বিশ্বকাপে কেলেঙ্কারি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ৮:০২:১৬ অপরাহ্ন
রফিকুর রহমান লজু
সারা দুনিয়ায় বিশ্বকাপ উৎসব চলছে। খেলা হচ্ছে কাতারে। কিন্তু উৎসব আর আনন্দ বিশ্বময়। এক অনন্য জমকালো আয়োজনের মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে কাতার বিশ্বকাপ ২০২২। হাজার হাজার দর্শক-সমর্থক খেলা উপভোগ করতে প্রতিদিন মাঠে উপস্থিত হচ্ছেন, গলা ফাটাচ্ছেন পছন্দের দলের জন্য। মাঠের বাইরেও স্থানে স্থানে বড় পর্দায় খেলা দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘরে ঘরেও পারিবারিকভাবে খেলা উপভোগ করা হয়।
বিশ্বকাপ খেলা উপভোগের আনন্দ উচ্ছ্বাসের ইতিহাসের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে বিশ্বকাপ নিয়ে অনভিপ্রেত ঘটনা ও কেলেঙ্কারিও ঘটেছে। বিশ্বকাপের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা এত উচ্চে যার ফলে এসব কেলেঙ্কারি বিশ্বকাপের মর্যাদায় স্থায়ী কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
বিশ্বকাপ ট্রফি চুরি
প্রথমে বা শুরুতে বিশ্বকাপের নাম ছিল ‘জুলেরিমে ট্রফি’। পরে নাম হয়েছে বিশ্বকাপ ট্রফি। ১৯৩৮ সালে বিশ্বকাপ জিতে নেয় ইতালি। বিশ্বকাপ বিজয়ী হিসেবে কাপ ছিল ইতালির কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এক বড় শক্তি ছিল জার্মানির নাৎসি বাহিনী যার নেতা ছিল হিটলার। নাৎসিরা যাতে ট্রফির নাগাল না পায় সে জন্য সেসময়ের ফিফার সহ সভাপতি ইতালির অধিবাসী অত্তোরিনো বরাসিস ব্যাংকের লকার রুম থেকে ট্রফিটি বের করে নিয়ে যান রোমে। তিনি জুতার বাক্সে ভরে বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখেন। তবুও সবার অলক্ষে ট্রফিটি চুরি হয়ে যায়। ঘটনাটি ঘটে ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপ শুরুর চার মাস আগে। চুরি যাওয়ার পর সপ্তাহ দিন যেতে না যেতেই ট্রফিটি উদ্ধার হয়। উদ্ধার করে পিকেলস নামের একটি কুকুর। ট্রফিটি ছিল খবরের কাগজে মোড়ানো।
৩য় বার ১৯৭০ সালে জেতে ব্রাজিল
তৃতীয়বার ১৯৭০ সালে বিশ্বকাপ জয় করে ব্রাজিল। তখন ব্রাজিল চিরতরে ট্রফিটি রেখে দেয় নিজেদের কাছে। রিওডি জেনিরোতে ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশনের সদর দফতরে ট্রফিটি সযত্নে রক্ষিত আছে। ডিসেম্বর ১৯৮৩ সালে ট্রফিটি আবার চুরি হয়ে যায়। সেই ট্রফিটি আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এর চার বছর পর ১৯৭৪ বিশ্বকাপ থেকে নতুন ট্রফি দিতে শুরু করে ফিফা। এরপর থেকে মূল ট্রফি ফুটবল বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন দলকে আর দেওয়া হয় না, যেটা দেওয়া হয় সেটা রেপ্লিকা। অর্থাৎ অবিকল কপি।
সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা
বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছিল সান্তিয়াগোতে ১৯৬২ বিশ্বকাপে স্বাগতিক চিলি ও ইতালির ম্যাচে। তবে ন্যাক্কারজনক ঘটনার সূত্রপাত মাঠের ভিতরে নয়, মাঠের বাইরে। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, দুই ইতালিয়ান সাংবাদিক তাদের পত্রিকায় প্রকাশ করেন, ‘চিলিকে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে দেওয়াটা পাগলামি ছাড়া কিছুই নয়।’এমন খবর দেখে চিলির জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ক্ষোভ এতটাই চরমে পৌঁছ যে, ইতালির সাংবাদিক ভেবে আর্জেন্টিনার এক সাংবাদিককে তারা পিটিয়ে আহত করেন। ঘটনাটি ইতালিয়ান শিবিরে পৌঁছালে খেলা শুরুর ১২ সেকেন্ডের মধ্যেই ইতালির জর্জিও ফেরেনি ফাউল করেন। ১২ মিনিটে ফেরেনি আবার ফাউল করলে রেফারি অ্যাস্টন তাকে মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু রেফারির সিদ্ধান্তকে পাত্তা না দিয়ে তিনি খেলা চালিয়ে যেতে থাকেন। পরে পুলিশ মাঠে ঢুকে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। এভাবে খেলাটি আর খেলা থাকেনি, কুৎসিত আকার ধারণ করে খেলাটি। রেফারিকে হুমকি দেয়া হয়, কিল, ঘুষি, লাথি মারা হয়। চিলি ২-০ গোলে জয় লাভ করে এবং বেশ কয়েকজন ম্যাচ শেষে হাসপাতালে ভর্তি হন।
পশ্চিম জার্মানির ম্যাচ পাতানো খেলার অভিযোগ
১৯৮২ বিশ্বকাপে গ্রুপ-পর্বের খেলায় আলজেরিয়ার প্রতিপক্ষ ছিল পশ্চিম জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া। গ্রুপ-পর্বের একেবারে শেষ ম্যাচ ছিল পশ্চিম জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ার মধ্যকার। কিন্তু গ্রুপের সবার হাড্ডাহাড্ডি পারফরম্যান্সের ফলে তিন দলের সমীকরণই জটিল হয়ে ওঠেছিল। সমীকরণটি এমন ছিল যে- অস্ট্রিয়া যদি জার্মানির বিপক্ষে ড্র করে বা জয়লাভ করে তাহলে পশ্চিম জার্মানি বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ে যাবে। আর জার্মানি যদি ৩ বা তার থেকে বেশি গোলের ব্যবধানে জয় পায়, তাহলে অস্ট্রিয়া বাদ পড়বে। কিন্তু জার্মানি যদি ১ বা ২ গোলের ব্যবধানে জেতে তাহলে আলজেরিয়া বাদ পড়ে যাবে। কিন্তু এই খেলায় মজার এক ব্যাপার ঘটলো- ম্যাচের ১০ মিনিটেই জার্মানি ১-০ গোলে এগিয়ে যায়।
এরপর দুই দলের শুরু হয় এলোমেলো বল ছোড়ার প্রতিযোগিতা। জার্মানি এগিয়ে যাবার পর দুই দলই ম্যাচ জোড়ে এদিক-সেদিক বল ছোড়াছুড়ি করতে থাকে। কোনো দলের মধ্যেই গোল করার প্রবণতা দেখা যায়নি। আসলে এটা ছিল আলজেরিয়ার বিরুদ্ধে এক প্রকার ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সেবার বিশ্বকাপ থেকে আলজেরিয়া বাদ পড়ে।
বিতর্কিত ম্যাচ
১৯৮২ সালে বিশ্বকাপে ফ্রান্স-কুয়েতের ম্যাচ ছিল বিতর্কিত। ২১ জুন, ১৯৮২ প্রথম রাউন্ডের ম্যাচে মুখোমুখি হয় দুইদল। খেলার দ্বিতীয়ার্ধে ফ্রান্স মিডফিল্ডার অ্যালান গ্রিসের গোলকে কেন্দ্র করে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। কুয়েতিদের দাবি, তারা বাঁশির আওয়াজ শুনে খেলা থামিয়ে দেন। আর সেই সময় অ্যালান গ্রিস গোলটি করেন। কুয়েত গোলটি বাতিল করার দাবি জানান রেফারিকে। গ্যালারিতে বসে থাকা তৎকালীন কুয়েত ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট শেখ ফাহাদ আল আহমাদ সাবাহ কুয়েতের খেলোয়াড়দের মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দেন। পরে তিনি নিজেই গ্যালারি ছেড়ে মাঠে প্রবেশ করেন এবং রেফারির সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হন। রেফারি দীর্ঘ সময় আলোচনার পর গোলটি বাতিল করেন। এ ঘটনার জন্য রেফারি মিরোস্লাভ সুতুপার আন্তর্জাতিক রেফারি সনদ হারান এবং শেখ ফাহাদ আল আহমাদ আল সাবাহকে মাত্র ১০ হাজার ডলার জরিমানা দিতে হয়।
লেখক : কলামিস্ট, সাবেক শিক্ষক।