বিজিবি দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী
জাতি বিডিআর বিদ্রোহের পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ ডিসেম্বর ২০২২, ৬:৩৮:৫৯ অপরাহ্ন
ডাক ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহে হত্যাযজ্ঞকে দুর্ভাগ্যজনক মন্তব্য করে বলেছেন, জাতি এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে বিজিবি সদর দফতরে বীর-উত্তম আনোয়ার হোসেন প্যারেড গ্রাউন্ডে বিজিবি দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষে একথা বলেন তিনি।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কর্মীদের শৃঙ্খলা ও চেইন অব কমান্ড মেনে চলার নির্দেশ দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের সরকার গঠনের মাত্র ৫২ দিনের মাথায় ২০০৯ সালে একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে (তৎকালীন বিডিআর)। জাতি এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না।’ প্রধানমন্ত্রী ওই ঘটনায় শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
তিনি বলেন, ‘একটা কথা মাথায় রাখবেন, কখনো শৃঙ্খলার ব্যাঘাত ঘটাবেন না। অর্পিত দায়িত্ব মেনে চলবেন, চেইন অব কমান্ড মেনে চলবেন।’
শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি কর্তব্যনিষ্ঠ হওয়ার জন্য তিনি বিজিবি সদস্যদের উদ্দেশে ১৯৭৪ সালের ৫ ডিসেম্বর তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস-এর সদস্যদের উদ্দেশে দেয়া জাতির পিতার ভাষণের চুম্বকাংশ উদ্ধৃত করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘ঈমানের সঙ্গে কাজ কর; সৎপথে থেকো, দেশকে ভালোবাসো।’
তিনি বলেন, ‘এই দেশ আমাদের, দেশ যত উন্নত হবে আপনাদের পরিবারও ভালো থাকবে, সুস্থ থাকবে। উন্নত জীবন পাবে, শিক্ষা-দীক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানসহ সব ধরনের সুযোগ পাবে। সে কথা সবসময় মনে রাখতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বর্ডার গার্ড আইন ২০১০ পাসের পর এই বাহিনীকে আমরা আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গঠন করেছি। আমার বিশ্বাস আধুনিক সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে তার লক্ষ্য অর্জনে।’
একটি পেশাগত ও সুশৃঙ্খল বাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, যেকোনো পেশাদার বাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি সুশৃঙ্খল ও দক্ষ বাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। বিজিবি সদস্যদের উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য সাতকানিয়ার ‘বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড কলেজ’ এবং এর পাশাপাশি চুয়াডাঙ্গায় আরও একটি প্রশিক্ষণ সেন্টার স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বিজয়ের এই মাসে মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর বিজিবি (তৎকালীন ইপিআর) সৈনিকদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ইপিআর-এর বেতার কর্মীরা ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা সমগ্র দেশে প্রচার করেছিল। স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করায় ইপিআরের সুবেদার মেজর শওকত আলীকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। বিজিবি শহীদদের মধ্যে ২ জন বীরশ্রেষ্ঠ, ৮ জন বীরউত্তম, ৩২ জন বীরবিক্রম এবং ৭৭ জন বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত হন। এছাড়া এ বাহিনীর ৮১৭ জন সদস্য মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।
বিজিবি সদস্যদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের ওপর দেশের সীমান্ত রক্ষার মহান দায়িত্ব অর্পিত। সীমান্ত সুরক্ষার পাশাপাশি চোরাচালান রোধ, মাদক ও নারী-শিশু পাচার রোধ, আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনসহ সীমান্তবর্তী জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করা আপনাদের দায়িত্ব।’ এসব দায়িত্ব অত্যন্ত আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করে যাওয়ায় তিনি বিজিবি সদস্যদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। জাতির পিতা তার মাত্র ৪৪ মাসের শাসনামলেই ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে আমাদের সংবিধান সংশোধন করে সীমান্ত নির্দিষ্ট করে গেলেও ’৭৫-পরবর্তী সরকারগুলো তা বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় ছিটমহল বিনিময় হয়নি বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ’৯৬ সালে সরকার গঠনের পর আমরা এই উদ্যোগ নিই এবং দ্বিতীয়বার যখন সরকারে আসি তখন ভারতীয় পার্লামেন্টে সর্বসম্মতিক্রমে আইন পাসের মাধ্যমে এই সীমান্ত সুনির্দিষ্ট করা হয়। অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে আমরা ছিটমহল বিনিময় করে সারা বিশ্বে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপনে সক্ষম হই, যা অন্য কোনো দেশ কখনো পারেনি।’
বর্তমান সরকার সৈনিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের কল্যাণমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নতুন র্যাংক ব্যাজ প্রবর্তন, যোগ্যতার ভিত্তিতে বিভাগীয় অফিসার পদে পদোন্নতি, সীমান্ত ভাতা প্রদান এবং জুনিয়র কর্মকর্তা ও হাবিলদার পদবির সদস্যদের বেতন স্কেল উচ্চ ধাপে উন্নীত করা হয়েছে। এছাড়া ২ মাসের বার্ষিক ছুটি ও অগ্রিম বেতন, পারিবারিক রেশন, ৩ বছরের নিচে সন্তানদের পূর্ণ স্কেল রেশন প্রদানসহ বিজিবি সদস্যদের প্রতিবন্ধী সন্তানদের অবসরের পূর্ব পর্যন্ত নগদ মূল্যে রেশন দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটনির্ভর ভি-স্যাট প্রযুক্তির মাধ্যমে টেলিফোন সুবিধা সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে জনবিচ্ছিন্ন বিওপিতে আইপি ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে।
তিনি বলেন, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ২২টি ব্যাচে সৈনিক পদে মোট ৩৪ হাজার ৩৬১ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ সময় ৩ হাজার ৩৪৪ জনকে বিভিন্ন অসামরিক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিজিবিতে ৯২২ জন নারী সৈনিক ভর্তি করা হয়েছে।
এদিন প্রধানমন্ত্রী বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ, বিশেষ করে নারী সৈনিকদের কুচকাওয়াজে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। এর আগে সকালে তিনি বিজিবি সদর দফতরে পৌঁছালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান এবং বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান। প্রধানমন্ত্রী বিজিবি মহাপরিচালকের সঙ্গে প্যারেড কমান্ডারকে নিয়ে একটি খোলা জিপে করে প্যারেড পরিদর্শন করেন। পরে তিনি আধা সামরিক বাহিনীর জাতীয় পতাকাবাহী দলের সঙ্গে চারটি কন্টিনজেন্টের বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ প্রত্যক্ষ করেন এবং স্বাগত মঞ্চ থেকে রাষ্ট্রীয় অভিবাদন গ্রহণ করেন।প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত বিজিবি সদস্যদের মধ্যে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিজিবি পদক, রাষ্ট্রপতি বিজিবি পদক, বিজিবি পদক-সেবা এবং ২০২২ সালের রাষ্ট্রপতি বিজিবি পদক-সেবা বিতরণ করেন।
পরে তিনি বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেন। তিনি ‘বিজিবি দিবস-২০২২’-এর বিশেষ দরবার অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেন।