সময়ের সাহসী সন্তান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ডিসেম্বর ২০২২, ৭:১৬:২৫ অপরাহ্ন
মো. নজিবুর রহমান
বিশ্ববরেণ্য কূটনীতিবিদ স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর ৯৪তম জন্মজয়ন্তীর মূল অনুষ্ঠানসমুহ এবার তাঁর জন্মস্থান ও প্রিয় শহর সিলেটে উদযাপিত হচ্ছে। প্রতি বছরের মত এবারও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্মৃতি পরিষদের নির্বাহী কমিটি তাঁর জন্ম জয়ন্তী যথাযথ মর্যাদার সাথে উদযাপনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। মহান বিজয় দিবসের পর দিন ১৭ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে সিলেটে মরহুম স্পিকারের জীবনাদর্শ ও কর্ম সম্পর্কে একটি আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ভার্চুয়ালী প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করবেন। মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া প্রথিতযশা সিভিল সার্ভেন্ট এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ইনাম আহমদ চৌধুরী মুখ্য আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখবেন।
জন্মজয়ন্তীতে মরহুমের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও জাতীয় জীবনে তাঁর বিশেষ অবদানের কথা স্মরণ করে বাণী প্রদান করেছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মাননীয় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তাঁরা সকলেই মরহুম স্পিকারের বর্ণাঢ্য কূটনৈতিক জীবনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
জন্মজয়ন্তীতে মরহুমের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে নতুন প্রজন্মের অবগতির জন্য আমি তাঁর কূটনৈতিক জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিকে সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস চালাব।
পাকিস্তান আমলে কূটনৈতিক জীবনের শুরুতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শেষে তাঁর প্রথম পোষ্টিং হয় ইতালীতে। মিশনের প্রথম পোস্টিং বিধায় রোমে দ্বিতীয় সচিব হিসেবে কর্মরত থাকাকালের স্মৃতি বোধ হয় তাঁর কাছে খুবই প্রিয় ছিল। কূটনৈতিক জীবন নিয়ে আলাপচারিতায় রোমের প্রসংগ আসত। রোমের ইতিহাস, ঐতিহ্য প্রসংগে চমৎকার বর্ণনা দিতেন। এসব বর্ণনা শুনলে রোম শহর দেখার আগ্রহ কার না জন্মায়? আমিও তার ব্যতিক্রম হইনি। ১৯৯৪ সনে মিয়ানমারস্হ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে বদলী হয়ে আসার সময় সঞ্চয়ের একটা অংশ দিয়ে ব্যক্তিগত খরচে সপরিবারে পাড়ি জমাই ইউরোপে। অন্যতম উদ্দেশ্য রোম শহর দেখা। যাক সেকথা অন্য সময় হবে। এখন মূল প্রসংগে আসি।
রোমে থাকাকালে স্যার (মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী) বহু বিখ্যাত লোকদের সান্নিধ্যে আসেন। এর মধ্যে একজন হলেন পাকিস্তানের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে একবার প্রটোকল করার সময় তিনি হোটেলে তাঁর কক্ষে বসে চা পান করছেন। হঠাৎ করে সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন- এবহঃষবসধহ, ধৎব ুড়ঁ ংঁৎব ুড়ঁ ধৎব ভৎড়স ঃযব ঊধংঃ চধশরংঃধহ (আপনি কি সত্যি পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা)? যুবক হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর উজ্জল চেহারা ও চমৎকার বাচনভংগী দেখে সোহরাওয়ার্দী সাহেব নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। স্যার হ্যাঁ বলায় সোহরাওয়ার্দী বলতে থাকেন ‘ণড়ঁ যধাব ধ নৎরমযঃ ভঁঃঁৎব, ও পড়ঁষফ ংবব. ইঁঃ হবাবৎ ৎধরংব ুড়ঁৎ যবধফ ধনড়াব ধাবৎধমব. ঞযবু ড়িঁষফ পযড়ঢ় ুড়ঁৎ যবধফ রহ ঊধংঃ চধশরংঃধহ.’ (আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। তবে কখনও গড় উচ্চতার ওপরে মাথা তোলার চেষ্টা করো না। ওরা পূর্ব পাকিস্তানে তোমার মাথা কেটে ফেলবে।)
স্যার মজা করে বলতেন, সোহরাওয়ার্দীর ঐ সাবধানবাণী তিনি চাকুরী জীবনে সবসময়েই মনে রেখেছিলেন। কোনদিন আত্মপ্রচারে ব্রতী হননি। স্মরণ করিয়ে দিতেন পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পাবার পরই কেবল ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রায়’ তিনি প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাতকার দেন।
রোমে থাকাকালে অন্যান্য যে সব বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সাথে তিনি পরিচিত হন তাঁদের অন্যতম ছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর প্রসংগ আসলেই চাচী (স্যারের সহধর্মিণী বেগম মাহজাবীন চৌধুরী) শুরু করতেন কিভাবে বঙ্গবন্ধু তাঁকে মাছ রান্না করা শিখিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলেন তাঁর বন্ধু জহির উদ্দিন। বঙ্গবন্ধু বাজার থেকে ছোট মাছ কিনে এনে তাঁর বন্ধু জহির উদ্দিনকে নিয়ে মাছ কাটেন ও পরিষ্কার করেন। তারপর চাচীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘মিসেস চৌধুরী আপনি কেমন গৃহিণী হবেন আমি তার পরীক্ষা নেব’। চাচী কিছুটা থতমত খেয়ে যান। সে পরীক্ষাটা আবার কেমন?
কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু চাচীকে বললেন সরিষার তেলের বোতলটা আনেন তো। চাচী কিছুক্ষণের মধ্যে এক বোতল সরিষার তেল এনে বঙ্গবন্ধুর হাতে দিতেই মন্তব্য শুনেন- ‘পাশ করে গেলেন তো। আপনি সুগৃহিণী হবেন। আমি তো ভাবিইনি আপনি ঘরে সরিষার তেল রাখবেন, মিসেস চৌধুরী’।
চাচী আশ্বস্ত হলেন। স্যার (বলতেন, এর পর থেকে বাসায় আর কেবল আলু-ভর্তা আর ডাল খেতে হতো না। খাবার টেবিলে মাছের তরকারী আসতে শুরু করলো। চাচী লজ্জার হাসি হাসতেন। আমরা স্নেহাস্পদরা মজা পেতাম। অভিজ্ঞ রাধুনী বেগম মাহজাবীন চৌধুরীও তাহলে এক সময় ভাল রান্না-বান্না জানতেন না। আর অথচ এখন। স্যারের আকস্মিক মৃত্যুতে মতিউর রহমান চৌধুরী মানব জমিনে যে লেখাটি লিখেছিলেন তাতে মাহজাবীন চৌধুরীর কথা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।
রোমে থাকাকালে কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনার স্মৃতিচারণও স্যারের মুখে শুনেছি। এর মধ্যে একটি ছিল পাকিস্তানের তৎকালীন কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রীর সাথে তাঁর বাক-বিতন্ডা। পশ্চিম পাকিস্তানের ঐ মন্ত্রীর সাথে কয়েকদিন প্রটোকল ডিউটি করেছিলেন তরুণ কূটনীতিবিদ হুমায়ুন রশীদ। কিন্তু খিট্ খিটে মেজাজের মন্ত্রী সদাচরণ করছিলেন না তাঁর সাথে। সব সময়ই মেজাজ দেখান আর দোষত্রুটি খোজে বেড়ান। রাত্রে ঘুমুতে যাবার সময়ই কেবল ছুটি দেন পূর্ব পাকিস্তানী কূটনীতিকে। কষ্ট হলেও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন তরুণ কূটনীতিবিদ। কিন্তু একদিন মন্ত্রী অকারণে চটে গিয়ে তাঁকে বকাবকি শুরু করেন। এক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী জাতি সম্পর্কেও মন্ত্রী করে বসেন কটুক্তি। আর যাবেন কোথায়? তেজী হুমায়ুন হুংকার দিয়ে ওঠে ধাক্কা দেন মন্ত্রীকে। নিজেকে সামলাতে না পেরে ধরাশায়ী হয়ে পড়েন পাকিস্তানী মন্ত্রী। দূতাবাসের ও হোটেলের লোকজন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। দেশে ফিরে গিয়ে মন্ত্রী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নালিশ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানি মন্ত্রীর গায়ে হাত তোলার অভিযোগে নির্ঘাৎ চাকুরীচ্যুতির কথা ভেবে স্ত্রীকে বাক্সপেটরা বাধার জন্য বলেন তিনি। স্থির করে বলে ফেলেন দেশে গিয়ে সিলেটে পৈত্রিক চা বাগান দেখাশুনা করবেন।
মন্ত্রীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্ত চালায়। তদন্তে নবীন সরকারী কর্মকর্তার উপর মন্ত্রী অহেতুক বাড়াবাড়ি করেছিলেন বলে প্রমাণ হয়। তবে মন্ত্রীর গায়ে হাত তোলা উচিত হয়নি বলে তরুণ কূটনীতিবিদকে সতর্ক করে দেয়া হয়। সে যাত্রা রক্ষা পান হুমায়ুন। মজা করে বলেন, কূটনৈতিক জীবনের তিন ফাঁড়ার একটা কাটান তিনি। অপর দুটি ফাঁড়া ছিল পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হবার সম্ভাবনা এবং পচাত্তরের পনের আগস্টের নৃশংস হত্যাকান্ডের পরে খোন্দকার মোশতাকের হাতে চাকুরীচ্যুতির ও বন্দী হবার সম্ভাবনা।
মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ
রোম শহরের পর তিনি বৈরুত, আম্মান, বাগদাদ ও প্যারিসের মত গুরুত্বপূর্ণ রাজধানীতে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সনের মার্চ মাসে জাকার্তায় পাকিস্তান দূতাবাস থেকে তাঁকে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে পাকিস্তান হাই কমিশনে বদলী করা হয়।
হোমলীভ নিয়ে সপরিবারে ঢাকায় ও সিলেটে ছুটি কাটিয়ে তিনি পরে দিল্লী যাবার সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুসারে জাকার্তা থেকে ব্যাংকক আসেন। পিআইএ’র ফ্লাইটে ঢাকা যাবেন বলে টার্মিনাল ভবনে অপেক্ষা করছেন। হঠাৎ এক পশ্চিমা নাগরিক তাঁর কাছে এসে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী কিনা এবং ঢাকায় যাবেন কিনা জানতে চান। উত্তর হ্যাঁ বোধক শুনে ভদ্রলোক নিজেকে ঢাকাস্থ বিবিসি সংবাদদাতা বলে পরিচয় দেন এবং গতরাত্রে (২৫ শে মার্চ, ১৯৭১) ঢাকাতে পাকিস্তানী হানাদার সেনাবাহিনীর নারকীয় হত্যাকান্ড ও নির্যাতনের বিবরণ দেন। সবশুনে স্যার তাঁর পরিবার নিয়ে সোজা দিল্লি চলে যান।
