মুক্তিযুদ্ধের প্রথম মুক্তাঞ্চল স্বীকৃতির অপেক্ষায়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২২ ডিসেম্বর ২০২২, ৮:১৭:৩৩ অপরাহ্ন
রফিকুর রহমান লজু
একাত্তর সালে এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার জন্য ত্রিশ লক্ষাধিক বাঙালিকে আত্মাহুতি দিতে হয়। ছাত্রদের নেতৃত্বে স্বাধীনতার পক্ষে প্রথম মিছিল বের হয় প্রথম মুক্তাঞ্চল জকিগঞ্জে। প্রবীণ জকিগঞ্জবাসীর স্মৃতিতে ২১ নভেম্বর উজ্জ্বল হয়ে আছে। হানাদারদের কবল থেকে ওইদিন জকিগঞ্জ মুক্ত হয়। পাকিস্তানি পতাকা জ্বালিয়ে দেয়া হয়, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। দিনটি প্রতি বছর পালিত হয় প্রথম মুক্তাঞ্চল দিবস হিসেবে। স্থানীয়ভাবে একুশে নভেম্বর দিনটি পালিত হলেও প্রথম মুক্তাঞ্চল হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিনটির স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
প্রতি বছর জকিগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড ও জকিগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ অন্যান্য সংগঠন নানা কর্মসূচির মাধ্যমে ২১ নভেম্বর প্রথম মুক্তাঞ্চল দিবস পালন করে থাকে। ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর রাতে যৌথ বাহিনীর এক সাঁড়াশি অভিযানের ফলে ২১ নভেম্বর ভোরে মুক্ত হয় জকিগঞ্জ। মুক্তিযুদ্ধে জকিগঞ্জ ছিল ৪নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। অধিনায়ক ছিলেন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত। প্রয়াত সাবেক মন্ত্রী এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী ছিলেন এই সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা। ৬টি সাব সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মাহবুবুর রব সাদী, লে. জহির উদ্দিন ও ক্যাপ্টেন এম.এ. রব।
একাত্তর সালের ২৭ মার্চ জকিগঞ্জ ডাক বাংলায় এক গোপন বৈঠকে থানার সকল ইপিআর ক্যাম্পের পাক সেনাদের নির্মূল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরদিন ২৮ মার্চ বীর মুক্তিযোদ্ধা মেকাই মিয়া, চুনু মিয়া, আসাইদ আলী, ওয়াতির মিয়া, তজমিল আলী, মশুর আলী, হাবিলদার খুরশিদ, করণিক আবদুল ওয়াহাব, সিগনালম্যান আবদুল মোতালেব প্রমুখ প্রথমে জকিগঞ্জ ও মানিকপুর ইপিআর ক্যাম্পে অপারেশন চালিয়ে পাক হানাদার সেনাদের খতম করে জকিগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন।
সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জকে মুক্ত করার পরিকল্পনা অনুসারে ২০ নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনী তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে প্রথম দল লোহার মহলের দিকে ও দ্বিতীয় দল আমলশীদের দিকে অগ্রসর হয়। মুক্তিবাহিনী তিনদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলেছে ভেবে তারা আটগ্রাম-জকিগঞ্জ সড়ক দিয়ে পালাতে শুরু করে। ইতোমধ্যে মুক্তিবাহিনীর প্রথম ও দ্বিতীয় দল জকিগঞ্জে পৌঁছে যায়। মূলদল কুশিয়ারা নদীতে রাবারের বালিশ দিয়ে সেতু তৈরি করে পাড়ি দিয়ে জকিগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। তখন পাকসেনাদের গুলিতে নিহত হন ভারতীয় বাহিনীর মেজর চমন লাল ও তাঁর দুই সহযোগী।
এ অবস্থায় কয়েকজন শত্রুসেনাকে আটক করা হয়। এভাবেই সেদিন মুক্ত হয় জকিগঞ্জ। একুশে নভেম্বর ভোরে জকিগঞ্জের মাটিতে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সূচনা হয় এভাবেই।
প্রথম বিজয়ের মুক্তাঞ্চলের গৌরব বহন করছে সিলেটের সীমান্ত উপজেলা জকিগঞ্জ। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে এই গৌরবের স্বীকৃতি পাননি জকিগঞ্জবাসী কয়েক যুগ পরেও। প্রবীণ জকিগঞ্জবাসী অনেকেই বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। এই প্রত্যাশিত স্বীকৃতি না দেখেই তারা বিদায় নিয়েছেন। এই স্বীকৃতির অপেক্ষায় আছেন এখন জকিগঞ্জবাসী। আর নতুন প্রজন্মের জকিগঞ্জবাসী চায় এই স্বীকৃতির মাধ্যমে তারাও মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার হতে।
জকিগঞ্জ প্রথম মুক্তাঞ্চল- এটা ইতিহাস। এই ইতিহাসের অংশীদার জকিগঞ্জের সঙ্গে সিলেট এবং সারা বাংলাদেশ। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পেলেও জকিগঞ্জ ইতিহাস হয়ে আছে সেখানকার জনগণের স্মৃতিতে, তাদের হৃদয়ে। বর্তমানে বাংলাদেশে তিনজন সিলেটী প্রভাবশালী মন্ত্রী ক্ষমতায় রয়েছেন। সে সঙ্গে আওয়ামী লীগ সংগঠনের একজন সাংগঠনিক সম্পাদকও দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে রয়েছেন। তাঁরা হলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ. মান্নান, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্যতম কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নাদেল আহমদ চৌধুরী। এ অবস্থায় জকিগঞ্জবাসী ও সিলেটবাসী আশা করেন তাঁরা উদ্যোগী ও সচেষ্ট হলে সিলেটবাসীর আশা ও মনের খেদ দূর হবে। বিজয়ের মাস চলতি ডিসেম্বরে বিষয়টি বাস্তবায়িত হলে সিলেটবাসীর আনন্দ উৎসবে সমগ্র দেশবাসী শরিক হয়ে আনন্দ করবে, খুশি হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী সিলেটীরাও এই আনন্দে শরিক হওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন।
লেখক : কলামিস্ট।