আজও তিনি আমার অনুপ্রেরণার উৎস
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ডিসেম্বর ২০২২, ৫:৫১:৩৪ অপরাহ্ন
ড. রাগীব আলী
কিছু মানুষের মৃত্যু আপনার পুরো পৃথিবীকে শূন্য বানিয়ে দিতে পারে।’ -একজন মণিষী বলেছেন কথাটি। কথাটির মর্মার্থ উপলব্দি করেছি আমি আজ থেকে ১৬ বছর আগে আজকের এই দিনে। সেদিন আমার কাছ থেকে দূরে চলে যান আমার কর্মময় জীবনের একান্ত সঙ্গী, যেখান থেকে কেউ ফেরে না কোন দিন, সেই অনন্ত-অসীমের সান্নিধ্যে চলে গেছেন আমার সহধর্মিণী আমার সব কাজে অনুপ্রেরণার উৎস রাবেয়া খাতুন চৌধুরী। সেই দিন থেকে আজ অবধি প্রতিটি মুহূর্তই এই পরম সত্যিটাকে অনুভব করছি। তার সঙ্গে এটাও অনুভব করছি- জন্ম যেমন সত্য, মৃত্যুও তেমনি অবধারিত। মানুষের জীবননদীর ধারা এক সময় থেমে যাবেই। অর্থাৎ নদীর ধারার সঙ্গে মানুষের জীবনের অপূর্ব সামঞ্জস্য রয়েছে। এই কঠিন বিধান কেউ লংঘন করতে পারবে না। এই নিয়মের নিগড়ে বন্দি মানবজাতিসহ প্রাণিকূল।
আজ থেকে ১৬ বছর আগে আজকের এই দিনে এমনি হেমন্তের বিদায়লগ্নে ঘটেছে সেই বিয়োগান্তক ঘটনা; যদিও তা অমোঘ সত্য, তবুও তা আজও মেনে নিতে কষ্ট হয়। রাবেয়া খাতুন চৌধুরী ছিলেন আমার সব কাজে অনুপ্রেরণার উৎস। সত্যি বলতে কি তিনি আমার কর্মময় জীবনের ছায়াসঙ্গী হয়ে আছেন এখনও। ইতোমধ্যেই চলে গেছে এক যুগের বেশি সময়; কিন্তু মনে হয়-এইতো সেদিন তিনি ছিলেন আমার পাশে, অবচেতন মুহূর্তে মনে হয় এখনও তিনি আছেন আমার সাথেই। এই স্মৃতিগুলো তাড়িয়ে ফেরে আমাকে সর্বক্ষণ। কারণ স্মৃতি সেটা সুখের কিংবা কষ্টের হোক, প্রতিটি মানুষকেই আবেগ-তাড়িত করে। আমি কর্মেই ব্যস্ত থাকতে চাই; আমি বিশ্বাস করি সৎ কর্মেই মুক্তি, কর্মেই পাওয়া যায় স্রষ্টাকে। তাইতো জনসেবায় নিবেদিত রয়েছি সারা জীবন। আমার সময় কাটে দেশ, সমাজ আর রাষ্ট্রের কল্যাণে গড়ে তোলা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কর্মযজ্ঞে। জনকল্যাণে গৃহীত বিভিন্ন পরিকল্পনা এবং গরীব-দুঃখীদের সাহায্যে যখন নিজেকে ব্যস্ত রাখি, তখনই তার অস্তিত্ব অনুভব করি। যখন আমার কর্মে-সাধনায় অনাকাংখিত প্রতিবন্ধকতা আসে, যখন চলার পথ কণ্ঠকাকীর্ণ হয়ে ওঠে, তখনই চিত্রপটে ভেসে ওঠে তাঁর ছবি। তিনি যেন পরপারে থেকেও আমাকে সব বাধা টপকানোর শক্তি-সাহস দিয়ে যাচ্ছেন, অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর উৎসাহ-উদ্দীপনা ও প্রাণচাঞ্চল্যের মুহূর্তগুলো আজও অনুভব করি মরমে। মনে হয় তিনি ছিলেন, আছেন এখনও।
প্রতি বছরই আজকের দিনটি পালন করা হয় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে। স্বজন-অনুরাগীরা আয়োজন করেন কবর জিয়ারত, দোয়া মাহফিল, স্মরণসভাসহ নানা অনুষ্ঠান। একজন নিরহংকারী সরল জীবন যাপন অথচ উদার মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর চিন্তা-চেতনায় সব সময়ই ছিলো মানুষের কল্যাণে ভালো কিছু করার। সেটা হয়েছেও। তাঁর চিন্তার সঙ্গে আমার পরিকল্পনার সমন্বয় ঘটিয়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে মানবসেবার লক্ষে গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্প। এর স্বাক্ষর বহন করে রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, লিডিং ইউনিভার্সিটিসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান। এইসব প্রতিষ্ঠান মানবের কল্যাণে-সমাজ উন্নয়নে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখছে নিঃসন্দেহে। এই সেবাকর্ম অব্যাহত থাকবে আগামীতেও। তাই প্রতি বছরই তাঁর মৃত্যু দিবসে তাঁকে স্মরণ করেন সর্বস্তরের মানুষ; তারা দোয়া করেন অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। এতে করে আমার বিশ্বাস সুদৃঢ় হয় যে, জনকল্যাণে খালিস নিয়তে কাজ করলে তার বিনিময় দুনিয়া-আখেরাতে পাওয়া যায়। আল্লাহর দরবারে এই মানুষদের মোনাজাত বিফলে যাবেনা।
সৃষ্টিকর্তার বিধান এই যে, পৃথিবীতে আমরা সকলেই ক্ষণস্থায়ী। পরকালীন জীবন অসীম। সেই পরকালীন অসীম জীবনে শান্তির জন্য ইহকালে স্বল্প সময়টুকুই ভালো কাজে কাটাতে হয়; স্রষ্টার এই অমোঘ নির্দেশনাকে আরাধ্য করেই রাবেয়া খাতুন চৌধুরী কাটিয়েছেন সারা জীবন। এটি যে কোন মানুষের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তাঁর প্রতিটি মৃত্যুবার্ষিকীতেই যখন স্মৃতি রোমন্থন করি, তখন নতুন করেই যেন ভালো কাজের উৎসাহ পাই।
আমার স্মৃতিতে আজও জ্বলজ্বল করছে তাঁর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রাক্কালের অনেক কথা। তখন আমার মনে সংশয় ছিলো শহুরে পরিবেশে বেড়ে উঠা রাবেয়া খাতুন চৌধুরী বিয়ের পর গ্রামীণ পরিবেশকে আদৌ মেনে নেবেন কি-না, এ নিয়ে। কিন্তু আমার সব শঙ্কার অবসান ঘটলো যখন দেখলাম তিনি আমার বাড়ি এবং পরিবারে সকলের সঙ্গে খুব সহজেই মানিয়ে নিয়েছেন, প্রিয় হয়ে ওঠেছেন সকলের। পরবর্তী জীবনে নানা ব্যস্ততায়ও পরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিলো অটুট। প্রকৃত অর্থে তাঁর গুণাবলী আমাকে শুধু মুগ্ধই করেনি, বরং আমি নিজেও তাঁর আচার-আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও গুণাবলী থেকে উপকৃত হয়েছি, অনুপ্রাণিত হয়েছি।
সবচেয়ে বড় কথা, একজন অতি উদার মনের মানুষ ছিলেন রাবেয়া খাতুন চৌধুরী। সমাজের জন্য, গরীব-দুঃখী মানুষের কল্যাণে ভালো কিছু করার তাড়না ছিলো তাঁর মধ্যে সর্বক্ষণ। তেমনি নিজের পরিবার পরিজনের প্রতিও ছিলেন গভীর মনোযোগী। তিনি যেমন ছিলেন একজন আদর্শ মা, তেমনি ছিলেন একজন আদর্শ গৃহিণী। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি সন্তানদের প্রতি ছিলেন দারুণ যত্নশীল। তাছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সকলস্তরের কর্মীদের তিনি নিজ পরিবারের সদস্যদের মতোই মনে করতেন। তাদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকতেন। যে কারণে যারাই তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন, তারা কখনও তাঁকে ভুলতে পারছেনা। তাই বিরল গুণাবলীর অধিকারী এই মহীয়সী নারী আজও স্মরণীয়; ভবিষ্যতেও স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর গুণমুগ্ধদের কাছে। আজ তাঁর মৃত্যু দিবসে সবার সঙ্গে আমিও আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করছি তাঁর আত্মার মাগফেরাতের জন্য।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশন।