লিডিংজননী বেগম রাবেয়া
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ডিসেম্বর ২০২২, ৬:০০:১৭ অপরাহ্ন
রেজাউল করিম রাজ
তিনশত ষাট আউলিয়ার পুণ্যভূমি সিলেটে হজরত শাহজালাল (র.)-এঁর অন্যতম সফরসঙ্গী হজরত চেরাগ রওশন (র.)-এঁর বংশে জন্ম নেয়া বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী আমাদের চেতনার বাতিঘর। বঙ্গশ্রেষ্ঠ দানবীর ড. রাগীব আলীর জীবনসঙ্গী হিসেবেই নয়, বরং আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নে তাঁর যুগপৎ পদচারণা বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের কাছে বিশেষ অনুপ্রেরণার। তাঁর স্মৃতি চির স্মরণীয়, অম্লান। উন্নত জীবনবোধ এবং রুচিশীল জীবনাদর্শের যেই মূল্যবান শিক্ষা তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন তা বিশ্বের নারী সমাজের জন্য অবশ্য অনুসরণীয়। স্বার্থের পৃথিবীতে শরীরের ঘাম ঝরিয়ে উপার্জিত অর্থ-সম্পদ নিঃস্বার্থভাবে মানবসেবার জন্য উৎসর্গ করেছেন। জনহিতৈষী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণ ও পরিচালনার মাধ্যমে জনকল্যাণের যে উজ্জ্বল নিদর্শন বঙ্গীয় বদ্বীপে তিনি রেখে গেছেন, তা সত্যিই অতুলনীয় এবং অত্যন্ত বিস্ময়ের।
মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষের আত্মার দেহান্তর ঘটেমাত্র, আত্মার বিনাশ ঘটে না। আর সেই রূহানি জগতে তারাই শ্রেষ্ঠ, যারা বাস্তব জীবনে পৃথিবীতে আল্লাহর নির্দেশিত পথে সৎকর্মের সম্ভার নির্মাণ করে গেছেন। আর এখানেই ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব। মানুষের মৃত্যুর পর তার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে পার্থিব ধরাধামেও যে-বিদেহী ও গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি তা খুবই তাৎপর্যময়। কেননা, মানুষের দৈহিক অনুপস্থিতিতে তার নাম অনুরণিত হওয়ার এই মহত্তম বিষয়টি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবিত মানুষদেরকে ভালো ও সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করে, কল্যাণকর্মে সাহস জোগায়। পৃথিবীতে তার রেখে যাওয়া কর্মময় সৃষ্টি নিদর্শনের মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকে অনন্তকাল স্মৃতিতে, মানুষের হৃদয়ে। আত্মার শান্তি কামনায় যে অবিরত প্রার্থনা নিবেদিত হয় তা পরকালের জীবনকে সার্থকতা দান করে, বাড়িয়ে দেয় মানবজীবনের সৌন্দর্য ও মাহাত্ম্য।
স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টির প্রতি প্রেম, মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমের এক অপূর্ব সমন্বয় ছিলেন বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী। তিনি বিভাগ পরবর্তী বৃহত্তর সিলেটের এক ব্যতিক্রমী জীবনযোদ্ধা। বাংলাদেশের নারী শিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ। নিজের ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশের চিন্তা না-করে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন জীবনের সবটুকু সম্বল। পরার্থপরতার মাধ্যমে তিনি লাভ করেছেন অমরত্ব। তাঁর সৎকর্ম এবং সৃষ্টিশীলতা প্রকারান্তরে তাঁর পরিশীলিত মনন এবং আত্মশুদ্ধিকে নির্দেশ করে। যুগশ্রেষ্ঠ মানবী বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর পারিবারিক শিক্ষা, দেশে-বিদেশে অর্জিত অভিজ্ঞতাপূর্ণ প্রজ্ঞা, আধ্যাত্মিকতা, অনাড়ম্বর জীবনযাপন এবং নির্মোহ সংসারজীবন কীর্তিপুরুষ রাগীব-সংসারেও এক বিশেষ বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে। প্রজ্ঞাবতী রাবেয়ার প্রখর বুদ্ধিমত্তা, সংযমী আচরণ এবং পরিমিতিবোধ তাঁকে জগদ্বিখ্যাত নারীদের আসনে সমাসীন করেছে। ‘রাবেয়া’ এখন আর শুধু একটি নাম নয়-একটি প্রতিষ্ঠান, একজন আদর্শ মুসলিম নারীর অনন্য প্রতিকৃতি। শিক্ষা-দীক্ষা এবং জ্ঞানার্জন ও প্রজ্ঞায় তিনি একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারী আদর্শ।
বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী তাঁর কর্মময় জীবনে নিজ হাতে অসংখ্য স্বপ্নময় জ্ঞানবৃক্ষ রোপণ করেছেন বাংলাদেশের অনন্ত প্রান্তরে। তাঁর বুনে দেয়া স্বপ্নের অন্যতম একটি হলো আজকের লিডিং ইউনিভার্সিটি। লিডিং ইউনিভার্সিটি ছিল তাঁর আবেগের প্রতিষ্ঠান। তাঁর প্রাণের স্পন্দন, ভালোবাসা ও ভালো লাগার অন্যতম পীঠস্থান। বিশ্ববিখ্যাত হার্ভার্ডের মতো একটি বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রে উন্নীত করার লক্ষ্যে লিডিং ইউনিভার্সিটির জন্য তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন সামনে থেকে। তাঁর ইস্পাত দৃঢ় মনোবল এবং অসীম ধৈর্যশক্তির কারণেই বৃহত্তর সিলেটের বুকে প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে লিডিং মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর সাহসী ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় লিডিং ইউনিভার্সিটি শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করেছে, বিশেষ কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই। আজ থেকে দুই দশক আগে বন্দরনগরী সিলেটের বুকে লিডিং ইউনিভার্সিটির যে-মজবুত ভিত তিনি নির্মাণ করেছিলেন, বর্তমানে বৃহত্তর পরিসর অর্থাৎ সিলেটের রাগীবনগরে লিডিংয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস তারই বিকশিত রূপ।
শিক্ষানুরাগী বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী লিডিং ইউনিভার্সিটিকে কোনো বিচ্ছিন্ন শিক্ষাদান প্রতিষ্ঠান নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্গরাজ্য, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আদর্শ রোল মডেল অর্থাৎ একটি বৃহৎ গবেষণা পরিবার হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সক্ষমও হয়েছিলেন অনেকটা। কিন্তু তাঁর আসমানসম স্বপ্নকে পূর্ণতা দেয়ার পর্যাপ্ত সময় তাঁর জন্য বরাদ্দ ছিল না। এর আগেই পাড়ি জমাতে হলো পরপারে। লিডিং বিহঙ্গের দুর্নিবার উড়ে চলার একটি ডানা অদৃশ্য হয়ে গেল উপরওয়ালার ঐশ্বরিক ইশারায়। একাকী হয়ে পড়লেন স্বামী, জীবনযোদ্ধা, সবুজসম্রাট দানবীর ড. রাগীব আলী।
প্রিয়তম অর্ধাঙ্গিনীকে হারানোর শোক আজও বয়ে বেড়ান তিনি। কিন্তু প্রকৃতির বিধান অগ্রাহ্য করার সাধ্য কার! তবে পতিভক্ত স্ত্রী রাবেয়াকে হারানোর শোককে তিনি শক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন সফলতার সাথে। ড. রাগীব আলী বিশ্বাস করেন কাউকে ভালোবাসার অর্থই হচ্ছে, তাঁর স্বপ্নকে ভালোবাসা। মহীয়সী রাবেয়ার স্বপ্নিল চেতনায় উদ্ভাসিত দানবীর রাগীব আলী আরও জোরালোভাবে মনোনিবেশ করেন মৃত্যুঞ্জয়ী রাবেয়ার অতি আদরের সন্তানতুল্য প্রিয় লিডিং ইউনিভার্সিটিকে আরও সুগঠিত ও সুসংগঠিত করার প্রয়াসে। লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে রাবেয়া খাতুন চৌধুরী যে আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরে করেছিলেন, স্বামী ড. রাগীব আলী সেটাকে আরও জোরদার, অর্থপূর্ণ করে লিডিং ইউনিভার্সিটিকে আরও উৎপাদনমুখী এবং অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করলেন। ‘লিডিং-মাতা’ রাবেয়ার পাশে লিডিংয়ের এক অপ্রতিরোধ্য দাতা, ত্রাতা এবং অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন বঙ্গশ্রেষ্ঠ দানবীর ড. রাগীব আলী।
মহীয়সী রাবেয়ার ভালো লাগা, আনন্দ-অনুভূতির অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান ছিল লিডিং ইউনিভার্সিটির প্রিয় অঙ্গন। লিডিং নামের এই স্বপ্ন-সোপানের শ্রেষ্ঠ স্থপতি ও স্বপ্নদ্রষ্টা বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী। লিডিংয়ের অপ্রতিরোধ্য সারথি বেগম রাবেয়া ছিলেন আপন আলোয় উদ্ভাসিত বিশ্বগগনের এক জ্যোতির্ময়ী ধ্রুবতারা। তাঁর বিচক্ষণ অন্তঃচক্ষু দিয়ে তিনি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন লিডিং ইউনিভার্সিটির পরবর্তী ভবিষ্যৎ। বিশ্বের নামিদামি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মৈত্রী হিসেবে তিনি লিডিং ইউনিভার্সিটিকে বিশ্বদরবারে অবারিত করতে চেয়েছিলেন। তাই সিলেট ছাড়াও রাজধানী ঢাকার বুকে নির্মাণ করেছিলেন লিডিংয়ের মজবুত ভিত্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে পারস্পরিক সহমর্মিতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে লিডিংকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।
জ্যোতির্ময়ী রাবেয়ার অপার নিষ্ঠা, পরিশীলিত প্রজ্ঞা এবং অসীম মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে লিডিং ইউনিভার্সিটি অত্যন্ত কম সময়ে সমগ্র সিলেটের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী এবং অভিভাবকদের অন্যতম ভরসা ও আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। রাগীব-রাবেয়া দম্পতির অসামান্য অবদান এবং দূরদর্শী নেতৃত্বে লিডিং ইউনিভার্সিটি বৃহত্তর সিলেটসহ সমগ্র বাংলাদেশে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণায় দ্রুত শীর্ষে উঠে আসে।
কীর্তিময়ী রাবেয়া এক মস্ত চিত্রশিল্পীর নাম। যিনি তাঁর শিল্পমনন আর কোমল হাতের শৈল্পিক ছোঁয়ায় পৃথিবীকে সাজাতে চেয়েছিলেন শিক্ষা ও সেবার কারুকার্যে। একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত শান্তিময় পৃথিবী বিনির্মাণের অন্যতম কারিগর হিসেবে তাঁর আবির্ভাব বঙ্গসমাজে উত্তাল ধূমকেতুর মতো। বিশ্বমানবতার রঙে বাংলাদেশকে রঙিন করার প্রয়াসে তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন সমাজ থেকে অশিক্ষা, কুশিক্ষা এবং ক্ষুধা-দারিদ্র্য অপসারণের তুলি-কলম। বিশ্বের অধিকার বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আগুয়ান এক অন্যতম বীরসেনানি মূর্তিময়ী রাবেয়া।
