অস্তিত্ব হারাতে বসেছে মাছুদিঘী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ ডিসেম্বর ২০২২, ৫:৫৩:০৫ অপরাহ্ন
আহমাদ সেলিম
শুধু পানির প্রয়োজন নয়, আশপাশ এলাকার মানুষের জীবনের সাথে জড়ানো ছিলো একদিন মাছুদিঘী। কিন্তু বর্তমানে করুণ এক চিত্র সেই দিঘীজুড়ে। দিঘীর অর্ধেকটা ভরাট হয়ে গেছে। সেই ভরাট অংশে এখন খেলাধুলা হয়। আর বাকি অর্ধেক অংশে যার যেমন ইচ্ছে ময়লা আবর্জনা ফেলে বিনষ্ট করছেন। সিটি কর্পোরেশনও সিলেটের প্রাচীন এই দিঘীটি রক্ষার জন্য ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপও গ্রহণ করছে না।
সিলেট শহরের অধিকাংশ এলাকার নামকরণ হয়েছে ওইসব এলাকার দিঘীর নামে। তার মধ্যে চারাদিঘী, রামেরদিঘী, লালাদিঘী, সাগরদিঘী, মজুমদার দিঘী, ধোপাদিঘী অন্যতম। সেই দিঘীগুলোর মধ্যে শুধু লালাদিঘী ছাড়া বাকিগুলো ভরাট হয়ে গেছে। সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত তেমনি একটি দিঘী মাছুদিঘী। সেই দিঘীর জীবন প্রদীপও এখন নিভু নিভু। যে কোনো সময় পুরোদমে নিভে যেতে পারে। তবে দেরীতে হলেও এলাকাবাসী দিঘী রক্ষার জন্য নেমেছেন।
সরেজমিন এলাকায় গিয়ে জানা যায়, মাছুদিঘীরপাড়ে সেই পুরনো সময়ের বেশ কয়েকটি নারিকেল গাছ, একটি তাল গাছ এখনো আছে। নেই কেবল আগের চেহারায় দিঘীটি। কয়েক বছর আগে দিঘীর একটি অংশ ভরাট করা হয়েছে। সেই ভরাট অংশে শিশুরা খেলছে, ছুটিাছুটি করছে। বাকি অংশ অনেকটা মজায় পরিণত হয়েছে। অনেকে ময়লা আবর্জনাও ফেলছেন দিঘীতে। এই অবস্থায়ও বক থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি দিঘীতে ডানা মেলছে, খাবার খুঁজতে দেখা গেছে। তবে পুরো দিঘী পরিস্কার করে রাখা হলে জায়গাটি অতিথি পাখিদের জন্য অভয়াশ্রম হতে পারতো।
মাছুদিঘীরপাড়ে আড়াই থেকে তিনশতাধিক পরিবারের বসবাস। সেই এলাকায় প্রায় সাড়ে আট কিয়ার সীমানা নিয়ে মাছুদিঘী। কিন্তু এখন দিঘী পুরোটা চোখে ভাসেনা। ভরাট করে ফেলায় মরা মজায় পরিণত হয়েছে। অথচ একসময় মাছুদিঘীরপাড় ছাড়াও আশপাশ এলাকার মানুষের জীবনজুড়ে ছিলো এই দিঘী, দিঘীর পানিপ্রবাহ। এলাকার প্রবীণ মুরব্বি নাকু দে স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, মাছুদিঘীরপাড়ে দিঘীর অবস্থান হলেও সিলেট শহরের ভেতর অধিকাংশ পাড়ামহল্লার মানুষের নানা স্মৃতিজড়িয়ে আছে দিঘীর পানির সাথে। একসময় এই দিঘীতে সাতাঁর প্রতিযোগিতা হতো। বিভিন্ন এলাকার অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সাঁতার শিখিয়েছেন এই দিঘীতে। একটি, দুটি নয়, দিঘীতে ছিলো একাধিক ঘাট। ঘাটে বসে পুকুরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে অনেকে এ এলাকায় বেড়াতে আসতেন। শীতের সময় বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের অভয়াশ্রম ছিলো এই মাছুদিঘী। কিন্তু সেই দিঘী এখন তার অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। যেমনটি হারিয়েছে এলাকার আরেক পুরনো ‘মহালদিঘী’। যে দিঘীর কোনো অস্তিত্বই এখন খুজে