন্দরী হতে হবে। আমার মনেও নানান কিছিমের খুত-খুতানি। যে চোখ বিলাতি মেম দেখেছে সে চোখ যেমন তেমন কইন্যায় সন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। আকারে-ইঙ্গিতে ময়মুরব্বীদের একথাও জানিয়ে দেই। সে সময় খান্দানী পরিবারগুলো প্রবাসী দামান্দের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তারা মনে করতেন, বিয়ের পর মেয়ে বিদেশে গিয়ে পর্দা পুশিদা মত চলবে না। ইহুদী-নাসারার মতো চলাফেরা করবে। এর উপর অন্য এক কারণেও প্রবাসী দামান্দের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে তারা অনিচ্ছুক ছিলেন তা হলো বিয়ের পর মেয়েকে দেশে ফেলে রেখে দামান্দের দীর্ঘদিন বিদেশ অবস্থান করা ইত্যাদি। এখন অবস্থা পাল্টে গেছে। লন্ডনী দামান্দ কইন্যা এখন সোনার হরিণের মতো। লন্ডনী দামান্দ-কইন্যার বিয়ে শাদী নিয়ে ব্যবসা-তেজারত শুরু হচ্ছে বলে শোনা যায়। অথচ এক কালে বিয়ে শাদী ছিল দুটি পরিবারের কুটুম্বিতার সেতুবন্ধন। বেশ কয়েক জায়গায় পাত্রী দেখার পর রামপাশার জমিদার দেওয়ান ওহীদুর রাজা চৌধুরী সাহেব ও গোলাপগঞ্জের রনকেলী উচা বাড়ীর আব্দুল হান্নান চৌধুরী বিয়ের আলাপ দিলেন সিলেট শহরের আম্বরখানা (রায় হোসেন) পাক্কা বাড়ীতে। সিলেট শহরের ঐতিহ্যবাহী পরিবারের মধ্যে রায় হোসেন মহল্লার মাহফিজ হাউজ অন্যতম। এ পরিবারের আদি পুরুষ হযরত শাহ্জালাল (র:)’র অন্যতম সঙ্গী হযরত চেরাগ রওশন (র:)। পাত্রীর দুই ভাই ছয় বোন। ভাই ইলিয়াছ চৌধুরী ও রফিক চৌধুরী। বোন আসগরী খাতুন চৌধুরী (রানী) স্বামী দেওয়ান আব্দুল ওয়াছেহ, ইটা, রাজনগর মৌলভীবাজার। আকবরী খানম চৌধুরী (মনি) স্বামী আশিকুর রহমান, দক্ষিণ রাইগদাড়া, বালাগঞ্জ। রাবেয়া খাতুন চৌধুরী (লনি), স্বামী রাগীব আলী, তালিবপুর বর্তমানে রাগীব নগর বিশ্বনাথ, সিলেট। আনোয়ারা খাতুন চৌধুরী, কামরুজ্জামান, মৌলভীবাজার। খোদেজা খাতুন চৌধুরী, স্বামী ডা: আব্দুল মালিক সাহবাগ, জকিগঞ্জ, সিলেট।
উল্লেখ্য বোনদের মধ্যে রাবেয়া খাতুন চৌধুরী তৃতীয়। রাবেয়া তখন সিলেট মহিলা কলেজের আই. এ শ্রেণীর ছাত্রী এবং আই এ পরীক্ষার্থী। বিয়ে হওয়ার পর লন্ডন চলে যাওয়ার দরুন তিনি পরীক্ষা দিতে পারেননি।
তখনকার সময়ে আমাদের এলাকার যাতায়াতের দুরবস্থা সম্পর্কে ইতিপূর্বে এ বিষয়ে কিছুটা বর্ণনা করেছি। তাই এখানে এ বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই। বিয়ের তারিখ ধার্য হয় ২৯ মার্চ ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দ শুক্রবার। কাবিন দশ হাজার এক টাকা।
বিয়ের দিন অনেক বরযাত্রীসহ পাল্কীতে চড়ে রওয়ানা দিলাম। গরমের দিন। ইজার আচকান পাগড়ী সব মিলিয়ে গরমে আলু সিদ্ধ হওয়ার মতো। বুঝলাম, বিয়ে করা সহজ নয়। চার বেহারায় পাল্কী। মালাকোচা মারা ধূতি পড়া উদাম গতরের গাট্রা-গোট্রা বেহারাগণ বয়ে নিচ্ছে আমাকে। হয়রান হয়ে গেলে জিরান নেয় পাল্কী থামিয়ে। পেছনে বৈরাতীর দল। অনেকের মাথায় ছাতি। এভাবে লামা হাজরাই পর্যন্ত গেলাম। সেখান থেকে ভাড়া টেক্সি ও বাসে সিলেটের পথে। বেলা ১২টার সময় পৌঁছলাম রায় হোসেন মহল্লার পাক্কা বাড়ী মাহফিজ হাউসে। বাড়ীর আঙ্গিনায় সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে দামান্দ বৈরাতী সবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গেইট বাঁধা হয়েছে জাকজমক ভাবে। শালাশালী সম্পর্কের ছেলে মেয়েরা আটকালো গেইটে। গেইট সালামী দাবী করা হলো দশ হাজার টাকা। উল্লেখ করা প্রয়োজন, তখনো সিলেট টাউনে কমিউনিটি সেন্টারের প্রচলন হয়নি, বিয়েশাদী সিন্নি জিয়াফত নিজ নিজ বাড়ীর আঙ্গিনা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হতো। গেইটে আটকে রাখা হলো প্রায় আধঘন্টা। ওদের দাবী, লন্ডনী দামান্দ। বিয়ে করতে এসেছেন সিলেটের একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারে। গেইট সালামীর দাবী দশ হাজার টাকাই দিতে হবে। আমাদের পক্ষের লোকরা শহরের চালাকচতুর ছেলে মেয়েদের সাথে যুক্তিতর্কে সুবিধে করতে পারলোনা। শেষ পর্যন্ত অনুনয় বিনয়, দরদামের পর পাঁচ হাজার টাকায় আপোস রফা করে বাড়ীতে প্রবেশ করলাম। বিয়ে পর্বের পয়লা মুশকিলের আছান হলো। বিয়ের মজলিশে গণ্যমান্য অনেকেই ছিলেন। তাদের সবার নাম এখন মনে নেই। আমাদের পক্ষে ছিলেন রামপাশার জমিদার দেওয়ান অহিদুর রাজা চৌধুরী, রনকেলির আব্দুল হান্নান চৌধুরী, রাজা হাইস্কুলের হেড মাস্টার মোহাম্মদ সুরুজ আলী প্রমুখ। কনে পক্ষে তাদের আত্মীয় স্বজন ছাড়াও ছিলেন যুগভেরী সম্পাদক আমীনূর রশীদ চৌধুরী এবং আরো অনেকে। আকদ সম্পন্ন হতে বেঁজে গেল বেলা দুটা। এরপর রুসুম রেওয়াজ, খানা পিনা শেষ হতে বেলা তিনটা বেজে গেল। যে ভাবে এসে ছিলাম সেভাবেই বাড়ীর পথে রওনা দিলাম। কনেকে আনার জন্য লামাহাজরাইতে রাখা হয়েছিল আরেকটি পাল্কী। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয় মাফা। বেগার বা বেহারা চারজন। বাড়ী পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এতদিন ছিলাম একা-এখন আরেকজন হলেন জীবন সাথী। দুয়ে মিলে এক। এইতো জীবন, যা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।
মনে ভয় ছিল একটি অভিজাত পরিবারের মেয়ে হঠাৎ শহর থেকে গ্রামে এসে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারবে কিনা। আল্লাহর রহমতে রাবেয়া নিজগুণে তার শ্বশুড় শাশুড়ী দেবর ভাসুর আত্মীয় স্বজনকে আপন করে নিলেন। মাইজি অনেক খুশি হলেন তার পুত্রবধুর আচার ব্যবহারে। মনে যে ভয় ছিল তাও কেটে গেল। বুঝলাম আল্লাহতা’য়ালা আমাকে এক গুণবতী স্ত্রী রত্ন দান করেছেন। আমি কর্ম পাগল মানুষ। স্ত্রীকেও পেলাম আমার সকল কাজের সাথী হিসেবে। বলতে দ্বিধা নেই আমার জীবনের সব কাজের সফলতার শরীক আমার স্ত্রী রাবেয়া খাতুন চৌধুরী। তিনি আমার কোন কাজে বাধার সৃষ্টি না করে উৎসাহ প্রেরণা সহযোগিতা করে চলেছেন জীবন ভর। তার সম্পর্কে
