আলো ছড়িয়ে গেছেন যিনি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ডিসেম্বর ২০২২, ৫:৫৬:২৪ অপরাহ্ন
জু্ইঁ ইসলাম
মানুষ তাঁর কর্মের মাঝেই বেঁচে রয়। তেমনিই একজন নারী যাকে এ সমাজ ভুলেনি আজও। তাঁর অবদানের শেষ নেই। নারীরা এগিয়ে যাক, নারীরা মশাল জ্বালিয়ে দুর করুক সমাজের সব অন্ধকার এমন চাওয়া আমার যেকোনো নারীর কাছেই কিন্তু আমাদের সমাজে সব নারী আলোর মশাল জ্বালাতে পারেন না। আজ এমনই এক নারীর কথা স্মরণ করে লেখাটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি যাকে এ সমাজের বেশিরভাগ মানুষই চিনেন, হ্যাঁ বলছিলাম আমাদের জন নন্দিত পত্রিকা ‘সিলেটের ডাকে’র সাবেক সম্পাদক রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর কথা।
একজন আলোকিত নারী মানেই আলোকিত একটি পরিবার, একটি সমাজ, একটি দেশ। রাবেয়া খাতুন চৌধুরী আমাদের নারী সমাজের কাছে এক আলোর ঝলকানি, এক উজ্জ্বল তারকা। তিনি হলেন এক মহিয়সী নারী। মহিয়সী নারীদের কথা লিখতে হয়, জানাতে হয় কারণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাদের মনে রাখা উচিৎ। একজন আলোকিত নারী মানে নারী জাতির অহংকার।
তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী, খ্যাতিমান শিল্পপতি ও সমাজসেবী রাগীব আলী সাহেবের সুখ-দুঃখের সাথী, জীবন চলার সঙ্গিনী। দানবীর, শিল্পপতি, সমাজসেবী জনাব রাগিব আলীর বর্নাঢ্য জীবনের নানান কর্মে তিনি যুগিয়েছেন অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা। একজন স্বামীর সিড়ি বেয়ে উঠার বা সফলতার পেছনে অবশ্যই একজন স্ত্রীর অনুপ্রেরণাই কাজ করে তা আমরা নির্ধিদায় বলতে পারি এক্ষেত্রে রাগীব আলীর সিড়ি বেয়ে উঠার পেছনে অবশ্যই রাবেয়া খাতুনের ভূমিকা যে ছিল তা সহজে অনুমেয়।
দানবীর রাগিব আলীর সহধর্মিণী রাবেয়া খাতুন চৌধরী ছিলেন একজন আদর্শ গৃহিনী। তিনি ছিলেন জনদরদী একজন দক্ষ সংগঠক। আত্মীয়-স্বজন গরীব-দুঃখী মানুষ পাড়া-প্রতিবেশী কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন অতিপ্রিয় শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র।
ব্যক্তিগত জীবনে বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী ছিলেন শান্ত শিষ্ট, সদ্যলাপী, বিনয়ী। একজন উচু মানের শিল্পপতির স্ত্রী হয়েও রাবেয়া খাতুন চৌধুরী অত্যন্ত সাধাসিধে জীবন যাপন করতেন। অঢেল অর্থ বিত্তের মালিক হওয়া সত্ত্বেও কোনদিন অহংকার অনুভূতও হয়নি তার চলা ফেরায় বা উঠাবসায়। গরীব দুঃখীদের পাশে দাঁড়াতেন তিনি খুব সহজেই। তিনি ছিলেন আমাদের নারী জাতির গর্ব ও অহংকার।
বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সমাজ ও দেশের জন্য যথেষ্ট কাজ করেছেন। আর্ত মানবতার সেবায় তিনি সারাক্ষণ নিবেদিত ছিলেন। তিনি বট বৃক্ষের মত ছায়া দিয়েছেন, আলোর জ্যুাতি ছড়িয়েছেন সমাজে। তাঁর দেওয়া বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা আজ দেশে বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। যারা দেশ ও দশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে কর্মরত থেকে পরিবার, সমাজ ও দেশের কল্যাণে নিবেদিত। তারই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শত শত কর্মকর্তা কর্মচারীদের সঠিক পথে পরিচালিত হতে পরামর্শ দিয়েছেন নিত্যদিন। কোনদিন কোন অন্যায়ের সাথে আপোস বা সমঝোতা করেননি তিনি।
পারিবারিক জীবনে বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী স্ত্রী বা মা হিসাবে অত্যন্ত ভাল ও দায়িত্বশীল ছিলেন। তবে আমাদের এ সময়ের জন্য তাঁকে মূল্যায়ন করতে হবে চরিত্র বিচারে। তিনি সেবার অঙ্গনে প্রত্যক্ষ বিচরণ করেছেন, সেবা দান করার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন, সেবা দান করেছেন বিভিন্ন ভাবে আর এজন্যই তার মৃত্যুর পর জানাজায় হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতির ঢল নামে সিলেটের লোকমুখে শুনি যা আজও। মানুষের এমন ভালবাসা দেখে অবশ্যই একজন স্বামীর আত্মতৃপিততে মন ভরে উঠারই কথা।
