বিজয় দিবসের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ ডিসেম্বর ২০২২, ৭:৫৫:৫২ অপরাহ্ন

শেখর ভট্টাচার্য
এই উপমহাদেশ-ভুক্ত কোন দেশে “বিজয় দিবস” বলতে কোন দিবস নেই। বাংলাদেশ ও বাঙালির “বিজয় দিবস” তাই অনন্য। সমগ্র বিশ্বের কোন জাতি এতো “দাম” দিয়ে স্বাধীনতা বা মুক্তি সংগ্রামের বিজয় অর্জন করেনি। অন্যায় ভাবে চাপিয়ে দেয়া একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মোকাবেলা করে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে এই বিজয় অর্জন করতে হয়েছে শুধু মাত্র বাঙালির। এই বিজয় কী শুধুমাত্র পাকিস্তানী শত্রু সেনার বিরুদ্ধে বিজয় ছিলো? বিষয়টিকে এতো সরল ভাবে দেখলে বিজয়ের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে অনুধাবন করা সহজ হবেনা। আমাদের মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়েছিলো, আটচল্লিশ সালে রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে। ভাষা ও সংস্কৃতি অবিচ্ছিন্ন। ভাষা, সংস্কৃতির অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের জাতীয়তা-বোধ জাগ্রত হয়। এই জাতীয়তাবোধ আবহমান বাংলার অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় বাঙালি জাতিকে। শুধু কী অসাম্প্রদায়িকতা? ভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলন জাতিকে নব্য ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ, মানুষে মানুষে বৈষম্য বিলোপের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে তুলে। একারণে একাত্তরের ষোল ডিসেম্বরের বিজয় ছিলো ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র-সংস্কৃতি এবং সমতা ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে শহীদের রক্ত স্নাত এক মহিমান্বিত বিজয়।
বিজয় দিবসের তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে খুঁজতে হবে।জানতে হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষ হাতের লাঙল, নৌকার বৈঠা, মাছ ধরার জাল ফেলে দিয়ে দুর্দমনীয় বীরে রুপান্তরিত হলো কী ভাবে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের গল্প বেশী পাওয়া যায়না। এই গল্প সরাসরি পাওয়া যায়, জীবিত মুক্তিযোদ্ধারদের কাছ থেকে এবং নানা প্রামান্য গ্রন্থে। আমি সারা বছর নিজেকে উজ্জীবিত করার জন্য একটি গ্রন্থ পাঠ করি। আর এ’অমূল্য গ্রন্থটি হলো “একাত্তরের চিঠি”। রণাঙ্গন থেকে লেখা এই চিঠি গুলো যে কোন পাঠক অনুভব করতে পারবেন, মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীরদের দেশপ্রেম, স্বাধীনতার জন্য প্রাণের আবেগ এবং, আত্মত্যাগের ইতিহাস।
“একাত্তরের চিঠি”, যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পাঠানো মুক্তিযোদ্ধাদের পত্র সংকলন। এই অমূল্য চিঠি গুলোর সংকলিত করে প্রথম প্রকাশ করা হয়েছিলো ২০০৯ সালে। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে, “একাত্তরের চিঠি” থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের লেখা সেই চিঠি গুলো পাঠ করছিলাম। এই গ্রন্থটি আমার হাতের কাছে সব সময়ই থাকে। সামাজিক সংকীর্ণতা এবং দেশ প্রেমহীন মানুষের অনৈতিক কর্মকান্ড দেখে মন যখন কিছুটা বিষন্ন হয়ে ওঠে, তখন এই মহৎ গ্রন্থটি পাঠ করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করি। এই গ্রন্থে যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধার চিঠি অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই, পাকিস্তানী হায়েনাদের হাতে যুদ্ধ ক্ষেত্রে শহীদ হয়েছেন।