পাওয়া যাবে না। অন্তত পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর আগে সেই দিঘী ভরাট করে গড়ে ওঠে দালানের পর দালান। এখন একটি মহলের দৃষ্টি পড়েছে মাছুদিঘীর দিকে। এলাকার বাসিন্দা জাফর খান, শাহাদত খান, সাঈদ খান, রিংকু দে সহ বেশ কয়েকজ তরুণ বলেন, ‘১৯৯৭ সালে দিঘীটির অর্ধেক অংশ ভরাট করা হয়। বাকি অংশ ভরাট করারও পাঁয়তারা চলছে। তবে সেটি আমরা হতে দেবো না। আমরা কয়েকদিন আগে সিলেটের সবগুলো পরিবেশবাদী সংগঠন নিয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছি। পর্যায়ক্রমে আমরা আরো কর্মসূচি হাতে নেবো।’
পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমিসন্তান এর প্রধান সমন্বয়ক আশরাফুল কবির জানান, ‘সিলেটজুড়ে পুকুর দিঘী ছিলো পাড়ায় পাড়ায়। এখন নাম আছে, কিন্তু সেই দিঘীগুলো নেই। গত বিশ বছরে শুধু সিলেট নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডে অন্তত চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি পুকুর-দিঘী ভরাট হয়েছে। যে কয়টি আছে সেগুলো রক্ষার দায়িত্ব সবার। তিনি বলেন, আমরা আর কোনো দিঘী হারাতে চাইনা। প্রয়োজনে কঠোর আন্দোলনে যাবো।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও দিঘী রক্ষার জন্য জনমত গড়ে তুলছে। কথা হলে এই সংগঠনের সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কীম জানান, ‘মাছুদিঘীর মালিকানা নিয়ে যদি আদালতে কোনো মামলা থাকে সেটি নিষ্পত্তি করবে আদালত। তবে মালিকানা থাকা সত্বেও কেউ দিঘী ভরাট করাতে পারবেন না। জলাধার রক্ষা আইনেও সেই বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘সিলেটে একসময় দিঘীর মতো অনেকগুলো হাওর এবং বিলের সমাহার ছিলো। তেলিহাওর, বিলপার, কাজলহাওর- সেই সত্যই বহন করে। কিন্তু বর্তমানে নগরীর ভেতর কোনো হাওর কিংবা বিলের অস্তিত্ব নেই। একদিন পুকুর দিঘীর ক্ষেত্রেও তেমনটি হবে, যদি সবাই এগিয়ে না আসি।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ শাহেদা জানান, ‘ব্যক্তিগত হোক অথবা সরকারি হোক রেকর্ডে দিঘী উল্লেখ থাকলে সেই দিঘী ভরাট করা যাবেনা, কেউ ভরাট করতে পারবেনা। তিনি বলেন, অতীতে যারাই মাছুদিঘী ভরাট করতে চেয়েছে আমরা বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছি। পরিবেশ অধিদপ্তরও চিঠি দিয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি এলাকাবাসী যখন আবার অভিযোগ করলেন কারা নাকি দিঘী ভরাট করতে প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। খবর পেয়ে আমরা সিটি কর্পোরেশনকে লিখিতভাবে অবগত করি। পরবর্তীতে ভরাট বন্ধ হয়। এখন যদি আবার কেউ প্রক্রিয়া শুরু করে তখনো আমরা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবো।’ যোগাযোগ করা হলে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন জানান, ‘চলমান যে জলাধার আইন রয়েছে সেই আইন পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত কেউ দিঘী ভরাট করতে পারবেন না।’