দিল্লীস্থ মিশনে তিনি পাকিস্তানি হাইকমিশনারের রোষানলে পড়েন। এ সময় তাঁকে ডিউটির নামে পাকিস্তানে পাঠিয়ে বন্দী করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি গোপনবার্তা পূর্বাহ্নে তাঁর নজরে পড়ায় তিনি ষড়যন্ত্রটি আঁচ করতে পারেন এবং বেশ কিছু বাঙ্গালী কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ দূতাবাস ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন।
দিল্লীতে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে তিনি প্রবাসী সরকারের পক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে কূটনৈতিক যোগাযোগের সূত্র হিসেবে কাজ করেন। অধিকন্ত তিনি প্রবাসী সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালান এবং প্রায় ৪০টি দেশের সমর্থন আদায় করেন।
আমি পররাষ্ট মন্ত্রণালয়ে কর্মরত থাকাকালে (১৯৮৮-১৯৯৪) সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে এ সম্পর্কে বহু গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনেছি। পার্লামেন্ট থেকে তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে কয়েকবার দিল্লী সফরকালে তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য আগত ভারতীয় রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, কর্মকর্তা বিশেষ করে বাংলাদেশ মিশনের পুরাতন ভারতীয় কর্মচারীদের মুখ থেকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর গৌরবোজ্জল ও সাহসী ভূমিকার কথা শুনেছি।
স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে তিনি বিভিন্ন রণাঙ্গন ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সফর করেছেন। জনমত গঠনের জন্য বক্তৃতা করেছেন। ছাত্রজীবনে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ ভারতে নিয়েছিলেন বিধায় হিন্দি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। বক্তৃতা বিবৃতি প্রদানে কোন অসুবিধা হয়নি তাঁর। স্মরণ করা যেতে পারে তিনি অবিভক্ত ভারতের শিলং এর সেন্ট এডমান্ড স্কুল ও কলেজ এবং আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন। পরে তিনি লন্ডনে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেন। পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগদানের পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ঞঁভঃং টহরাবৎংরঃু এর ঋষবঃপযবৎ ঝপযড়ড়ষ ড়ভ খধি ধহফ উরঢ়ষড়সধপু তে অধ্যয়ন করেন।
দেশ স্বাধীন হবার পর স্বাধীন বাংলাদেশের মিশন প্রধান হিসেবে ভারতীয় পার্লামেন্টের লোকসভা ও রাজ্য সভার যৌথ অধিবেশনে বক্তৃতা করার বিরল সম্মান লাভ করেন তিনি। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী পাকিস্তানী কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে লন্ডন হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে ভারতে এলে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান তিনি। ঢাকা আগমনের আগে ভারতীয় রাজনীতি ও স্বদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সংগোপনে জনাব চৌধুরীর কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি জেনে নেন বঙ্গবন্ধু। ঐ ঐতিহাসিক দিনে চরম ব্যস্ততার মাঝেও মিসেস চৌধুরীর মাছ রান্না কেমন জানতে চেয়ে বিস্মিত করে দেন। বঙ্গবন্ধু মিশন প্রধান হুমায়ুন রশীদকে বুঝিয়ে দেন প্রায় দেড় দশকের বেশি সময় আগে দেখা তরুণ কুটনীতিবিদকে তিনি ঠিকই চিনতে পেরেছেন। অন্যান্য সবার মত সেদিনের মিশন প্রধান হুমায়ুন রশীদও চমকে যান বঙ্গবন্ধুর মত বিশাল ব্যক্তিত্বের অসাধারণ স্মৃতিশক্তি দেখে।
স্যারের কুটনৈতিক জীবনের আরেকটি গৌরবময় অর্জন ছিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (টঘ এবহবৎধষ অংংবসনষু-টঘএঅ) এর ৪১ তম অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হওয়া। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক শংকর তার ‘কত অজানারে’ গ্রন্থে লিখেছিলেন বাংগালী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতির পদ অলংকৃত করতে যাচ্ছেন। কেবল দীর্ঘ ১২৫ (একশত পঁচিশ) বছর পর অন্য কোন বাঙ্গালীর ভাগ্যে এ আসন জুটতে পারে।
ঐ সময় সিলেটে সফরকালে স্যার ও তার ছোটভাই বিশিষ্ট কুটনীতিবিদ (মরহুম) কায়সার রশীদ চৌধুরীর মুখে প্রথম জেনেছিলাম এর আগে উপমহাদেশ থেকে কেবলমাত্র দুজন ব্যক্তিত্ব এই আসন অলংকৃত করেছিলেন। তারা হচ্ছেন, স্যার জাফর উল্লা (পাকিস্তান) ও মিসেস বিজয়লক্ষী পন্ডিত (ভারত)।
স্যার সাধারণ পরিষদের সভাপতিত্ব অত্যন্ত সফলতার সাথে পালন করেছিলেন। ঐ সময় জাতিসংঘ ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার সাধন করা হয় এবং অর্থনেতিক সংকট থেকে উত্তোরণের জন্য বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেয়া হয়। তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলোর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে বিভিন্ন সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য হচ্ছে -১৯৮৬ সালে উন্নয়নের অধিকার (জরমযঃ ঃড় উবাবষড়ঢ়সবহঃ) শীর্ষক দুটি রেজুলেশন গ্রহণ। উন্নত দেশসমূহের তীব্র বাঁধা চাপিয়ে এ রেজুলেশন পাশ করে তিনি সারা বিশ্বে দারিদ্র বিমোচন প্রক্রিয়ায় তাদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ২০১১ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে উক্ত দুটো রেজুলেশনের রজতজয়ন্তী (পঁচিশ বছর পূর্তি) উদযাপন করা হয়। সেসময় জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (ঊঈঙঝঙঈ) সহ-সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশ সেই আয়োজনে নেতৃত্ব দেয়। সৌভাগ্যবশতঃ বর্তমান মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. মোমেন নিউইয়র্কস্হ স্থায়ী মিশনের রাষ্ট্রদূত ও আমি মিশনের ইকনমিক মিনিস্টার হিসেবে আয়োজনের সার্বিক সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করি। জেনেভায় অবস্থিত জাতিসংঘ অফিসে মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার সহায়তায় রজতজয়ন্তী উদযাপন কর্মসূচি সুসম্পন্ন হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী কর্তৃক ১৯৮৬ সনের সেপ্টেম্বর মাসে সাধারণ পরিষদের ৪১ তম অধিবেশনের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার দিন বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে এক গৌরবময় দিন। দায়িত্বভার গ্রহণের মুহুর্তে এবং অভিষিক্ত হবার পর প্রদত্ত তাঁর প্রথম ভাষণটি বাংলাদেশ টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করে। দেশের মানুষ মুগ্ধ নয়নে চেয়ে দেখেছিল কিভাবে তাদের এক কৃতি সন্তান বিশ্ব সভায় সভাপতিত্ব করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জল করছেন। দেশকে মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি হিসেবে উদ্বোধনী বক্তৃতায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তাঁর পৈতৃক নিবাস সুনামগঞ্জ জেলার দরগাপাশা, নিজের জন্মস্থান সিলেট ও সর্বোপরি তাঁর প্রিয় জন্মভূমি স্বাধীন বাংলাদেশের নাম সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন। সত্যি সেটি ছিল এক অভাবনীয় ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতিত্ব করার সুবাদে তিনি জাতিসংঘ সদর দপ্তরে একটি স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। সাধারণ পরিষদের অধিবেশন কক্ষের বাইরে অন্যান্য সকল সভাপতিদের (টঘএঅ চৎবংরফবহঃং) ছবির সাথে তাঁর ছবিও শোভা পাচ্ছে। যতদিন জাতিসংঘ থাকবে ততদিন এই ছবি সেখানে থাকবে।
সাধারণ পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালানকালে তাঁর অন্যতম সাফল্য ছিল জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে (টঘ চবধপবশববঢ়রহম ঋড়ৎপবং) বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্তি। তিনি এ ব্যাপারে তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব জেভিয়ার পেরেজ দ্য কুইয়ারের বিশেষ সহায়তা পেতে সক্ষম হন। আজ বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে সবচেয়ে বেশী সৈন্য প্রেরণকারী দেশের অন্যতম। এ বাবদ বাংলাদেশ প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে। অধিকন্ত পরবর্তীতে শান্তিরক্ষা বাহিনীতে পুলিশ বাহিনীর অংশ গ্রহণও নিশ্চিত হয়েছে।
১৯৮৮ সনে ডিসেম্বর মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করে রাষ্ট্রীয় কূটনীতি থেকে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিতে চাইলেও তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কুটনৈতিক জগত তাঁকে বিদায় নিতে দেয়নি। ১৯৯৬ সনে স্পীকার হিসেবে নির্বাচিত হবার পর শুরু হয়ে যায় কূটনীতির আরেকটি নব অধ্যায়। বিশ্বের সমমনা পার্লামেন্টারিয়ানদের নিয়ে তিনি প্রবেশ করেন আরেক নতুন জগতে, প্রবর্তন করেন-সংসদীয় কূটনীতির ধারণা (ঈড়হপবঢ়ঃ ড়ভ চধৎষরধসবহঃধৎু উবসড়পৎধপু)। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা গ্রহণ করেন সাহসী উদ্যোগ। ২০০০ সালে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে অনুষ্ঠিত আইপিইউ (ওহঃবৎ চধৎষরধসবহঃধৎু টহরড়হ) সম্মেলনের প্রাক্কালে ইরাকের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা (ংধহপঃরড়হং) আরোপের খবরে তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন। তাঁর প্রতিনিধিদলের জ্যেষ্ঠ সদস্য ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা জনাব সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মাননীয় চীফ হুইপ জনাব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর যৌথ নেতৃত্বে একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদলকে ইরাকের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে মহিলা, শিশু, বয়োবৃদ্ধ ও অসুস্থ জনগোষ্ঠীর উপর নিষেধাজ্ঞার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে সেই প্রতিবেদনের আলোকে তিনি আইপিইউ সম্মেলনে নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তাঁর বলিষ্ঠ বক্তব্য তুলে ধরেন যা বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়।
একইভাবে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশনের তথা সিপিএ (ঈড়সসড়হবিধষঃয চধৎষরধসবহঃধৎু অংংড়পরধঃরড়হ) এর নির্বাহি কমিটির নির্বাচিত সদস্য হিসেবে তিনি এর বিভিন্ন অধিবেশনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। সেসময়ে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ কর্তৃক নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে অবৈধভাবে উৎখাত করার বিরুদ্ধে কঠোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
রাজধানী ঢাকাতেও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত এবং সফররত বিদেশি প্রতিনিধি দলের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মূল্যবান মতামত ও বিশ্লেষণ জানতে সংসদ ভবনে আসতেন। স্যারের নেতৃত্বে বন্ধুপ্রতিম অন্যান্য পার্লামেন্টের সাথে স্পিকার ও অন্যান্য পর্যায়ে নিয়মিতভাবে প্রতিনিধিদল বিনিময় একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছিল। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান ও সুদৃঢ় করার জন্য তিনি সংসদ সদস্যদের প্রশিক্ষণের উপর জোর দিয়েছিলেন এবং গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পার্লামেন্টারি স্টাডিজ ( ইওচঝ)। এসব উদ্যোগ নিয়ে এখানে নয়, ভিন্ন পরিসরে আলোচনা করার আশা করছি।
স্যারের জন্মজয়ন্তীতে আবারও বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব ও সভাপতি,স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্মৃতি পরিষদ।