অভিবাসীদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২২ ডিসেম্বর ২০২২, ৮:২০:১৯ অপরাহ্ন
রায়হান আহমেদ তাপাদার
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে যাওয়া অভিবাসন প্রত্যাশীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ বছর এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২৫ হাজার অভিবাসন প্রত্যাশী ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন। ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।অভিবাসন সংকট থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। লিবিয়া অথবা তিউনিসিয়া থেকে সমুদ্রপথে ইউরোপে পাড়ি জমানো অভিবাসিদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিকের উপস্থিতি দেখা যায়। ভূমধ্যসাগরে বিভিন্ন দেশের কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর অভিযানে অথবা প্রাকৃতিক দুযোর্গ কবলিত নৌযানে আটকে পড়া অভিবাসিদের মধ্যে বাংলাদেশিদের নাম উঠে আসতে দেখা যায়। অবৈধ অভিবাসন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী পশ্চিমা বিশ্বকেই এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা এবং তা সমাধানে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী মানব অভিবাসন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভৌগোলিক অঞ্চলভেদে স্থায়ীভাবে বা অস্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের অভিপ্রায়ে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল করে। বাংলাদেশি অভিবাসীশ্রমিকেরা দেশ থেকে শুরু করে নানান পর্যায়ে, নানান ধরনের শোষণ, বঞ্চনা, প্রতারণা, লাঞ্ছনা ও হয়রানির শিকার হন। মূলত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া বাংলাদেশি অভিবাসন প্রত্যাশীদের অনেককেই জীবন বা সম্পদ বাজি রেখে বিদেশে পাড়ি জমাতে হয়। অভিবাসন, অভিবাসী ও তাঁদের পরিবার-পরিজনকে নিয়ে হৃদয়ছোঁয়া অনেক প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়। কিন্ত অভিবাসন ও অভিবাসীদের সেবার ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করার কোনো দৃশ্যমান প্রবণতা নেই। অথচ পৃথিবীতে বর্তমানে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অভিবাসন সংকট। অভিবাসন প্রক্রিয়া বাড়ছে। বিশ্ব অর্থনীতির একটি বিরাট অংশ নির্ভর করে অভিবাসীদের শ্রমের উপর।
এই বাস্তবতায় অভিবাসীদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করা সংশ্লিষ্ট সকলেরই দায়িত্ব। বাংলাদেশে দরিদ্রসীমার নিচে যে সমস্ত পরিবার রয়েছে তাদের যদি রেমিটেন্স প্রাপক পরিবারে রূপান্তর করা যায় তাহলে সেসব পরিবার দরিদ্র থাকবে না। দেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে সহজ হবে। এটা সম্ভব হবে তখনই যখন অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকবে। বাংলা দেশর অর্থনীতিতে অভিবাসীদের প্রেরিত অর্থ একটি বিরাট ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের দারিদ্র বিমোচনে অভিবাসীদের ভূমিকাকে আরও গতিশীল এবং শক্তিশালী করা দরকার। পৃথিবীর একশত আটষট্টিটি দেশে বাংলাদেশের মানুষ কর্মরত আছেন। এ সমস্ত দেশে প্রায় এক কোটি ছাব্বিশ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক রয়েছেন নিঃসন্দেহে এটি আনন্দের খবর, কিন্তু বেদনাও রয়েছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে বিদেশ যাওয়া শ্রমিকদের বাষষ্টি শতাংশ অদক্ষ, ছত্রিশ শতাংশ আধা দক্ষ এবং মাত্র দুই শতাংশ দক্ষ। বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের বড় অংশই মালয়েশিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। এসব দেশেও আধুনিক প্রযুক্তি চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অদক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বিদেশে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিক পাঠানোর কোনো বিকল্প নেই। বিদেশ যাওয়া শ্রমিকদের সত্যিকারভাবে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আধুনিক ও উন্নত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এজন্য সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী। প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এ বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। এ জন্য অভিবাসীদের সুযোগ-সুবিধাগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।অনেক ব্যক্তি বিদেশে কাজ করার তীব্র ইচ্ছা পোষণ করেন। যেকোনো সমস্যাকে তারা মেনে নিতে রাজি থাকেন। কিন্তু বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যা হয়। এসব সমস্যা ও সমাধানের উপায় বের করে সমাধান করা অতিব জরুরী।