প্রিয় পাঠক- বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতার শপথ এবং বাঁধ ভাঙ্গা আবেগের অসামান্য অনুভুতিকে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে অনুভব করার জন্য রণাঙ্গন থেকে পাঠানো শহীদ জিন্নাত আলীর একটি চিঠি পাঠ করে আবশ্যক। চিঠিটি লেখা হয়েছিলো ৪ এপ্রিল ১৯৭১ সালে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র ৯ দিন পর। জিন্নাত আলী, তার মা’কে লিখছেন, “মা, আমার সালাম গ্রহণ করবেন। পর সংবাদ, আমি আপনাদের দোয়ায় এখনও পর্যন্ত ভালো আছি।কিন্তু কত দিন থাকতে পারব বলা যায় না। বাংলা মাকে বাঁচাতে যে ভূমিতে আপনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন, যে ভাষায় কথা শিখিয়েছেন, সেই ভাষাকে, সেই জন্মভূমিকে রক্ষা করতে হলে আমার মত অনেক জিন্নার প্রাণ দিতে হবে। দুঃখ করবেন না, মা। আপনার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে যদি আপনার এই নগণ্য ছেলের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়, সে রক্ত ইতিহাসের পাতায় সাক্ষ্য দিবে যে বাঙালি এখনও মাতৃভূমি রক্ষা করতে নিজের জীবন পর্যন্ত বুলেটের সামনে পেতে দিতে দ্বিধা বোধ করেনা।“ এরকম অসংখ্য চিঠি আছে এই অনন্য সাধারণ গ্রন্থটিতে, যে চিঠি গুলো পাঠ করলে গণসংগীত শিল্পী ও গীতিকার আবদুল লতিফের সেই অমর গানটির কথা মনে হয়,” দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা/কারো দানে পাওয়া নয়/দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি/জানা আছে জগৎময়/”
নয়মাস সশস্ত্র যুদ্ধ শেষে যে বিজয় এসেছিলো, এই সুবর্ণ ভূমিতে সেই বিজয় পতাকা যাদের রক্তে স্নাত হয়েছিলো তাঁরা হলেন আমাদের সশস্ত্র, নিরস্ত্র, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শীতাহীন মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার জন্য তাদের প্রাণের আবেগ ছিলো দুর্দমনীয়। সীমাহীন দেশপ্রেমকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট মারণাস্ত্র দিয়ে দমন করা যায়না। একাত্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন সহ যুদ্ধবিদ্যায় সর্বোচ্চ পারদর্শী দেশ গুলো ছিলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী পক্ষ। এসমস্ত দেশের আধুনিক মারণাস্ত্র গুলো ব্যবহার করা হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধাদের পাঁজর বিদীর্ন করে ফেলার জন্য। নির্মম সত্য হচ্ছে, চীন, মার্কিনীদের মারণাস্ত্র এবং আধুনিক যুদ্ধ বিদ্যায় প্রশিক্ষিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর যুদ্ধ কৌশল পরাভূত হয় “ভীতু” এবং “ভেতো” বাঙালির সীমাহীন দেশ প্রেমের শক্তির কাছে। একাত্তরের চিঠি গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন অল্প শিক্ষিত তরুণ, কামার, কুমার, জেলে, কৃষক, মজুর সহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষ। মাতৃভূমির গ্লানি মোচনের জন্য, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গার উদ্দেশ্যে তারা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন মুক্তির জন্য যুদ্ধে। তাদের না ছিলো যুদ্ধবিদ্যায় প্রশিক্ষন, না ছিলো যুদ্ধের জন্য নুন্যতম প্রস্তুতি। আধুনিক মারণাস্ত্র কতটা ভয়াবহ এ’বিষয়ে কোন ধারনা না নিয়েই তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। প্রকৃত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তারা বুঝতে পারেন কী অসম যুদ্ধে তারা লিপ্ত হয়েছেন। যুদ্ধ যতই অসম হোক দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করতে তাঁরা কোন অবস্থাতেই পিছু হটে যাননি। তারা অসীম সাহসে বুক চিতিয়ে লড়াই করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধে দেশের ডাকে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী থেকে পালিয়ে এসে, বিদ্রোহ করে যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা যুদ্ধ করেছেন প্রশিক্ষনের প্রথা অনুযায়ী। বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা থেকে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তারা দেশ প্রেমের আবেগকে যুদ্ধাস্ত্রে পরিণত করে আমরণ লড়াই করে গেছেন।
