লড়াই করার শক্তি চাই
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ ডিসেম্বর ২০২২, ৮:৪৪:২৭ অপরাহ্ন
রফিকুর রহমান লজু
বড় হুজুর প্রতিদিন ফজরের নামাজ শেষে মোনাজাতের আগে সাধারণত সূরা মশক করান। তিনি সূরার ছোট ছোট অংশ বলেন আর আমরা নামাজিরা সমবেত কণ্ঠে তা উচ্চারণ করি। হুজুর প্রতিদিনই এমন করেন। কিন্তু সেদিন সূরা মশক না করে, মোনাজাত না করে খুব ভারাক্রান্ত মেজাজে বললেন, আজ রাতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছি, এই কষ্ট সহ্য করতে পারছি না, কষ্টের কথা আপনাদের শেয়ার করছি, উপলব্ধি করতে অনুরোধ করছি। আমরা উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে যাই যে এমন কি কষ্ট হুজুরের। আমরা কান পাতলাম, হুজুরের কথা শোনার জন্য। তিনি বলেন, তাঁর বাসায় মেহমান থাকায় রাতে মসজিদের কোয়ার্টারে এসে রাত যাপন করেছেন। তিনি বলেন চোখ ঢলু ঢলু করলেও চোখ লাগাতে পারেননি। হুজুর বলেন, প্রচণ্ড হৈ চৈ আর গণ্ডগোলে ঘুম পালিয়ে যায় এবং ব্রাজিল ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা আর্জেন্টিনা চিৎকারে ও বোম ফাটার আওয়াজে একটুও ঘুমাতে পারিনি।
বড় পর্দার বড় টিভি মসজিদ মাঠে সেট করে খেলা দেখেছেন এলাকার যুবক-তরুণরা। অতঃপর তারা ঘরে গিয়ে, বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন, ফজরের নামাজ মিস করেছেন। হুজুর আরও বলেন, তাদের কেউ নামাজে উপস্থিত থাকলে ওয়াদা করেন রাত জেগে আর খেলা দেখায় মাতবেন না, মা-বাবা অভিভাবককে পাপী বানাবেন না, মসজিদ মাঠে টেলিভিশন সেট করবেন না, অন্যদের খেলার প্রতি আগ্রহী করবেন না। কেউ এখন উপস্থিত থাকলে এখনই সতর্ক হয়ে যান, অন্যদের সতর্ক করুন এবং এর ব্যবস্থাপনায় কেউ সহযোগিতা করবেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবেও তাদের সঙ্গে কথা বলবো, তাদের বুঝাতে চেষ্টা করবো।
হুজুর আরও বলেন, যারা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করলেন, তাদের খেলোয়াড়দের অভিনন্দিত করলেন, তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখালেন, আসলে তাদের ভালোবাসলেন, ইহুদি-নাসারাদের ভালো বাসলেন। তারা ইহকাল-পরকাল হারালেন। তাদের হাসর হবে ইহুদি নাসারাদের সাথে। লা হাওলা ওলা….।
বৈধ খেলাধুলা তো ইসলামে নিষিদ্ধ বা হারাম নয়। খেলাধুলা শরীর সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখার জন্য ব্যায়াম-দৌঁড়-ঝাঁপ-সাঁতার কাটতে, শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সাধনে, বৈধভাবে আনন্দ উপভোগ করতে সৃজনশীল মননশীলতাকে উৎসাহিত করে। অনুপ্রাণিত করে শারীরিক শক্তি ও প্রফুল্লতা উপলব্ধি করতে। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় কলাম লেখক মুফতি রফিকুল ইসলাম আলমাদানী উক্ত বিষয়ে এক দীর্ঘ কলাম লিখেছেন। আমাদের রায়নগর সোনারপাড়া জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব ও বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ হাফিজ মাওলানা মো. আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী ও ইসলামী বিষয়ে কলাম লেখক মুফতি রফিকুল ইসলাম আল মাদানী উভয়ই এক বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য ও চিন্তা কলাম ও বক্তব্যে তুলে ধরেছেন।
