ভিনদেশের পতাকায় রঙিন আমাদের আকাশ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, ৭:৫১:৪২ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী
বিশ্বকাপ ফুটবলের মহাযজ্ঞ শুরু আরব দেশ কাতারে হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ ক’টি খেলাও দর্শকরা উপভোগ করেছেন। হাজার হাজার মাইল দূরে বিশ্বকাপ ফুটবলকে বরণ করতে বাংলাদেশের নগরে গ্রামে সর্বত্র চলছে নানা আয়োজন। ফুটবল প্রেমীদের উন্মদনা শুধু খেলার আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ নয়, পতাকা উড়ানো, প্রিয় দলের জার্সি কেনা, মিছিল বের করা এমন কি নিজের পুরো বাড়ি কিংবা গেটের রঙও করছেন প্রিয় দলের পতাকার রঙ্গে।
বিশ্বকাপ মানে উত্তেজনা, উন্মাদনা, আনন্দ, উচ্ছ্বাস আরো কত কি। চার বছর পরপর আসা এ বিশ্বকাপকে বরণ করতে কত প্রস্তুতিই না নিয়ে থাকে ফুটবলপ্রেমীরা। এই নগরীও সে বিশ্বকাপ জ্বর থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখতে পারেনি। এমনিতেই বাঙালি ফুটবল পাগল জাতি। আর সে ফুটবল যখন হয় বিশ্বকাপ তখন আর নিজেদের স্থির রাখে কেমনে। ইতিমধ্যে নগরী জুড়ে চলছে পতাকা উৎসব। এরই মধ্যে বিভিন্ন বাড়ির ছাদে উড়তে শুরু করেছে প্রিয় দলের পতাকা। প্রিয় খেলোয়াড়দের ছবি এঁকে বাড়ির আঙিনা কিংবা দেয়াল রাঙ্গাতেও ভুলছেন না ফুটবলপ্রেমিরা।
এখন আকাশের দিকে তাকালে শুধু আকাশের নীল-সাদাই চোখে পড়বে না, কাপড়ের রঙেও নীল আর সাদা চোখে পড়বে। নজরে আসবে সবুজ-হলুদের আধিক্যও। দেখতে পাবেন আরো বিভিন্ন রঙ। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগেই শুরু হয়েছে উন্মাদনা। চলবে আরো একমাস জুড়ে। মাঝপথে প্রিয় দল বিদায় নিলে একটু ভাটা পড়বে বটে, কিন্তু ফাইনালের মহারথ পর্যন্তচলবে ফুটবল উন্মাদনা।
বাংলাদেশ মানে বিশ্বকাপ দুই শিবিরে বিভক্ত। ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা। এবারেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছেনা। এদেশের সিংহভাগ মানুষ এই দলের পক্ষে। তবে সময়ের পরিক্রমায় অন্যান্য দলের সমর্থকের সংখ্যাও বাড়ছে। যেমন স্পেনের সমর্থকও এখন খুব একটা কম নয়। তাইতো বিভিন্ন জায়গায় এখন স্পেন কিংবা নেদারল্যান্ড, ইংল্যান্ডের পতাকাও উড়তে দেখা যায়। তবে নগরীর বাড়ির ছাদ জুড়ে কিন্তু আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের পতাকার অনুপম প্রদর্শনী। আর বিশ্বকাপ এলেই এই পতাকা বানিয়ে এবং বিক্রি করে ভাল আয়ও করে দর্জিরা। এখন যেমন নগরীর খেলার সামগ্রীর দোকানগুলোতে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন দেশের পতাকা। বিভিন্ন সাইজের পতাকার দামও ভিন্ন। আবার অনেকেই প্রতিযোগিতা দিয়ে পতাকা তৈরি করে থাকেন, এর মধ্যে নগরীর বিভিন্ন জায়গায় লম্বা পতাকা টানানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কোন কোন জায়গায় আবার পতাকার সাথে শোভা পাচ্ছে বিশ্বকাপের ফিকশ্চারও। সে সাথে ডিজিটাল ব্যানারের মাধ্যমে বিশ্বকাপের সাফল্যও কামনা করছেন কেউ কেউ। গত কয়েকদিন ধরে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে নানা সাইজের পতাকায় ছেয়ে গেছে শহর। আবার কোনও কোন দালানের ছাদে টানানো হয়েছে একই দলের অনেক পতাকা। দেখে মনে হতে পারে এটি যেন জাতিসংঘের কোন গুরুত্বপূর্ণ অফিস।
