বন্যা পরবর্তী বেসরকারি সংস্থার সহায়তা
বদলে গেছে বাসমতিদের জীবনযাত্রা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ ডিসেম্বর ২০২২, ৬:৪৭:২০ অপরাহ্ন
সুনামগঞ্জ থেকে শাহজাহান চৌধুরী : সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হন বাসমতি রবি দাস। পিছিয়ে পড়া এক জনগোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের গৃহবধূ। তিনি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার পাণ্ডারগাঁও ইউনিয়নের ডাউকেরকারা গ্রামের মনা রবি দাসের স্ত্রী।
তার বাড়ির আসবাবপত্র, বিছানা, হাড়িপাতিল সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে বন্যা। বন্যার পানি বাড়ি-ঘর থেকে নেমে গেলেও বসতভিটায় ফিরে দেখেন বন্যার ভয়াবহতা। তার বাসযোগ্য কুঁড়েঘরটা জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় নুয়ে আছে। শুধু বাসমতিদের নয়; ওই গ্রামের তার মতো খেটে খাওয়া পরিবারের অনেকের বন্যার পানি সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। বাসমতির স্বামী মনা রবি দাস পেশায় চর্মকার। এক কথায় তারা দিনে আনে দিনে খায়। বাসমতির তিন ছেলে ও চার মেয়েসহ ৯ সদস্যের পরিবার।
বাসমতি জানান, গ্রামের অন্যান্য নিম্ন আয়ের মানুষেরা বসতভিটায় ফিরেই বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি দেখে হতাশ হয়ে পড়েন। তারা যখন চোখে সর্ষে ফুল দেখছিল তখন সরকারের পাশাপাশি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (এনআরসি) ও স্থানীয় পর্যায়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার এ্যাফরট ফর রুরাল এডভান্সমেন্ট (ইরা)।
তিনি জানান, এনআরসির উদ্যোগে ইরা তাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার জন্য প্রাথমিকভাবে সাড়ে ৪ হাজার টাকা নগদ একাউন্টের মাধ্যমে দেয়। পরে জীর্ণশীর্ণ ঘরটি মেরামতের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো দশ হাজার টাকা দেয় সংস্থা দুটি। এছাড়াও ইরার সহযোগিতায় ইসলামী চ্যারিটি নামের একটি সংস্থা তাকে ঘর মেরামতের জন্য কিছু ঢেউটিন ও বাঁশবেত দিয়ে সহযোগিতা করেছে।
বাসমতি অরো জানান, তার বড় মেয়ে এবার এসএসসি পাশ করেছে। বড় ছেলে ও দ্বিতীয় মেয়ে স্থানীয় একটি মাধ্যমিক স্কুলে নবম শ্রেণীতে আর তৃতীয় মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে। ছোট ছেলে-মেয়েগুলো পড়ছে গ্রামের পাঠশালায়। তিনি বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
জেলার ছাতক উপজেলার জাউয়াবাজার ইউনিয়নের মৃত কদরিছ আলীর স্ত্রী মালা বেগম জানান, বন্যায় তার কুঁড়ে ঘরটি ধ্বংস হয়ে আসবাবপত্র সবকিছু ভেসে গেছে বন্যার পানিতে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর তার বসত ভিটায় ফিরে দেখেন কিছুই নেই। শুধু কুঁড়ে ঘরটি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। মালা ১ ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি নিয়ে মহাবিপদে পড়েন। বসবাসের অনুপযোগী তার কুঁড়েঘর। এরপর তিনি শুনতে পান পিআইসি কমিটি মানবিক সহায়তায় তার নাম দিয়েছে। এনআরসি ও ইরার লোকজন তার কাছে গিয়ে তাকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তার নামের নগদ একাউন্ট খুলে দিয়ে প্রথমে তাকে দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর জন্য তার নগদ একাউন্টে সাড়ে ৪ হাজার টাকা দিয়েছে এনআরসি ও ইরা। পরে ঘর মেরামতের জন্য তার একাউন্টে আরো ১০ হাজার টাকা দেয় ওই সংস্থা দুটি। সহায়তার এই টাকাগুলো পেয়ে তিনি ঘর মেরামত করে এখন বসবাস করছেন। একই অবস্থা ছিল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পান্ডারগাঁও ইউনিয়নের হাবিবা বেগম, আল আমিন সোহাগের।
এসব উন্নয়ন সংস্থার আর্থিক সহায়তায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে সুনামগঞ্জের ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার চারটি ইউনিয়নের চার হাজার ৬৭৫টি পরিবার। এরমধ্যে সাড়ে ৪ হাজার টাকা করে নগদ অর্থ পেয়েছেন ৪ হাজার ৩৫টি পরিবার এবং ১০ হাজার টাকা করে পেয়েছে ৬৪০টি পরিবার।
সূত্র জানায়, গত জুন মাসে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলায় প্রায় ৫০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসন করতে সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে আসে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (এনআরসি)। এছাড়াও, দুটি উপজেলার ১৪০টি পরিবারে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নলকূপ মেরামত ও বিশুদ্ধকরণ এবং ১৫ গ্রামের সংযোগ সড়ক ও দুটি স্কুল মাঠ মাটি ভরাট করে খেলার উপযোগী করা হয়েছে।
নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (এনআরসি)’র ইমার্জেন্সি রেসপন্স কো-অর্ডিনেটর গোলাম মেহেদী জানান, ২০২২ সালের জুন মাসে সুনামগঞ্জে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে জাতীয় পর্যায়ে হিউম্যানিটেরিয়ান কো-অর্ডিনেশন টাস্ক টিম সরেজমিন পরিদর্শনের আলোকে সুনামগঞ্জে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম বাস্তবায়নে এনআরসি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরে কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্থানীয় পর্যায়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার এ্যাফরট ফর রুরাল এডভান্সমেন্ট (ইরা) সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ৬ মাস ব্যাপী জরুরী সহায়তা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়।
ইরার নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, বন্যার পানি বাড়ি-ঘর থেকে নেমে যাওয়ার পরপরই এনআরসির অর্থায়নের জরুরী মানবিক সহায়তা প্রকল্প গ্রহণের পর সুনামগঞ্জের ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার দুটি করে ইউনিয়ন বাছাই করা হয়। এ দুটি ইউনিয়নের প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার বাছাইয়ের জন্য প্রতিটি গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে একটি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইস) গঠন করা হয়।
ইরার প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. কামরুজ্জামান জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরীর প্রাথমিক পর্যায়ে বন্যা পরবর্তী তাৎক্ষণিক দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর জন্য ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার দুটি করে ইউনিয়নের ৪ হাজার ৩৫টি পরিবারকে ১ কোটি ৮১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা সহায়তা প্রদান করা হয়। এ থেকে প্রতিটি পরিবার পেয়েছে সাড়ে ৪ হাজার টাকা করে। এরপর ঘর মেরামতের জন্য ৬৪০টি পরিবারকে ৭৯ লাখ ৬৫০০ টাকা সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। পরিবার প্রতি পেয়েছে ১০ হাজার টাকা করে।
দোয়ারাবাজারের পাণ্ডারগাঁও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আব্দুল ওয়াহিদ জানান, ভয়াবহ বন্যায় আমার ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে মানবিক সহায়তা নিয়ে দাঁড়ানোর জন্য ইরা ও এনআরসির কাছে কৃতজ্ঞ।
একই উপজেলার দোহালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শামীমুল ইসলাম শামীম জানান, ইরা ও এনআরসির মানবিক সহায়তার কারণে আমরা জনপ্রতিনিধিরা আমাদের এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য কিছুটা উপকার করতে পেরেছি।