আমাদের মনে রাখতেই হবে, অনেক শ্রমিক দেশ থেকে ধার করা অর্থে বিদেশে যান। অনেক সময় প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি টাকা দিতে হয়। চাকরি করার সময় কঠোর পরিশ্রম করেন এবং দেশেও টাকা পাঠান। বিদেশ থেকে আয় আসার ফলে গ্রামীণসমাজে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে।অভিবাসীদের যথাযথ গুরুত্ব না দিলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হবে। এটি কাম্য নয়। এছাড়া নারী অভিবাসন একটি জাতীয় বিষয়। নারীদের বিদেশ গমনের সময় মাঠপর্যায় থেকে দেশে ফেরত আসা পর্যন্ত যাবতীয় তথ্য প্রকাশ করা হয়। অভিবাসন নিয়ে বিভিন্ন দাবির কথাও বলা হচ্ছে। যেমন, একজন নারী বিদেশ যাওয়ার সময় দালালের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হন। পরিবার ও সমাজে আত্মমর্যাদা কমে যাওয়ার একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে। বদলাতে হবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। অথচ নারী অভিবাসীদের শতভাগ রেমিট্যান্স দেশে পাঠানো হয়। এটা গোটা দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একজন নারী প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হয়ে শেষ পর্যন্ত কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে গমনের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু পাসপোর্ট থেকে শুরু করে বিমানের টিকিট কেনা পর্যন্ত প্রতিটি জায়গায় একেক ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এ জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি থেকে শুরু করে দেশে ফিরে আসা পর্যন্ত সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। নারীর অভিবাসনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলে নিরাপদ অভিবাসনের অপরাধগুলো দূর হবে। কর্মজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৃথিবীব্যাপি জাতিসংঘের কর্মসূচীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অভিবাসন ইস্যু। মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে অবস্থান করলেও সে একই পৃথিবীর মানুষ। মানুষ হিসেবে তার অধিকার ধর্ম বর্ণ বা জাতীয়তার কারণে বৈষম্যের শিকার হতে পারে না। জাতিসংঘের আহ্বান হলো অভিবাসী শ্রমিক ও তার পরিবারের সদস্যদেরও অধিকার রয়েছে।
দেশের টেকসই উন্নয়নে প্রবাসী আয় বাড়ানো খুবই জরুরী। টেকসই প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্রতা কমাতে হলে নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করা একান্ত জরুরী। বিদেশে শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে শ্রমিকরা যাতে হয়রানীর শিকার না হয় সেজন্য সরকারের তদারকি ব্যবস্থাও জোরদার করা আবশ্যক। অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশ যেতে নৌকা ডুবির ঘটনায় অনেক বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে পাওয়া গিয়েছিল অসংখ্য গণকবর। বিভিন্ন দেশে আধুনিক প্রযুক্তি চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অদক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বিদেশে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিক পাঠানোর কোনো বিকল্প নেই। বিদেশ যাওয়া শ্রমিকদের সত্যিকার ভাবে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আধুনিক ও উন্নত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এজন্য সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচকগুলোতে বাংলাদেশের ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারন হলো প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স। কোভিড-১৯ মহামারিতে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাকালে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। এর মূলে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স। বাংলাদেশের অনেক অদক্ষ কর্মী মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে মানবেতর জীবন যাপন করেন। এসব অদক্ষ কর্মী অনেক সময় খালি হাতে দেশে ফেরত আসেন। দেশের ফেরত আসা এ সমস্ত কর্মীদের পূনর্বাসনের ব্যবস্থা থাকা দরকার বলে মনে করি। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিটেন্স এবং রেমিটেন্স হলো দেশের অর্থনীতির প্রানশক্তি। অর্থনৈতিক উন্নয়নে রেমিটেন্সের অবস্থান মোট জিডিপির ১২ শতাংশ এবং বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। প্রবাসীদের কারণে এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ একটি সম্মানজনক অবস্থানে রয়েছে। এ কারণেই ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট কাটাতে পেরেছে। প্রবাসীদের বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। দেশে বিনিয়োগের জন্য এবং বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর জন্য প্রবাসীদের আকৃষ্ট করতে হবে।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট।