একটি চিঠি, একটি ইতিহাস
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ ডিসেম্বর ২০২২, ৮:০৬:২২ অপরাহ্ন

ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
আজকাল বলতে গেলে চিঠি লিখার প্রচলন প্রায় উঠেই গেছে। অফিসিয়েল চিঠি ছাড়া ব্যক্তিগত পত্রালাপ যাদুঘরের বিষয় মাত্র। প্রেমপত্রও আজ বিলুপ্তপ্রায়। মোবাইল-ফেসবুক ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ তাদের চাহিদা মিটিয়ে ফেলে। তবে এ নিয়ে যে যা-ই বলুন না কেন, এটা ‘দুধের স্বাদ ঘোলে’ মেটানোর মতোই। তাইতো দেখি চিঠি নিয়ে অনেক বিজ্ঞজন অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। কে যেন একজন বলেছেন- ‘মানুষের চিঠিতে তার খোলা মনের পরিচয় পাওয়া যায়।’ সাইরাস নামের একজন বলেন, ‘যে চিঠি লিখতে পারে না, সে শিক্ষিত হয়েও মূর্খ’। শানা আলেকজান্ডার নামক একজন বলেছেন, ‘চিঠি হচ্ছে খামে ভরা প্রত্যাশা’। একথাগুলো অবশ্য মোবাইল নামক যন্ত্রটি আবিষ্কারের আগেকার। কিন্তু এর আবেদন ফুরিয়ে গেছে বলে মনে হয় না। কোন মা-বাবা যখন তাদের সন্তানের হাতের লিখা খামে ভরা চিঠি পান বা সন্তান উল্টোটা পান বা কোন প্রেমিক-প্রেমিকা যখন একে অপরের হাতের চিঠি পান তখন তাদের মনে প্রাণে যে আবেগ অনুভূতির সৃষ্টি হয় এর মূল্য কোন কিছু দিয়েই পরিমাপ করা যায় না। এটা একান্ত হৃদয়ের ব্যাপার। হৃদয়ের কথা। এর সাথে কোন কিছুরই পরিমাপ করা যায় না।
চিঠি নিয়ে একসময় সাহিত্য সৃষ্টি হয়ে যেতো। পত্র সাহিত্যের কথা আমরা কে না জানি? এছাড়া রাজনীতির আকাশেও অনেক ব্যক্তিগত চিঠির দেখা মেলে।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তাঁর ১০ বছরের ছোট্ট মেয়ে ইন্দিরাকে বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেন বিভিন্ন বিষয় বর্ণনা করে। ১৯২৮ সালে হিমালয়ের কোলে মুসৌরী শহরে ছিলেন ইন্দিরা। নেহেরু ছিলেন সমতলে অন্য শহরে। বহু দূরে। সেসময় মোবাইল ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার ইত্যাদি ছিলো না। চিঠিই ভরসা। ‘প্রকৃতির ভাষা’, ‘পৃথিবীর ঊষলগ্নের কথা’, ‘পৃথিবীর সৃষ্টি’, ‘প্রাণের প্রথম স্পন্দন’, ‘জন্তুর আবির্ভাব’, ‘মানুষের স্পন্দন’, ‘বিভিন্ন জাতির উৎপত্তি’, ‘সভ্যতা কি’, ‘চীন ও ভারতবর্ষ’, ‘আর্যরা কেন ভারতবর্ষ পছন্দ করলো’, ‘কি করে গোষ্ঠীপতি হলো’, ‘রাজা, মন্দির ও পুরোহিত’ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পিতা নেহেরু তার মেয়ে (১০ বছরের) ইন্দিরাকে বহু চিঠি লিখেছিলেন। দশ বছরের মেয়ে সেই চিঠিগুলো পড়ে অনেক কিছু শিখেছিলেন। সেই নিছক ব্যক্তিগত চিঠিগুলো নিয়ে ‘মা-মণিকে বাবা জওহরলাল নেহেরু’ শিরোনামে ইংরেজি ভাষায় পুস্তক আকারে একটি বই বের করা হয়। চিঠিগুলো লিখা হয়েছিল ইংরেজিতে। পাঠক সমাজের সুবিধার্থে মজিবর রহমান খোকা বাংলা ভাষায় সম্পাদনা করেন। সেই পুস্তক থেকে এমন তথ্য পাওয়া যায়। আমার কেন জানি মনে হয় জওহরলাল নেহেরুর ইন্দিরাকে লেখা বিভিন্ন তথ্য নির্ভর চিঠি পাঠ করে ছোটমণি ইন্দিরা জ্ঞান অর্জন করা শুরু করেন এবং একসময় বিশ্বে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, ভারত এবং বিশ্বরাজনীতির ক্ষেত্রে দূরদর্শী চিন্তা চেতনার অধিকারী হয়েছিলেন। তারই প্রমাণ হিসেবে দেখা যায় ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের একটি বহুল তাৎপর্যময় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এ প্রসঙ্গে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আরো বলেন, ‘অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করে ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং আমরা তড়িঘড়ি করে বা আবেগপ্রবণ হয়ে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিনি। স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহ এবং গণমানুষের সর্বাত্মক প্রতিরোধ সংগ্রাম দেখে আমাদের বিলক্ষণ মনে হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষকে আর কখনোই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না পাকিস্তান।’ এখানে আরো উল্লেখ্য যে, ছোট্টমণি ইন্দিরাকে উদ্দেশ্য করে যে চিঠিগুলো তাঁর বাবা জওহরলাল নেহেরু লিখেছিলেন পুস্তক আকারে প্রকাশিত সেই বইটি তাঁর বাবা ইন্দিরাকে উৎসর্গ করেছিলেন।