অসীম প্রাণশক্তিপূর্ণ বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক ও উন্নত মনীষার অধিকারী। তিনি ছিলেন পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া নিত্য ঘটনাপ্রবাহের সকল বিষয়-পরিক্রমায় অগাধ জ্ঞানের আধার। একটি মুক্ত পৃথিবীর চিন্তায় নিমজ্জিত রাবেয়া নিজেকে আপডেট রাখতেন প্রতিনিয়ত। তাঁর জীবদ্দশায় জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার টার্গেটগুলো তাঁকে ভীষণভাবে তাড়িত করেছিল বিশ্বনাগরিক হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে সমাসীন করতে, নতুন আঙ্গিকে বাংলাদেশকে পরিচিত করিয়ে দিতে। ফলশ্রুতিতে, ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ববাসী কর্তৃক স্বাক্ষরিত জাতিসংঘের সহস্রাব্দ ঘোষণার সাথে সাথেই তিনি তাঁর স্বপ্নের লিডিং ইউনিভার্সিটি বাস্তবায়নে অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠেন। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগ, নিরক্ষরতা, পরিবেশগত অবক্ষয় এবং নারীর প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার নিমিত্তে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে পৃথিবীর এককোণে অর্থাৎ বাংলাদেশের নিভৃত জনপদ সিলেটে প্রতিশ্রুতিশীল মুক্তির সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন।
বিভিন্ন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান অনেক আগেই নির্মাণ করেন রাগীব-রাবেয়া দম্পতি। নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি তথা দেশের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বও রাগীব-রাবেয়া দম্পতির। কিন্তু বিশ্বময়ী রাবেয়া এবার মনোনিবেশ করেছেন একান্ত নিজের মতো করে সাজানো-গোছানো একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। যেখানে জ্ঞান চর্চা এবং জ্ঞান উৎপাদন হবে বিশ্বমানের। যেই চিন্তা সেই কাজ। একমাত্র জীবনসঙ্গী, মুকুটহীন সম্রাট, দানবীর ড. রাগীব আলী তাঁকে বুঝতেন অক্ষরে অক্ষরে। স্বামীর একান্ত সহযোগিতা এবং নেতৃত্বে তাপসী রাবেয়া খাতুন চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করলেন তাঁর স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার লিডিং ইউনিভার্সিটি। শুধু সিলেটে প্রতিষ্ঠা করেই থেমে থাকেননি। বিভাগীয় শহর সিলেটের পাশাপাশি লিডিং ইউনিভার্সিটির পরিসর তিনি বিস্তৃত করেন রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত। ঢাকার মালিবাগ এলাকার ৮৭ সিদ্ধেশ্বরী রোডে, একসময় নিজেদের বাসভবন উৎসর্গ করেন উচ্চশিক্ষার আঁতুড়ঘর লিডিং ইউনিভার্সিটির নামে। লিডিংয়ের ঢাকা ক্যাম্পাসের পাঁচতলা বিশিষ্ট মনোরম পরিবেশে দীর্ঘ একযুগেরও বেশিকাল ধরে অবলীলায় চলে শিক্ষা, গবেষণা ও পাঠদান কার্যক্রম।
বিপ্লবী রাবেয়ার চেতনায় ছিল স্বাধিকার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন। শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে বাঙালির বিজয় ছিনিয়ে আনতে সংগ্রাম করেছেন দেশে-বিদেশে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসে স্বামী দানবীর ড. রাগীব আলীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের তহবিল সংগ্রহে পালন করেছেন অগ্রসৈনিকের ভূমিকা। দেশে গেরিলা, মুক্তিবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঠিয়েছেন লন্ডনের পথে পথে ঘুরে সংগৃহীত বৈদেশিক সাহায্য। অক্লান্ত এক স্বপ্নচারিণী রাবেয়া বাঙালির দুঃখে হয়েছেন দুঃখী, গৃহত্যাগী হয়েছেন অনাহারীর অন্নসংস্থানে। রেমিটেন্স যোদ্ধা হিসেবে মজবুত করেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি। চা শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের রুগ্ন বৈদেশিক বাণিজ্য পুনরুজ্জীবিত করতে মহীয়সী রাবেয়া স্বামীর সঙ্গে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যান। প্রচারবিমুখ এই বাঙালি নারীর বিশ্বজয়ের সোনালি গল্প লিখে রাখা হয়নি বাংলার ইতিহাসে। কিন্তু দেশমাতৃকার উন্নয়নে স্বপ্নময়ী রাবেয়ার মনীষা ও নিঃস্বার্থ অবদানের কথা পৃথিবী খাতার পরতে পরতে এবং মুক্তিকামী বিবেকের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় লেখা থাকবে চিরদিন। আর সেই স্বর্ণগাথা নাড়া দিয়ে যাবে বিশ্বের মুক্তিকামী ও শান্তির পতাকাবাহী মানুষকে, প্রেরণা জুগিয়ে যাবে যুগ থেকে যুগান্তরে।
মৃন্ময়ী রাবেয়া ছিলেন মানবতার নেত্রী, আলোকের দিশারী। মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং দেশের বৃহৎ জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর নিষ্ঠা ও কর্মগুণে লিডিং ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট আস্থার এক অনন্য নিদর্শন। মায়া-মমতায় তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে এতটাই আপন হয়ে উঠেছিলেন যে, তাঁকে ‘লিডিং-জননী’ অভিধায় অভিষিক্ত করলেও অত্যুক্তি হবে না। তাঁর দূরদর্শী হৃদয় দিয়ে তিনি লিডিংয়ের ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন। তাঁর মাতৃস্নেহের ছায়াতলে পরম যত্নে লালিত হয়েছে দূরদূরান্ত থেকে পরিবার-পরিজন ছেড়ে শিক্ষা অর্জনে আসা ছাত্র-ছাত্রীরা। তাঁর মাতৃছায়ায় আশ্রয় নিতে পারত লিডিং ইউনিভার্সিটি পরিবারের ছোটো-বড়ো প্রতিটি সদস্য। যেকোনো বিপদ-আপদে তিনি ছিলেন অন্যতম অবলম্বন, আশ্রয়স্থল। পরম যত্নে তিনি গড়ে তুলেছিলেন তাঁর প্রাণের এই বিদ্যাপীঠ, আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার অন্যতম গবেষণাকেন্দ্রÑলিডিং ইউনিভার্সিটি। তাঁর হাতে গড়া লিডিং ইউনিভার্সিটি ক্রমেই যখন উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে, ঠিক সে সময়ই অস্তমিত হলো মহীয়সী রাবেয়া খাতুনের মানবিক অগ্রযাত্রার সোনালি সূর্য। আশার আলো হঠাৎ একদিন নিভে গেল। বড়ো অবেলায় তিনি আমাদেরকে শোকসাগরে ভাসিয়ে পাড়ি জমালেন লোকান্তরে।
লিডিং নামের জ্ঞানবৃক্ষের যেই প্রাতিষ্ঠানিক বীজবিজয়িনী রাবেয়া বপন করেছিলেন নিজ হাতে, তার প্রস্ফুটিত ও আনুষ্ঠানিক রূপ আমরা দেখতে পাই স্থায়ী ক্যাম্পাস রাগীবনগরে। লিডিংয়ে তাঁর সাজানো সংসার আরও বহুগুণ বাড়িয়ে এক নতুন আঙ্গিকে পরিচিতি দেন তাঁরই প্রেম-ভালোবাসার অনন্য আশ্রয়, সহযোদ্ধা ও সহযাত্রী দানবীর ড. রাগীব আলী। লিডিং ইউনিভার্সিটিকে রাগীবনগরে নিয়ে আসার স্বপ্ন প্রথম দেখেছিলেন বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী। তিনি রাগীবনগরকে একটি শিক্ষানগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন প্রথম থেকেই। সেই লক্ষ্যে শিক্ষা, শান্তি ও সমৃদ্ধিতে ভরপুর এক উন্নত সভ্য নগরীতে উন্নীত করার স্বপ্ন তিনি রাগীবনগরে বুনে দিয়েছিলেন আজ থেকে দুই যুগ আগে। জ্যোতির্ময়ী রাবেয়া তাঁর স্বপ্নকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এক সময়ের প্রত্যন্ত এই জনপদে তিনি অবলীলায় প্রতিষ্ঠা করেন রাগীব-রাবেয়া ডিগ্রি কলেজ। গ্রামের দুস্থ-আর্তের সেবায় নির্মাণ করেন রাবেয়া বানু জেনারেল হাসপাতাল। প্রসূতি মা ও নবজাতকের কল্যাণে প্রতিষ্ঠা করেন রাবেয়া খাতুন মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র।