একটা সময় শোনা যেত সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে এখন এ প্রবাদ বাক্যটি বদলে গেছে এখন বলা হয় ‘সংসার সুখের হয় উভয়ের গুণে’। হ্যাঁ পুরুষ এবং নারী একে অপরের পরিপূরক। একটা সংসারে পুরুষ সফলতার সুখ দেখে আদর্শ স্ত্রীর মাধ্যমে আবার স্ত্রীর জীবনে গতিময়তা আসে স্বামীর সার্বিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতায়। এক্ষেত্রে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি রাগীব আলী এবং রাবেয়া খাতুন চৌধুরী ছিলেন তেমনি এক স্বর্গীয় জুটি। তিনি স্ত্রীকে ভালবেসে, স্ত্রীর উৎসাহে গড়ে তুলেছেন বেশ কতগুলো প্রতিষ্ঠান তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু প্রতিষ্ঠান- লিডিং ইউনিভার্সিটি, জালালাবাদ রাগীব বাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী নাসিং কলেজ সিলেট, রাগীব-রাবেয়া হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল আরও জানা অজানা বহু নাম করা প্রতিষ্ঠান। জীবনের দীর্ঘকাল তারা এক সাথে চষে বেড়িয়েছেন দেশে বিদেশে শহরে বন্দরে, গ্রামে ও গঞ্জে। তারা এভাবেই সর্বত্র ঘুরে ফিরে সেবা করেছেন সমাজ ও সমাজের মানুষের। বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের অবদান সর্বমহলে প্রশংসিত বলতেই হয়। সত্যি কথা হলো সিলেট এম.এ জি ওসমানী হাসপাতালে রোগীদের ভীড়ে যখন ডাক্তার বা নার্সরা হিমসীম ঠিক তখন রাগীব-রাবেয়া হাসপাতাল বানানোতে কিছুটা হলেও ওনমানী হাসপাতালের চাপ কমেছে এ কথা অনস্বীকার্য। গরীব-দুঃখীদের যেমন সেবা প্রদান করা হচ্ছে তেমনি অনেক বেকারের কর্মসংস্থানও হয়েছে।
সমাজসেবী রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর মত মহীয়সী মহিলার সংখ্যা এ সমাজে খুব কম। তাঁর মতো উদারনীতি ও সমাজসেবীর হাতের ছোঁয়ায় এ সমাজের অনেকের উপকার হয়েছে এ কথা অনস্বীকার্য। তাঁর মত চরিত্র ও গুণে বিকাশমান নারীদের খুঁজে পাওয়া বর্তমান সমাজে সম্ভব না। এখন আমরা প্রকৃত মানুষের কথার মূল্য দেইনা। আদর্শ ও নৈতিকতার প্রবক্তাদের এড়িয়ে চলি। আমাদের মধ্যে এখন লোক দেখানো মানসিকতা বিদ্যমান আর সেল্ফি বাজিতে উস্তাদ। কাজের মাত্রার চেয়ে প্রসংসার মাত্রা বাড়ানোর তাগিদ নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন সফল সমাজসেবী ছিলেন যার সেবায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রসার ঘটেছে। অবশ্যই তাঁর হাত ধরে নারী সমাজ এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে। নিজেদের স্বাভালম্বী হিসেবে গড়ে তুলেছে। শুধু অর্থবিত্ত থাকলেই হয় না সেবক হতে হলে সুন্দর একটা মন লাগে আমি মনে করি তিনি ছিলেন সুন্দর মনের অধিকারী।
রাবেয়া খাতুন চৌধুরী আজ আর আমাদের মাঝে নেই তিনি ১২ই ডিসেম্বর ২০০৬ সালে মালনীছড়া চা বাগানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া স্মৃতি, কৃতকর্ম সবাইকে তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। তিনি আমাদের নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা। এমন মনোভাপন্ন নারী সেবক আমাদের সমাজে সব সময় জন্ম নেন না। আমরা নারী সমাজ উনার কাছে আজ কৃতজ্ঞ। সিলেটবাসী আজও তাঁকে গভীরভাবে স্মরণ করে তার অবদানের জন্য। তাঁর আত্মার স্মৃতির প্রতি জানাচ্ছি গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা ‘সিলেট লেখিকা সংঘের’ পক্ষ থেকে। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন, আমিন।
লেখক : কলামিস্ট।