এতোক্ষণ আমরা ১৯২৮ সালের কিছু চিঠি নিয়ে অনেক কথাই বললাম। এবার ১১.১২.২০২২ সালের দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকার মাধ্যমে আর একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ চিঠির খোঁজ পেলাম। এ নিয়ে পত্রিকাটির শিরোনাম হলো-
‘প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সুইডিশ বিচারপতি বাংলাদেশে সমাহিত হতে চান।’ খবরটি হলো সৈয়দ আসিফ শাহকার একজন পাকিস্তানি নাগরিক ছিলেন। নিজ কর্মের ফলে তিনি আজ সুইডেনের বিচারপতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের বছর ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল ২২ বছর। পাঞ্জাব স্টুডেন্ট ইউনিয়নের- দায়িত্ব সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২৫শে মার্চের কালোরাতে পূর্বপাকিস্তানের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামের নির্মম ও নৃশংস জেনোসাইডের প্রতিবাদে পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিকদের একটি অংশ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সেই শুভবুদ্ধি সম্পন্ন পাকিস্তানি নাগরিকদের একজন ছিলেন সে সময় ২২ বছর বয়সী তরুণ সৈয়দ আসিফ শাহকার। এই সাহসী তরুণ পাকিস্তানি বর্বর নিষ্ঠুর মানবিকতা বিবর্জিত ‘পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সমাবেশ, কবিতা লেখা ও লিফলেট বিতরণ করেন। এ কারণে নিজ পরিবার, সমাজ ও মানুষের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে ওঠেন। শুধু তাই নয়, তাকে ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
মানবপ্রেমে ঋদ্ধ এই প্রতিবাদী সাহসী বিবেকবান মানুষটি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি হৃদয়গ্রাহী চিঠি লিখেন। এ চিঠি যে শুধু প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছেন তাতো নয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী সকল মানুষের উদ্দেশ্যে লিখা এ চিঠি। আমরা ক’জন জানতাম যে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে বাংলাদেশের এমন অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন? ক’জন রাখতাম সে খবর। অবশ্য সে সুযোগও ছিলো না। পাকিস্তানি প্রচারযন্ত্র এদের খবর প্রচার করতো না।
অমানুষের দল বিশ্ববাসী তথা বাংলাদেশের মানুষকে জানতে দিত না পাকিস্তানেও কিছু মানুষ ছিলেন। আসিফ শাহকার তেমনি এক মহান মানুষ। আজ গভীর শ্রদ্ধা আর শ্রদ্ধা ঋদ্ধ চিত্তে সৈয়দ আসিফ শাহকারের উদ্দেশ্যে অন্তরের অন্তস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। একটা ছোট্ট চিঠি যে মানুষের মনোজগৎ বদলে দিতে পারে এ চিঠিই এর প্রমাণ। মানুষের জীবনে চিঠির অবদান আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। ভুলে গেছে বা ভুলে যাচ্ছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। অথচ এই চিঠির গুরুত্ব অপরিসীম।
সকলের বিশেষ করে আমাদের নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সুইডিশ বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকারের চিঠিটি তুলে ধরলাম। আর সেটি হলো-
‘আমার বয়স ৭২ বছর। আমি জানি না, আমি আর কতদিন বাঁচব। কিন্তু বাংলাদেশের একজন শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে আমি বাংলাদেশের মাটিতেই সমাধিস্থ হতে চাই। বাংলাদেশের নাগরিক না হলে যেহেতু সেখানে সমাধিস্থ হতে পারব না, তাই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চেয়ে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি চিঠি লিখেছি।’
এ চিঠি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তগত হয়েছে কিনা জানি না। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব হারানো অনেকেই আবারো নাগরিকত্ব ফিরে পেয়েছেন। আসিফ শাহকার নাগরিকত্ব পেলে ক্ষতি কী? তবে অবশ্যই সেটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিবেচ্য বিষয়। বাংলার বন্ধু, বাংলার মিত্র, পরম শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আসিফ শাহকারের প্রতি আবারো গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ করছি।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট, সাবেক ব্যাংকার