সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ ডিসেম্বর ২০২২, ৭:৪৯:৫৮ অপরাহ্ন
এক অনাবিল শিহরণে আন্দোলিত জাতি এখন। উপলক্ষ হচ্ছে বিজয়ের আনন্দ, পাওয়ার আনন্দ। আজ থেকে ৫১ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই দিনে এ ভূ-খণ্ডের হাজার বছরের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষেরা লাভ করে কাংখিত বিজয়। আর এই বিজয়ের সঙ্গে মিশে আছে তেত্রিশ লাখ বাঙালির আত্মত্যাগ। এই বিজয়ের মাসেই জাতির পথ প্রদর্শক, জাতির বিবেক বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। তাই কষ্ট আর আনন্দের মিশেল অনুভূতি নিয়েই ডিসেম্বর, আমাদের বিজয়ের মাস। আজ আমাদের মহান বিজয় দিবস। একটি পতাকা সবুজের বুকে লাল সূর্য খচিত, একটি মানচিত্র, একটি নতুন ভূ-খণ্ড, একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা- এই সবই অর্জিত হয় আজকের এই দিনে। একাত্তরের আজকের এই দিনে এদেশের কৃষক, শ্রমিক, মজুর, কামার-কুমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে পশ্চিমা হানাদার বাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসরদের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছিলো বিজয়। তাই বিজয় এ ভূখণ্ডের কোটি কোটি মানুষের আরাধ্য একটি নাম। যতোদিন এই দেশ থাকবে, আকাশ মাটি থাকবে, ততোদিনই জাতি ঘটা করে উদযাপন করবে এই দিনটিকে। আমরা আজকের এই দিনে একাত্তরের বীর শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। সেই সঙ্গে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের প্রতি জানাচ্ছি সমবেদনা।
বাঙালির বিজয় হঠাৎ করে কোন যাদুর কাঠির ইশারায় আসেনি। এর পেছনে রয়েছে করুণ ইতিহাস। বাঙালি বীর, বাঙালি অধিকার আদায়ে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে জানে, এটা প্রমাণিত হয় একাত্তরে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে। বিশ্বের ইতিহাসে বাঙালির গৌরবগাঁথা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হয় এই একাত্তরেই। বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত অন্যতম শক্তিশালী সমরযোদ্ধাদের সামনে দাঁড়ায় নিরস্ত্র বাঙালিরা। দীর্ঘ নয় মাসের এক ‘অসম’ যুদ্ধে তারা পরাজিত করে পশ্চিমা হানাদার বাহিনীকে, এদেশের আলবদর রাজাকার আলশামস বাহিনীকে। বিজয় অর্জনের এই পথ অগণিত তাজা প্রাণের রক্তে হয় রঞ্জিত। বাঙালিরা বৈষম্যের শিকার হয় ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই। আর তখন থেকেই শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা। একে একে আসে, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৮-এর সামরিক শাসনের বিরোধীতা, ৬২-৬৪ এর ছাত্র আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যূত্থান। ইতিহাসের এই সব রক্তক্ষয়ী অধ্যায় পেরিয়ে আসে একাত্তর। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানী দখলদার সামরিক বাহিনী আকস্মিকভাবে বাংলার মানুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। বাঙালিদের ‘অপরাধ’ ছিলো তারা পাকিস্তানীদের ‘মর্জিমাফিক’ চলছে না। অথচ উভয় পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যাতে সংখ্যাগরিষ্ট ছিলো বাঙালি। রাষ্ট্র পরিচালনায় বাঙালিদের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত ছিলো। কিন্তু ঘটলো উল্টো। যার পরিণতি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। পঁচিশে মার্চের কালোরাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বাঙালি নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে। সেই বর্বরতাকে উপেক্ষা করে তখনকার জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ট দলের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছাব্বিশে মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলা দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাঙালিরা যার যা আছে তাই নিয়ে মাঠে নামে শত্রু মোকাবেলায়। বিশ্বের সমর ইতিহাসে সূচনা হয় নতুন অধ্যায়ের। জয়ী হয় বাঙালিরা। জন্ম নেয় লাল সবুজের মোড়কে একটি নতুন ভূ-খণ্ড।
বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়েছি আমরা।কিন্তু এতোগুলো বছরেও বাঙালিরা যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলো, তার কতোটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে? আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। রাজনৈতিক, সামাজিক অস্থিরতা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অশিক্ষা, ঘুষ-দুর্নীতি জাতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। জনশক্তির বড় অংশ অশিক্ষিত। স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেনা মানুষ। বেড়ে চলেছে ঠিকানাহীন বস্তিবাসীর সংখ্যা। বাড়ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়েও বিতর্ক চলছে এখনও। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী চক্র নানা কৌশলে দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দেশের একটি সঠিক জন্ম-ইতিহাস রেখে যাওয়া, একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ রেখে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই।এতে কোন অবহেলার সুযোগ নেই।