একটি স্বাধীন দেশে আরেকটি দেশের পতাকা উত্তোলন করাটা কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ১৯৭২ সালের আইনে দেশের সরকারের পূর্ব অনুমতি ছাড়া ভিন দেশীয় পতাকা কোন গাড়ী বা বাড়ীতে উড়ানো নিষেধ। তবে ফুটবলপ্রেমীদের মনে সে রকম কিছু নেই। তাদের কাছে এটা ফুটবলের আনন্দ। আনন্দের জন্য তারা পতাকা উত্তোলন করছে। আর এ জন্য আইন ভঙ্গ হতে পারে তেমনটিও মনে করেননা তারা। তবে এবারের কোথাও কোথাও প্রিয় দলের পতাকার উপরে বাংলাদেশের পতাকাও টাঙাতে দেখা গেছে। সিলেট আদালতে প্র্যাকটিস করা আইনজীবী হাসান বললেন, আবেগের কাছে আমরা দেশের সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছি। আইন লঙ্ঘন করছি। একটি স্বাধীন দেশে অন্য দেশের পতাকা উড়ানো মোটেই আইনসিদ্ধ নয়। প্রশাসনের নির্লিপ্ততা এক্ষেত্রে মানুষকে আরো উৎসাহিত করছে। স্থানীয় একটি কলেজের জনৈক অধ্যাপক বললেন ভিন্ন কথা। তার মতে, আমরা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের পতাকা দেশের পতাকা হিসেবে তুলছি না। ফুটবল দলের পতাকা হিসেবে তুলছি। দলকে সাপোর্ট করছি, পতাকা উড়িয়ে, জার্সি পরে আমরা শুধু খেলাটাই উপভোগ করছি। খেলা শেষ তো সব শেষ।
ব্যাংক কর্মকর্তা জাহিদের কন্ঠেও সহমত। এই ব্যাংকারের বাসার ছাদে দুটি পতাকা উড়ছে। যার একটি আর্জেন্টিনার আরেকটি ব্রাজিলের। কারণ হিসেবে তিনি জানালেন, তিনি ব্রাজিলের ভক্ত কিন্তু তার ছেলে মেসির ভীষণ ভক্ত। তাই বাপ বেটার জন্য দুটি পতাকা। কেমন বিক্রি হচ্ছে এ পতাকা? নগরীর বন্দরবাজার এলাকার এক ব্যবাসায়ী শফিকুল আলম জানান, ৬৫ টাকা থেকে শুরু দুই কিংবা তিন চার হাজার টাকা দামের পতাকাও মিলছে তাদের কাছে। তবে সবচাইতে বেশি চাহিদা আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের পতাকার। আর এ দুই দলের পতাকার দামও বেশি। স্কুল এবং কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা এই পতাকার প্রতি বেশ আগ্রহী। অনেক বাবা মা তাদের সন্তানদের আবদার রক্ষা করতে একটি বিদেশি পতাকা তুলে দিচ্ছে তাদের হাতে। অনেকে আবার সংঘবদ্ধ হয়ে বড় সাইজের পতাকা কিনছে। নিজের এলাকায় উড়বে এসব পতাকা।
নগরীর দর্জিপাড়াগুলোতে কারিগরেরা এখন কাপড় চোপড় সেলাই করার পরিবর্তে পতাকা সেলাই এর কাজে ব্যস্ত। গতকাল তেমনই একাধিক দর্জির সাথে কথা হয়েছে। তারা জানালেন আসলে এটা একটা মৌসুম। বলা যায় ঈদের মতই মৌসুম। এসব পতাকা বানানোর কাজে সময় লাগছে কম আর লাভটাও তুলনামূলক বেশি। সে কারণে এখন পতাকা এবং জার্সি বানানোর কাজে মশগুল তারা সবাই। কেন বিদেশী পতাকা তোলা হচ্ছে দেশের মাটিতে তেমন প্রশ্নের জবাবে নাজমুল নামে এক কলেজ ছাত্র জানালেন তাদের কাছে এখানে খেলাটাই মূখ্য। আইন ভঙ্গ হচ্ছে কিনা সেটা তাদের জানা নেই। তিনি বলেন এক সময় আমরা দেখেছি এদেশে ফটবল যখন রমরমা ছিল তখন ঘরে ঘরে আবাহনী-মোহামেডানের পতাকা উড়ানো হতো। এখন ফুটবলের সে আমেজ এদেশে নেই। তাই বিশ্বকাপে বিদেশী পতাকা উড়িয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করছে তারা। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে তাদের কাছে বিশ্বকাপটাই অন্যরকম এক অনুভূতি। পতাকা তো উড়ানো হয়েছে এরই মধ্যেই, কিন্তু সেই পতাকা উড়ানো দেখানো যাচ্ছেনা বন্ধুদের। তাই শুধু প্রতিপক্ষ বন্ধুকে আলোচনা আর যুক্তিতেই কাবু করতে চাচ্ছেন না তরুণনা। সুযোগ পেলেই কিনে নিচ্ছেন প্রিয় দলের জার্সি। এখানেও চাহিদা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের। আরেকটু স্পষ্ট করে বললে মেসি-নেইমারের। কারণ জার্সিতে প্রিয় দলের নাম ছাড়াও লেখা আছে প্রিয় খেলোয়াড়দের নাম। তাই এই একমাস ফুটবলপ্রেমিরা হয়ে উঠবেন হয় মেসি, নয় নেইমার! জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার শপিং সেন্টারগুলো ছাড়াও বিভিন্ন ছোট খাটো মার্কেটে মিলছে নানা দলের নানা সাইজের নানা দামের জার্সি। একশ’ থেকে শুরু করে ছয়/সাতশ’ টাকা দামের জার্সিও আছে। শুধু নিজের জন্য নয়, চাইলে প্রিয় কারো জন্য কিংবা নিজের ছোট ছেলে-মেয়েটির জন্যও কিনে নিতে পারেন প্রিয় দলের একটি জার্সি।
বিশ্বকাপ ফুটবলের উৎসবের আমেজ শুধু পতাকা উড়ানোতেই সীমাবদ্ধ নয়। শুধু সমর্থন করেই নয়, খেলা দেখার নানা প্রস্তুতিও এখন ফুটবলপ্রেমিদের। এ কারণে বেড়েছে টেলিভিশনের বেচাকেনা। এর মধ্যে বেশি বিক্রি হচ্ছে এলসিডি ও এলইডি টেলিভিশন। চাহিদা বেড়েছে সিআরটি টেলিভিশনেরও।
নগরীর জিন্দাবাজার ও বন্দরবাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিশ্বকাপ উপলক্ষে মূল ছাড় ও বিভিন্ন অফার বেচাকেনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এখন কম দামে ভালো মানের টেলিভিশন পাওয়া যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে দেশীয় ব্রান্ডের টেলিভিশন। টেলিভিশন কেনাবেচায় এখন ক্রেতা ও বিক্রেতার উৎসাহের কমতি নেই।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এখন জনপ্রিয় ব্রান্ডের টেলিভিশনের চাহিদা বেশি এর মধ্যে ওয়ালটন, সনি, মাইওয়ান, স্যামসাং, এলচি, সিঙ্গার, কনকা, প্যানাসনিক, ট্রান্সটেক, গোল্ডষ্টার ও হায়ার ব্রান্ডের টিভি বেশি বিক্রি হচ্ছে। মার্কেটে ইলেকট্রনিক্স পণ্যের মধ্যে টেলিভিশনের বিক্রি বেশি হচ্ছে বলে জানান বিক্রেতারা। তারা বলেন, গত মাসের চেয়ে চলতি মাসে বিক্রি বেড়েছে। বিশ্বকাপের সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই চাঙ্গা হতে শুরু করেছে টেলিভিশনের বেচাকেনা।
সিআরটি টেলিভিশন ৮ হাজার ৫০০ থেকে ১৪ হাজার টাকা এবং এলসিডি-এলইডি টেলিভিশন ১২ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকা বিক্রি হচ্ছে। জিন্দাবাজারে ইলোরা ইলেকট্রানিক্সের ম্যানেজার রিপন জানালেন, গত দু সপ্তাহ ধরে টেলিভিশন বেচাকেনা বেশি বেড়েছে। বিশ্বকাপের বাজার উপলক্ষে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাওয়ায় বিক্রেতারাও খুশি।
বাংলাদেশ টিভি ম্যানুপ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৫ লাখ টেলিভিশন দেশে উৎপাদন ও সংযোজন হচ্ছে। এ ছাড়া তিন লাখ টেলিভিশন সরাসরি আমদানি হচ্ছে। গত অর্থবছরে দেশে ১৬ লাখেরও বেশী টেলিভিশন বিক্রি হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ডিসেম্বর পর্যন্তবিক্রি হয়েছে ৯ লাখ ৪০ হাজার। অর্থবছরে শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিক্রি বাড়েনি। এবার বিশ্বকাপ উপলক্ষে বেচাকেনা অনেক বেশি হবে।
শুধু নতুন টেলিভিশন কেনা নয়, নষ্ট টেলিভিশনও সারিয়ে নিতে দেখা যাচ্ছে অনেককে। সরাইখানায় তাই এখন পুরনো টেলিভিশন সংস্কারের তোড়জোড়। এতদিন যাই থাক, এখন রাত জেগে খেলা দেখার প্রস্তুতিটাও নিয়ে রাখতে হবে ফুটবল প্রেমীদের।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।