লক্ষ শহীদের রক্তের দামে কেনা এই বাংলাদেশ, এই দেশটিকে কী আমরা শহীদের স্বপ্নের গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি? আমরা দেশ এবং জাতি হিসাবে অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধন করেছি। কিন্তু এই মহিমান্বিত বিজয়ের জন্য যে অসাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্যহীনতা অর্জনের প্রয়োজন ছিলো তা’ কিন্তু এখনও আমরা অর্জন করতে পারিনি। অর্জিত উন্নয়নের সাথে মানুষের স্বাধীনতার একটি বড় সম্পর্ক আছে। স্বাধীনতা ও সকল মানুষের প্রতি সমদৃষ্টি প্রদান করা না গেলে গাণিতিক উন্নয়ন হবে, এ’ কথাটি বলা যায় কিন্তু বৈষম্য হ্রাস করা কঠিন হবে। আধুনিক যুগে এ’ বিষয়টি নিয়ে সব চেয়ে উচু গলায় কথা বলেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। উন্নয়ণ, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা যে পরস্পর সংযুক্ত, অমর্ত্য সেনের মতো আর কেউ এতো উচ্চকিত নন। এ’ কথাটি বঙ্গবন্ধু তাঁর দূর দৃষ্টি দিয়ে বুঝেছিলেন বহু পূর্বে। এ’ জন্য তিনি মানুষের মুক্তির প্রসঙ্গকে নিয়ে এসেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা লগ্নে। বঙ্গবন্ধু “স্বাধীনতা” ও “মুক্তি” দুটি শব্দকে দুটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। স্বাধীনতাকে তিনি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির অর্থে ব্যবহার করেছিলেন আর মুক্তি বলতে সকল ধরনের শোষন থেকে মুক্তি লাভ করে বৈষম্য হীন সমাজ গঠনকে বুঝিয়েছিলেন। এ’কারনে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষনে স্বজ্ঞানে তিনি বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। তাই আমরা দেখে থাকি, খুব স্বাভাবীক ভাবে বায়াত্তরের সংবিধানে বৈষম্যনিরসন ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমাজতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো। বিজয়ের ৫১ বছর অতিক্রম করার এ’সময়ে আমরা হয়তো “স্বাধীনতা”র অনেক সুফল আমরা পেয়েছি। কিন্তু মুক্তির সংগ্রামের সুফল আমরা পাইনি বললেই চলে। মুক্তির সংগ্রাম এখনও চলমান।
স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী অতিক্রম করে বাংলাদেশ একান্ন বছরে পা দিয়েছি। একান্ন বছর খুব কম সময় নয়। এবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হবে রাষ্ট্রকে আরও মানবিক করে গড়ে তোলার আন্দোলনে, আর এ’কাজটি করতে পারে সকল মানুষকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামীলীগ। মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারেন তৃণমূল থেকে ওঠে আসা নেতারা। যেমন বঙ্গবন্ধু উঠে এসছিলেন টুংগীপাড়ার নিভৃত গ্রাম থেকে। কতো ত্যাগ, দেশের প্রতি কতো ভালোবাসা, অংগীকার, দায়বদ্ধতাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি একজন মহান নেতা হতে পেরেছিলেন। যাকে অনন্তকাল বাংলাদেশ ও বাঙালি অনুসরন করে যাবে। এরকম নেতার দেখা পাওয়ার জন্য আমাদেরকে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে অবশ্যই সংস্কার করতে হবে। রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে “সৌখিন” রাজনীতিবিদদের হাত থেকে। রাজনীতিকে হতে হবে জবাবদিহিমূলক, স্বচ্ছ ও সাধারণ মানুষের সহজ অংশগ্রহন সমৃদ্ধ। আমরা কী পারবো তা করতে? পারতেই হবে আমাদের,কারন সার্বিক মুক্তিই পারে, বিজয়ের আস্বাদ প্রদান করে প্রাণ প্রাচুর্যময় একটি দেশ উপহার দিতে।
লেখক : প্রাবন্ধিক।