কেন আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ ডিসেম্বর ২০২২, ৬:৫০:১৪ অপরাহ্ন
সীতাব আলী
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কারণগুলো অনেকেই ভুলে গেছেন, আবার আমাদের বর্তমান প্রজন্মের অনেকে জানেই না। আসলে নিজের শেকড়ের খবরটা জানতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের হাজারো কারণের মধ্য থেকে নিকট-অতীতের কিছু কারণ এই নিবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, নিবন্ধটি আপনাদের ভাল লাগবে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়ে গেছে। বড় অদ্ভুত এক রাষ্ট্র। মধ্যখানে প্রায় ১২০০ কিলোমিটারের বিশাল ভারত, ভারতের পূর্বপাশে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ আর পশ্চিম পার্শে ‘পশ্চিম পাকিস্তান’, বিশাল দূরত্বের এই দুই ভুখন্ড মিলে হল ‘পাকিস্তান’। রাষ্ট্রটির জন্মলগ্ন থেকেই ভাষার প্রশ্নে দ্বন্দ্ব লেগে যায়। পাকিস্তানের প্রথম প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সে দিনের ভাষণে দেওয়া ভাষা সংক্রান্ত তথ্য যে কত মিথ্যা ছিল, তা দেখলে আপনি বিস্মিত হবেন এই ভেবে যে, এ রকম মিথ্যার বেশাতি নিয়ে একজন লোক কি ভাবে একটি সদ্য-স্বাধীন ‘মুসলিম’ দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরে ছিল।
স্মরণ করা যেতে পারে যে পাকিস্তান গণপরিষদের আইনবিধি সংক্রান্ত কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেছিলেন, ‘উপমহাদেশের দশকোটি মুসলমানের দাবী অনুযায়ী পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছে এবং দশকোটি মুসলমানের ভাষা উর্দু। পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং কেবল মাত্র মুসলমান জাতির ভাষাই ‘রাষ্ট্র ভাষা’ হতে পারে। উর্দুই একমাত্র ভাষা, যা পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিম অঞ্চলের মানুষকে যুক্ত রাখতে পারে। একটি জাতির একটি মাত্র ভাষা থাকতে পারে এবং কেবল মাত্র উর্দুই সে ভাষা হতে পারে; অন্য কোন ভাষা নয়।’ এখন দেখি তার তথ্য কতখানি সত্য ছিল!
যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় তখন পূর্ব বাংলার একমাত্র ভাষা ছিল বাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীদের ভাষা উর্দু, পাঞ্জাবী, পুশতু, বালুচ ও ব্রুহুই। আবার ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে গৃহিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পাকিস্তানের ৭ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ হল বাংলা ভাষী। এরা মুসলমান, নগন্য সংখ্যক অমুসলিম তখন পূর্ব বাংলায় ছিলেন, যার অর্থ হচ্ছে মোট জনসংখ্যার ৬৪ ভাগই ছিল বাংলা ভাষী। বিষয়টি অন্য ভাবে বলতে গেলে বলা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানের ৭টির বেশী ভাষাভাষী মিলে ছিল ৩৬ ভাগ। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এ তথ্য জানতেন না বলার কোন সুযোগ নেই; তিনি ইচ্ছে করেই ভাষা নিয়ে রাজনীতি করে ছিলেন, তথ্য গোপন করে মিথ্যা বলে ছিলেন।
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের বড়লাট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালিন রেসকোর্স ময়দান) তাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। এর জবাবে তিনি এক ঘন্টা স্থায়ী ভাষণ দেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, …‘এ কথা আপনাদেরকে পরিস্কার ভাবে বলে দেওয়া দরকার যে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু, অন্য কোন ভাষা নয়।’ তখনই বাঙালিরা গর্জে উঠে ছিল, প্রতিবাদের ঝড় উঠে ছিল।