তবে মাতৃপ্রাণ রাবেয়া মায়ের স্নিগ্ধ ছায়া আজও আচ্ছন্ন করে আছে লিডিং ইউনিভার্সিটির সবটুকু জুড়ে। তিনি লিডিং ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের অদূরে রাগীবনগরের মায়াবী মাটিতে শায়িত আছেন চিরতরে। ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁদের শিক্ষাজীবনের সবটুকু সময় কাটায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে। আসা যাওয়ার সময় অগণিত বিদ্যার্থী সাহস-অনুপ্রেরণা পায় মহীয়সী রাবেয়ার উন্নত মননশীলতা এবং চমৎকার ব্যক্তিত্বের মাতৃমূর্তি থেকে।
রাগীব-রাবেয়ার অনন্য কীর্তির অন্যতম হলো, হাজি রাশীদ আলী উচ্চবিদ্যালয়। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন ও স্বাধীনতার সংগ্রামের সাথে সাথে চলতে থাকে রাগীব-রাবেয়ার যুগপৎ শিক্ষা বিস্তারের সংগ্রাম। শিক্ষানুরাগী রাবেয়া খাতুন তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে দানবীর ড. রাগীব আলীর একনিষ্ঠ সহচর হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন হাজি রাশীদ আলী উচ্চবিদ্যালয়। কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এই প্রতিষ্ঠানের দ্বার উন্মুক্ত করেন আজ থেকে অর্ধ শতাব্দী পূর্বে। ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্য এই মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল বাসিয়া বিধৌত বৃহত্তর চরাঞ্চলের মানুষের কাছে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই আশ্চর্য ব্যাপার।
নির্লোভ, নিরহঙ্কার এবং পরোপকারী বিদুষী রাবেয়া বাংলার নারী সমাজের জন্য অসীম প্রেরণার। সৎকর্ম ও আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজ ও দেশের কল্যাণে তাঁর মতো নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার অনবদ্য নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে খুবই দুর্লভ। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কল্যাণে কাজ করে যাওয়ার দীক্ষা তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন। তাঁর নিজ হাতে গড়া অসংখ্য শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান মণিমুক্তার মতো ছড়িয়ে আছে সারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে। তাঁর জ্বালানো দীপশিখায় আলোকিত হয়ে পরিশীলিত মননের হাজার হাজার তরুণ-তরুণী ছড়িয়ে পড়েছেন দেশ থেকে দেশান্তরে।
লিডিং ইউনিভার্সিটিকে তিনি ভালোবেসেছিলেন মন থেকে। তাঁর কল্যাণচিন্তার বৃহত্তর অংশ জুড়ে ছিল সাম্য ও মানবতাবাদ। জননী জন্মভূমির প্রতি তাঁর অগাদ ভালোবাসা ও লালিত স্বপ্ন আমাদের জন্য অপূর্ব নিদর্শন। লিডিং ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে যখন হাঁটি, তখন দূর্বাঘাসের শীষে শিশিরের বিন্দুর মাঝে তাঁর মায়াবী প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। লিডিংয়ের প্রতিটি ধূলিকণা এবং প্রস্তরে অনন্ত মায়ায় মূর্ত হয়ে আছেন বেগম রাবেয়া। রাবেয়া খাতুন চৌধুরী তাঁর অস্তিত্বের এক পরম আবেশ আর নিটোল মায়ায় জড়িয়ে আছেন লিডিং ইউনিভার্সিটির সবটুকু জুড়ে। লিডিংয়ের প্রতিটি ইট, কাঠ এবং কংক্রিটের পরতে পরতে তাঁর রক্ত-ঘাম সিক্ত হয়ে আছে। রাগীব-রাবেয়া দম্পতির সীমাহীন আবেগ-অনুরাগ এবং কষ্টার্জিত অর্থ আর শ্রমের কাঠামোর ওপর ভর করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে লিডিংয়ের সুবিশাল ভবন দুটি। রাবেয়া-রাগীবের ত্যাগ ও মহিমা খালি চোখে দেখা যায় না। বরং হৃদয় দিয়ে তা অনুভব করতে হয়।