বিস্তারিত লিখতে হলে পৃথক বই লেখার প্রয়োজন হবে। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের দরবারে প্রার্থনা করি তিনি যখন মেহেরবানী করে আমাদের দুনিয়ার জীবনে সুখি করেছেন পরজীবনেও যেন আমাদের প্রতি মদদ ও মেহেরবানী করেন। তাঁর রহমতের ছায়ায় ঠাঁই দেন।
শহরের মেয়ে হঠাৎ করে গ্রামে এসে রাবেয়া বেশ অসুবিধায় পড়েছেন বুঝতে পারলেও করার কিছু নেই। পানির মাছকে শুকনায় তুললে যে অবস্থা হয় রাবেয়ারও সেই অবস্থা হলো। ফ্যান নেই। বিদ্যুৎ নেই। বৈশাখ জৈষ্ঠ্যমাসের গরম। সব মিলিয়ে একেবারে বেহাল অবস্থা। রাবেয়াকে ধন্যবাদ দিলেই তার পাওনা পরিশোধ হবে না। এতসব অসুবিধার মাঝেও তাকে বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখিনি কোনদিন। বাবা বাজার থেকে বড় বড় মাছ আনেন। পিঠাচিড়া হয় প্রতিদিন। এক কথায় বাড়ীতে খুশির আমেজ। মাইজি সব সময় পুতের বউর কাছে কাছে থাকেন। আফসোস করেন, শহরের মেয়ে গ্রামে এসে কষ্ট করছে মনে করে। এমনি করে মাস দু’য়েক চলে গেল। বিলাতে রেষ্টুরেন্ট ফেলে এসেছি। বেশী দিন দেশে থাকা উচিত হবে না। যত তাড়াতাড়ি বউকে নিয়ে চলে যেতে পারি এর ব্যবস্থা করতে লাগলাম। যথাসময়ে রাবেয়ার পাসপোর্ট ভিসা যোগার করে বিলাত চলে গেলাম। সবাই অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় দিলেন। বিদায়ের দিনে এক করুন পরিবেশের সৃষ্টি হলো। মাইজি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন আমাদের সাথে আমার বড় ভাই মরহুম মনোয়ার আলীর দ্বিতীয় ছেলে আব্দুল কাদিরও বিলাত গিয়েছিল। তখন তার বয়স নয় বৎসর। পরবর্তীতে আমার মেয়ে রেজিনা খাতুন কে তার সাথে বিয়ে দেই আমার মা রাবেয়া বানুর ঘটকালিতে। ১৯৬৩ সালের সুখ স্বপ্ন ঝরে যায় ২০০৬ সালের ১২ ই ডিসেম্বরে। আমাকে একা রেখে রাবেয়া চলে যায় পরপারে। মহান আল্লাহপাক তাকে জান্নাত নছিব করুক।
পাঠকগণ আপনারা নিশ্চয় দানবীর ড. রাগীব আলীর জবাবনীতে বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর পরিচয়, পরিণয়, গুণাবলী সবকিছু জেনেছেন। আর এ মহীয়সী রমণীর মানবতার কল্যাণে যে সমস্ত কাজ করে গেছেন তার বর্ণনা এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়। সোজা কথায় আপন কর্মে তিনি এক কালজয়ী রমণী। আমরা তার বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।
লেখক : পরিচালক, রাগীব রাবেয়া রিসার্চ সেন্টার ও সাধারণ সম্পাদক জকিগঞ্জ সাহিত্য সংসদ (জসাস)।