সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে মসজিদের ভূমিকা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ ডিসেম্বর ২০২২, ৭:৪৭:৩৮ অপরাহ্ন
মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
প্রতিটি সমাজ ব্যবস্থায়ই মানুষকে উজ্জীবিত করার জন্যে একটি সুনির্দিষ্ট কেন্দ্রস্থল বর্তমান থাকে, যেখানে সমাজের সদস্যরা মিলিত হয়ে পরস্পর ভাবের আদান-প্রদানের সুযোগ পায় এবং তাদের নৈতিক ও বৈষয়িক সমস্যাবলীর সমাধানের জন্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা লাভ করে। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় মানুষকে সঠিক পথে উজ্জীবিত করার এবং মানুষের সমস্যাবলী সমাধানের কেন্দ্রস্থল হচ্ছে মসজিদ। ইসলামী সমাজে মসজিদ শুধু সিজদার স্থান নয় বরং মুসলমানদের সকল কর্মকাণ্ডের, সকল তৎপরতারই কেন্দ্রস্থল রূপেই বিবেচ্য। নবী (সা.) ও খুলাফায়ে রাশিদীনের আমলে মসজিদে যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা হত, তেমনি সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডও সেখান থেকেই পরিচালনা করা হত। মসজিদে নববীতে বসেই নবী (সা.) জনগণের বৈষয়িক সমস্যাবলীর সমাধান করতেন, সালিশী ও বিচারকার্য আঞ্জাম দিতেন এবং যুদ্ধ ও সন্ধির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতেন। ইসলামী সোনালী যুগে এটাই ছিল সুশীল সমাজ গঠনে মসজিদের ভূমিকা।
বিশ্বে সর্বপ্রথম নির্মিত ঘর হল মসজিদ। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা তো বাক্কায় (মক্কার অপর নাম বাক্কা) অবস্থিত। ইহা সারা জাহানের মানুষের জন্য বরকতময় ও হেদায়তের দিশারী’ (সূরা আল-ইমরান: আয়াত-৯৬)। উক্ত আয়াত দ্বারা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণ হল- আল্লাহপাক মানুষের হেদায়তের কেন্দ্রস্থল হিসেবে সর্বপ্রথম যে ঘর তৈরি করেন তা ছিল মসজিদ। মসজিদে এলে মানুষ সৎ পথ পাবে, শান্তি পাবে, সুশীল সমাজ গঠনের দিকনির্দেশনা পাবে। মানুষের আত্মিক প্রশান্তির কেন্দ্রস্থল হচ্ছে মসজিদ। যাদের সম্পর্ক মসজিদের সাথে থাকে, তাদের সম্পর্ক কখনও পাপকর্মে ও পাপাচারীর সাথে থাকতে পারে না। যাদের অন্তর মসজিদের সাথে লেগে থাকে তারা কখনও পাপ কাজে লিপ্ত হতে পারে না। মসজিদে গমন করে মানুষ সুশীল সমাজ গঠনের পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে। মসজিদে মানুষ যাতায়াত করে বিশেষ করে নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যেই। আর এই নামাজই মানুষকে অন্যায়-অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে।
সরকার সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে অপরাধ দূর করার জন্য পুলিশ-সেনাবাহিনী নিয়োগ করে থাকেন। হাজার হাজার পুলিশ-সেনাবাহিনী সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েও সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে অপরাধ নির্মূল করতে পারেন না। এর মূল কারণ হল- স্বয়ং সরকারের বাহিনীতেই দুর্নীতি ঢুকে যায়, রক্ষকই ভক্ষক হয়ে যায়। যেখানে সরকারের বাহিনীতে ফরমালিন মিশ্রিত হয়ে যায়, রক্ষকই যেখানে ভক্ষক হয়ে যায় সেখানে অপরাধ দূর হবে কিভাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ইসলামী সমাজের কেন্দ্রস্থল সেই মসজিদের প্রশিক্ষণটি সম্পূর্ণ বিপরীত। মসজিদ ভিত্তিক প্রশিক্ষণে কখনও কোনো ভেজাল ঢুকতে পারে না। এই প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর কারো অন্তরে দুর্নীতি থাকতে পারে না। মানুষের অন্তরে তাকওয়ার বীজ বপন করাই হচ্ছে মসজিদ ভিত্তিক প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য।
রাসূল (সা.) প্রথমত বারবার নসীহত করে মানুষের অন্তরে তাকওয়ার বীজ বপন করেছিলেন। আর এই তাকওয়ার বীজ বপনের কেন্দ্রস্থল ছিল মসজিদ। রাসূল (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে প্রথমে কুবা এবং তার পরে শহরের কেন্দ্রস্থলে প্রথমে যে কাজটি সম্পাদন করেন, তা হলো মসজিদ নির্মাণ। প্রথমে তিনি মদীনার উপকন্ঠে অবস্থিত কুবা নামক স্থানে উপস্থিত হলেন এবং মাত্র চার দিনের অবস্থান কালেই তিনি সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন- যা এখন পর্যন্ত ‘মসজিদে কুবা’ নামে পরিচিত। পরে মদীনার কেন্দ্রস্থলে উপস্থিত হয়েও তিনি সর্বপ্রথম এই মসজিদ নির্মাণের কাজটিই সম্পাদন করেন। মদীনায় অবস্থিত মসজিদে নববী খোদ রাসূল (সা.) ও অন্যান্য মুসলমানের শারীরিক পরিশ্রমের ফলেই নির্মিত। মসজিদ নির্মাণে রাসূল (সা.) এত বেশি আগ্রহী হওয়ার কারণ হলো- মানুষকে মসজিদ মুখী করা। মানুষকে মসজিদমুখী করা ছাড়া সুশীল সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। এ জন্য রাসূল পাক (সা.) প্রতিটি মহল্লায় মহল্লায় মসজিদ নির্মাণ করার নির্দেশ দিয়েছেন (আবু দাউদ, তিরমিজী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত: পৃষ্ঠা-৬৯)। তিনি মসজিদকেই দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় স্থান ঘোষণা করেছেন (বুখারী ও মুসলিম)। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যখন তোমরা কাউকে দেখবে, সে মসজিদে নিয়মিত আসে-যায় এবং তত্ত্বাবধান করে, তখন তার ঈমান আছে বলে তোমরা সাক্ষ্য দেবে। কেননা আল্লাহপাক বলেছেন, ‘আল্লাহর মসজিদসমূহকে আবাদ করে সে, যে আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছে’- সূরা তাওবা: ১৮ (তিরমিজী, ইবনে মাজাহ ও দারেমী)।
মসজিদ হচ্ছে আল্লাহর ঘর। যারা আল্লাহর ঘর মসজিদকে সম্মান করে তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকেই সম্মান করে। মসজিদ আল্লাহর নির্দেশ সমূহের অন্যতম একটি নিদর্শন। আল্লাহর নিদর্শনকে সম্মান করাই হচ্ছে প্রকৃত তাকওয়ার পরিচয়। ইরশাদ হচ্ছে- ‘কেহ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করলে ইহা তো তার হৃদয়ের তাকওয়া সজ্ঞাত’ (সূরা হজ্ব: আয়াত-৩২)। যারা মসজিদে আসা যাওয়া করে, মসজিদের সাথে সম্পর্ক রাখে তাদের সুমহান মর্যাদার বর্ণনা দিয়ে হযরত আবু দারদা (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মসজিদ সমূহ পরকালের বাজার স্বরূপ। যে তার মধ্যে প্রবেশ করবে সে আল্লাহর অতিথি, তার আথিতেয়তা হবে ক্ষমা দ্বারা, আর তার জন্য উপহার উপঢৌকন হলো তাকে সম্মানিত ও মর্যাদাশীল করা’ (হাকিম)। অন্য একখানা হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই দুনিয়ায় আল্লাহর ঘর হলো মসজিদ সমূহ। আর আল্লাহপাক ঐ ব্যক্তির মর্যাদা দানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন যে আল্লাহর ঘর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মসজিদে আসে’। (তাবরানী)।
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে মসজিদ। মুসলমানরা যতই মসজিদমুখী হবে ততই উন্নত চরিত্র গঠন ও সুশীল সমাজ গঠনের সহায়ক হবে। আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই আদর্শ ও সুশীল সমাজ গঠনের লক্ষ্যে আমাদের সকলকে মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করা ও সকলকে মসজিদমুখী হওয়া উচিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।