বায়ান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ভাষার প্রশ্নে পুরো পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানীরা গুলি চালিয়ে শহীদ করে ফেলে আব্দুস সালাম, রফিক, আবুল বরকত, আব্দুল জব্বারকে, আহত করে অনেককে। আন্দোলন থেমে থাকেনি। বলা যায় পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালীদেরকে আন্দোলন ও সংগ্রাম করতে হয়েছে। আর সবগুলো আন্দোলন মূলত: স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকেই এগিয়ে যায়। ভাষা আন্দোলন ছিল মুক্তিযুদ্ধের বীজ। ভাষা আন্দোলন জানতে হলে পড়তে হবে ভাষা আন্দোলনের উপর প্রকাশিত আলাদা বই। সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠলো। সচেতন মানুষ থেকে অতিসাধারণ মানুষও বুঝতে পারলো পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষণের ঘটনাসমুহ। তার আগে, ১৯৫১ সালে পূর্ববাংলায় লবণ সংকট সৃষ্টি করা হল। সেসময় ভারত থেকে লবণ আমদানী করতে হত। সেই লবণ প্রথমে যেত করাচী সমুদ্র বন্দরে, তারপর ‘পাকিস্তানী-লবণ’ হয়ে আসত পূর্ব পাকিস্তানে। করাচী থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত জাহাজ-ভাড়া পূর্ব বঙ্গের মানুষকেই বহন করতে হত। আর অধিকাংশ ব্যবসায়ী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী, তারা এই সুযোগে লবণকে দুষ্প্রাপ্য করে দিল, এবং স্বাভাবিক ভাবেই তার দাম উঠলো আড়াই টাকা কেজি, যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে লবণের কেজি পাওয়া যেত দুই পয়সায়, তখন ৬৪ পয়সায় ছিল এক টাকা, আর এক টাকায় দুই কেজির বেশী চাল পাওয়া যেত।
আরো একটি ঘৃন্য শোষণপ্রক্রিয়া দেখুন- পুরো পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬% ভাগ বাস করে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে (তথা বাংলাদেশে)। শোষকরা পুরো পাকিস্তানকে ৫ টি প্রদেশে ভাগ করে। স্বাভাবিক ভাবেই মোট বাজেটের ৫ ভাগের এক ভাগ পায় শতকরা ৫৬ জন মানুষ অধ্যুশিত বাংলাদেশ, আর শতকরা ৪ ভাগ পায় ৪৪ জন মানুষ, অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানীরা! আরো সহজ করে এরকম বলা যায়, পাকিস্তানের বাজেট ১০০ টাকা হলে পূর্ব পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ মানুষ পায় ২০ (বিশ) টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানের ৪৪ ভাগ মানুষ পায় ৮০ টাকা। কী শোষণ, বাপরে বাপ! সেনাবাহিনীতে বাঙালী চান্স পায় না, বাঙালীর উচ্চতা ও বুকের মাপ গড়পড়তা পশ্চিম পাকিস্তানীদের চেয়ে কম! অথচ ভারতের গোর্খারা বাঙালীদের চেয়ে সাইজে ছোট হলেও ভারতে তাদের আলাদা রেজিমেন্ট আছে। ভোজ্য তেল পূর্ব পাকিস্তানে দশ আনা আর পশ্চিম পাকিস্তানে চার আনা। দ্রব্যমূল্য সব সময়ই পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তান বহু গুণ বেশী। চাকুরীর কথা আর কি বলবো, বাঙালীর ভাগ্যে সরকারী চাকুরীর শিকে সহজে ছিড়ে না। ডিসি ভিসি ডাক্তার ইঞ্জিনীয়ার চৌকিদার মোক্তার উকিল এমনকি প্রধানশিক্ষকতাও করে গেছে পশ্চিম পাকিস্তানীরা এদেশে। কত ধরণের শোষণের কথা বলবো!
পাকিস্তানের জন্ম থেকে ২৩ বছর আমরা তাদের সাথে ছিলাম। এই সুদীর্ঘ ২৩ বছরে কোন বাঙালি সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন না, নৌবাহিনী প্রধান ছিলেন না বা বিমান বাহিনী প্রধানও ছিলেন না। আর এদের কোনটারই প্রধান দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে ছিল না। অর্থমন্ত্রি বা পরিকল্পনা মন্ত্রি কোন বাঙালী ছিলেন না। দেশের রাজধানী, সংসদ ও রাষ্ট্রিয়ব্যাংকের প্রধান দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সিভিল সার্ভিসে বাঙালী শতকরা ৭ জন, পশ্চিম পাকিস্তনী শতকরা ৯৩ জন; ডেপুটি সেক্রেটারী পূর্ব পাকিস্তানের ২৩ জন, পশ্চিম পাকিস্তানের ৭৭ জন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানে একটি মাত্র নতুন কলেজ স্থাপিত হয়, এবং সেটি হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। মেডিকেল কলেজ পূর্ব পাকিস্তানে ১টি, পশ্চিম পাকিস্তানে ৬টি। ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ পূর্ব পাকিস্তানে ১টি, পশ্চিম পাকিস্তানে ৩টি; বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ব পাকিস্তানে ২টি, পশ্চিম পাকিস্তানে ৪টি। পূর্ব পাকিস্তানে কলেজ মোট ৫৬টি, পশ্চিম পাকিস্তানে ৭৬টি। প্রাইমারী স্কুল পূর্ব পাকিস্তানে ২২১৭টি, পশ্চিম পাকিস্তানে ৬২৪৬টি। হাসপাতাল বেডের সংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানে ৫৫৮৯টি, পশ্চিম পাকিস্তানে ১৭৬১৪টি। ডাক্তার পূর্ব পাকিস্তানে ৩৩৯৩ জন, পশ্চিম পাকিস্তানে ৮৫০০ জন। মেটারনিটি হাসপাতাল পূর্ব পাকিস্তানে ২২টি, পশ্চিম পাকিস্তানে ১১৮টি। আবার বৈদেশিক সাহায্যের ব্যয় পূর্ব পাকিস্তানে ২৩, পশ্চিম পাকিস্তানে ৭৭, আর কত বলবো- মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব বাঙালীদের কাছে এসকল শোষণের বিষয় আলাদা আলাদাভাবে তুলে ধরে দেশব্যাপী গণসংযোগ, সভাসমিতি ও মিছিলদ্বারা পুরো পূর্ব পাকিস্তানে জাগরণের জোয়ার তোলেন।
পূর্ব বাংলার দাবী দাওয়া নিয়ে উত্তাল আন্দোলন সামাল দিতে প্রেসিডেন্ট আউয়ুব রাওয়ালপিন্ডিতে মার্চের প্রথম পক্ষে গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলার অলিখিত একক প্রতিনিধি হিসেবে এ বৈঠকে যোগদান করেন। ১৪ই মার্চ, ১৯৬৯ইং দৈনিক ইত্তেফাক খবর দেয়, ‘চার দিন একটানা ভাবে আলোচনার পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব কর্ত্তৃক বয়স্ক ভোটাধিকার ও পার্লামেন্টারী সরকার প্রতিষ্ঠার দাবী মানিয়া নেওয়ার মধ্য দিয়া অদ্য, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যকার গোল টেবিল বৈঠক সমাপ্ত হয়, কিন্তু প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও এক ইউনিট বিলোপের মত গুরূত্বপূর্ণ প্রশ্নে গোল টেবিল বৈঠকে কোন সিদ্ধান্তে পৌছতে সক্ষম হয় নাই।’ পুর্ববাংলার এই সকল দাবী দাওয়া মেনে নিতে না পেরে স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব, ২৪ মার্চ পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এ.এম. ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তাšতর করে পদত্যাগ করেন। কিস্তু ইয়াহিয়া ছিলেন পাকিস্তানের সবচেয়ে কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট । কে জানতো তারই হাতে সুবিশাল পাকিস্তান রাষ্ট্রের কবর রচিত হবে।