জ্যোতির্ময়ী রাবেয়া মিশে আছেন লিডিংয়ের সমগ্র অস্তিত্বে। বিভিন্ন বয়েসি ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারণায় মুখরিত লিডিংয়ের মনোমুগ্ধকর ক্যাম্পাস। পাখির কলকাকলি, বাসিয়ার কলতান, সোনালি ধানের ঢেউ দোলানো নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, ভ্রমরের গুঞ্জন, প্রজাপতির ওড়াউড়ি, দোয়েল-কোয়েল-কোকিলের কলরবে আজও তাঁর ঘুম ভাঙে। তিনি আজও মায়ের শাসন-আদরে আগলে রেখেছেন আমাদের মতো শত-সহস্র অনুসারীদের। অনুধাবন করি লিডিংয়ের মুক্ত আঙিনায় তাঁর স্নিগ্ধ আনাগোনা, অত্যন্ত নীরবে-নিস্তব্ধে।
তাঁর জীবনসঙ্গী এবং একনিষ্ঠ সহচর দানবীর ড. রাগীব আলীও এই পরিণত বয়সের পড়ন্ত বিকেলে আজও পিতৃছায়ায় আগলে রেখেছেন লিডিং ইউনিভার্সিটি পরিবারের সকলকে। তিনি সত্যের পথে দুর্নিবার অগ্রযাত্রায় প্রধান সারথি, লিডিং নামের জ্ঞানতরণির পাঞ্জেরি হয়ে আগুয়ান হচ্ছেন মহাকালের অনন্ত পথে। রাগীব-রাবেয়ার ছায়া আমাদের ওপর আশীর্বাদ। সভ্যতার সংকটের ঘোর অমানিশা এবং কলুষতার অন্ধকার থেকে মুক্তির পাথেয় হয়ে লিডিং ইউনিভার্সিটির নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন আমাদের মহানায়ক, রাখাল রাজা, দানবীর ড. রাগীব আলী।
রাবেয়া এক প্রেরণার নাম, রাবেয়া আমাদের শক্তি, আমাদের মুক্তির দিশারী। লিডিং ইউনিভার্সিটি পরিবারের প্রাণের স্পন্দন। তিনি পরম মমতায় প্রতিষ্ঠা করেন জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। আর্তের সেবা এবং রোগীর চিকিৎসার জন্য মমতাময়ী রাবেয়ার এই উদ্যোগ বৃহত্তর সিলেটবাসীর জন্য সত্যি গৌরবের। মানবকল্যাণের জন্য নিজের শ্রমে, ঘামে এবং মেধায় উপার্জিত অর্থ ঢেলে দিয়েছেন সিলেটে একটি বিশ্বমানের মেডিকেল কলেজ বিনির্মাণের জন্য। তিনি সফল হন তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে। সকল বাধা-বিপত্তি মাড়িয়ে আকাশচুম্বী কয়েকটি বহুতল ভবনে আশ্রয় দিয়েছেন দুস্থ-পীড়িত রোগীদের। নিজের জন্য কোনো বিলাসবহুল বাসভবন কিংবা প্রাসাদ গড়ে তোলেননি। তাঁর সকল অভিলাষ ছিল মানবতাকে ঘিরে। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে মানবপ্রেম, দুঃখীদের সেবা এবং পেশাদার ডাক্তার চিকিৎসক এবং নার্স তৈরির অত্যাধুনিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন অনন্য দৃষ্টান্ত।
বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী এক অনন্য শক্তি-সাহসের নাম। যাঁর নামের স্পর্ধিত উচ্চারণ যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সর্বদা প্রস্তুত। মহীয়সী রাবেয়া এক বিমূর্ত শক্তি, চেতনার স্পর্ধিত সোপান। লিডিং ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে অনন্ত প্রহরীর মতো নিত্য জাগরুক মাতৃময়ী রাবেয়া। রাবেয়া খাতুন চৌধুরী এক প্রেরণার নাম। লিডিংয়ের ভাগ্যাকাশে মহীয়সী রাবেয়া সুশীতল ছায়াস্বরূপ। মহীয়সী বেগম রাবেয়া যেই অমূল্য আমানত জনকল্যাণে রেখে গেছেন, তার যথাযথ সুরক্ষায় আমাদের নির্ঘুম প্রহরীর মতো কাজ করে যেতে হবে।
লেখক : প্রভাষক, আইন বিভাগ, লিডিং ইউনিভার্সিটি, সিলেট।