১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর প্রলয়ংকরী জলোচছাসে পূর্বপাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে। এই দুর্যোগের সময় ভারত, বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যথার্থ সাড়া দিলেও পশ্চিম পাকিস্তানী শাষক গোষ্ঠীর টনক নড়েনি। একজন কেন্দ্রীয মন্ত্রী ও উপদ্রুত এলাকা সফরে আসেনি। পূর্বপাকিস্তানের বিপদের দিনে পশ্চিম পাকিস্তানীদেরকে কাছে না পাওয়া, পূর্ববাংলার মানুষ ভুলতে পারেনি। তাই ৩০ নভেম্বর মওলানা ভাসানীর ডাক-পূর্ব পাকিস্তানের আজাদী রক্ষা ও মুক্তি সংগ্রামে ঝাপাইয়া পড়ুন। ৪ ডিসেম্বর, পল্টনের জনসভায় নব্বই বৎসর বয়স্ক জননেতা ভাসানী বলেন, ‘মুজিব তুমি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সংগ্রামে যোগ দাও।’ গণআন্দোলন যখন বাঁধভাঙা রূপ ধারণ করলো, দেশ যখন ফুঁসে উঠলো, নির্বাচন ঘোষণা করা হল। শেখ মুুজিব ছাড়া পেলেন, ছয় দফা নিয়ে সারা দেশ চষে বেড়ালেন। আওয়ামীলীগের ছয় দফা খুব শর্টকাট ছিল। কিন্তু তাতে অস্পষ্টভাবে নিহিত ছিল স্বাধীনতা। আসলো কাংখিত সেই ঐতিহাসিক নির্বাচন, পাকিস্তানের কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অধীনে।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মুক্তির একমাত্র নায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বাঙালীরা নির্বাচন করে। পূর্ব পাকিস্তানে ৩১০ আসনের মধ্যে আওয়ামীলীগ (তথা শেখ মুজিব) ২৯৮ আসনে বিজয়ী হয়। জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩ আসনে আওয়ামীলীগ ১৬৭ আসন পেয়ে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। (এই ৩১৩ আসন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে জাতীয় পরিষদের মোট আসন ছিল।) সত্তর সালের সাধারণ নির্বাচনে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানীদের নেতৃত্ব আর চায়না। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী ষড়যন্ত্রকারী শাসকগোষ্টী জনগণের রায়ের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের শোষণের প্রক্রিয়া অব্যহত রাখতে মরিয়া হয়ে উঠে।
২১ ডিসেম্বর (১৯৭০) পাকিস্তান টাইমস খবর দেয় ‘পশ্চিম পাকিস্তানের লারকানা থেকে লাহোর এসে গত রবিবার (পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা) মিঃ ভুট্টো ঘোষণা করেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিব একা পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র তৈরী করতে পারবেন না। শুধুমাত্র আওয়ামীলীগ মন্ত্রীসভাও গঠন করতে পারবে না।’ (উল্লেখ্য যে, পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর দল সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে ছিল।) কী অগণতান্ত্রিক দম্ভ! বলে কি, নিরঙ্কুশ সংখ্যাাগরিষ্টতা লাভ করেও শেখ মুজিব মন্ত্রীসভা গঠন করতে পারবেন না! সে সময়ের বিশিষ্ট সাংবাদিক, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা, অনেক গ্রন্থের লেখক শহীদ আল বোখারী বলেন, ‘বাংলাদেশে গণহত্যার জন্যে যদি একক ভাবে কাউকে দায়ী করা যায়, তবে সে হচ্ছে এই জনধিকৃত জুলফিকার আলী ভুট্টো!
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ১৭ ফেব্রুয়ারী ইঞ্জিনীয়ার্স ইন্সটিটিউটের এক সম্মেলনে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলনকে কোন শক্তিই থামাতে পারবে না।’ ২২ ফেব্রুয়ারী (১৯৭১) দেশের পরিবর্তনশীল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিলে আপনাতেই সকল ক্ষমতা আবার তার হাতে কেন্দ্রীভূত হয়।
২ মার্চ ফার্মগেটে জনতার উপর পাকিস্তানীরা গুলী বর্ষণ করে, ফলে ঘটনাস্থলেই দু‘জন নিহত হয়। এ ঘটনা দেশের রাজনৈতিক মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ‘দ্যা পিপল’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রেসনোটে শেখ মুজিব বলেন, ‘গুলী করে বাঙালীকে আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। বাংলাদেশ আর কারো কলোনী নয়।’ অনেক টালবাহানার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসবে বলে ঘোষণা দেন। এরই মাঝে অতি দ্রুত অনেক ঘটনা ঘটতে থাকে। ভুট্টোসহ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আলোচনার জন্যে ঢাকায় আসে। শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার বাহানা চলে। ইতিমধ্যে যা আঁচ করার করা হয়ে গিয়েছে। মূলত এই আলোচনা ছিল একটি সময় ক্ষেপণের বাহানা। এই সময়ের ভেতরেই ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গোপনে অস্ত্র ও সৈন্য আমদানী করতে থাকে, বিষয়টি ধরা পড়ে শেষ মুহূর্তে। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তুত হতে থাকে যুদ্ধের জন্যে, কোথাও কোথাও গোপনে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শুরু হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনায় কোন অগ্রগতি না দেখে ছাত্রলীগের নেতারা বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন শেখ মুজিবের বাড়িতে। ৭ মার্চ শেখ মুজিব ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন, তা প্রচার হবে রেডিও থেকে। তখন তাৎক্ষণিক ভাবে সংবাদ জানার একমাত্র মাধ্যম ছিল রেডিও। রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতা জড়ো হলো, শেখ মুজিব মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েই দিলেন, কিন্তু তা সাথে সাথে প্রচার হল না। চক্রান্তকারীর দোসর কর্তারা ভাষণটি প্রচার করলো না। প্রচার হলো পরদিন।
৭ই মার্চের ভাষণ ছিল বাঙালির প্রাণের কথা, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তা শোনতে উদগ্রীব ছিল। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ মানুষের মাঝে দরাজগম্ভীর কন্ঠে বল্লেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে, শত্রুর মোকাবেলা করো। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয়বাংলা!’
নানা রকম অপ্রত্যাশিত ও লোমক হর্ষক ঘটনায় ভরা মার্চ মাস, আশ্চর্যসব ঘটনা দেশকে মুক্তিযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। আসে সেই কালো রাত। ২৫ মার্চ (১৯৭১) দিবাগত রাত। অতর্কিতে পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশে। গণহত্যা লুন্ঠন ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ, এমন কোন কুকর্ম নেই, যা তৎকালীন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী করেনি। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়সমুহের ছাত্র হোস্টেল ও ছাত্রী হোস্টেলগুলো আক্রান্ত হয়। ছেলেদেরকে হত্যা করে, মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর ছুটে তারা গ্রামাঞ্চলের দিকে। সেখানেও চালায় তান্ডব। বাবার সামনে মেয়েকে ধর্ষণ, ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণ, যুবকদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া আর তারপর সবাইকে হত্যা, কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রামবাসীকে জড়ো করে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা হয়ে উঠে নিত্যদিনের ঘটনা। বাংলাদেশ হয়ে যায় এক নরকপূরী।
বাঙালীরাও বসে থাকে নি। তুলে নেয় অস্ত্র। নয় মাসের অসম যুদ্ধে এই ঢাকার বুকে ৯৩ হাজার সসস্ত্র পাকিস্তানীকে যৌথবাহিনীর কাছে লজ্জাজনকভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। অভ্যুদয় ঘটে স¦াধীন বাংলাদেশের!
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পরিচালক, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, সিলেট।