মুফতি আলমাদানী বলেন, নবী মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনে এসব বিষয়ে যথেষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায়। তিনি সাহাবাদের আনন্দ প্রদানের জন্য বাস্তবসম্মত ও আবেগময় রসিকতা করতেন। তাঁর বিবিদের তিনি শিক্ষণীয় গল্প শোনাতেন। তাদের সঙ্গে তিনি দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। বিবি আয়েশা (রা.) বলেন, তিনি এক ভ্রমণে রসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে ছিলেন, তিনি বলেন, আমি তাঁর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করে আমি তাঁর আগে চলে গেলাম। অতঃপর আমি স্বাস্থ্যবতী হয়ে যাওয়ার পর আবারও তাঁর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করলাম, এবার তিনি আমাকে পেছনে ফেলে বিজয়ী হলেন। তিনি তখন বলেন, এই বিজয় সেই বিজয়ের বদলা।’ (আবু দাউদ-২৫৭৮, সহিহ)। রসুলুল্লাহ (সা.) জনৈক সাহাবীকে অনুপ্রাণিত করতে গিয়ে আবেগময় কণ্ঠে ব্যক্ত করেন, ‘আজ আমাদের শ্রেষ্ঠতম অশ্বারোহী হলো, আবু কাতাদাহ এবং শ্রেষ্ঠতম পদাতিক হলো, সালামা।’ (সহিহ মুসলিম-৪৫৭০)। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছেই আমি খেলতাম। তিনি আরও বলেন, আমার কিছু বান্ধবী ছিল তারা আমার সঙ্গে খেলা করতো। তবে রসুলুল্লাহ (সা.) ঘরে প্রবেশ করলে তাঁরা নিরুদ্দেশ হয়ে যেত। তখন তিনি তাঁদের ডেকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন, তাঁরা আমার সঙ্গে খেলা করত। সহিহ বুখারি ৬১৩০)। অপর এক বর্ণনায় রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা তোমাদের বাচ্চাদের সাঁতার ও তীর নিক্ষেপ শিক্ষা দাও। আব্রু মুমিন মহিলাদের জন্য সুতা কাটা ও ভাঁজ করা কতই না সুন্দর বিনোদন।’ (আল মারিফা, ইবনে মান্দাহ।) বিনোদন ও খেলাধুলা সমর্থন করে এমন বর্ণনা মহানবী (সা.) ও সাহাবাগণ থেকে অনেক পরিমাণে উল্লেখ আছে। কয়েকটি নিষেধবাক্য হলো : নামাজের সময় খেলা অথবা এর জন্য নামাজ, রোজা ইত্যাদি ছেড়ে না দেওয়া। খেলা ও বিনোদনের প্রতি অতি নেশাপূর্ণ আসক্ত না হওয়া। পোশাক-পরিচ্ছেদ, আচার আচরণ ও ধর্মীয় নিয়ম নীতি লঙ্ঘন না করা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ ও সময়ের অপচয় রোধ করা। মানসিক বা শারীরিক দিক থেকে কোনো উপকার নেই এমন খেলাধুলা ও বিনোদন পরিহার করা।
হুজুরের কষ্টের কথা এবং আবেগঘন কন্ঠে যুবক তরুণদের প্রতি এত কড়া নসিহত ও নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি আরও কঠিন বক্তব্যের প্রয়োজন উপলব্ধি করলাম। মুফতি রফিকুল ইসলাম আল মাদানী ও আমাদের রায়নগর সোনারপাড়া জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আশরাফ উদ্দিন চৌধুরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা তাঁরা সাম্প্রতিক সময়ের একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং আমাদের বিবেক ও চেতনাকে নাড়া দিয়েছেন।
পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে প্রসঙ্গক্রমে ব্যক্তিগত দু’টি কথা বলছি।
কোনো খেলাধুলার প্রতিই আমার কোনোদিন আগ্রহ বা আকর্ষণ ছিল না। এর একটা কারণ হতে পারে, আমার বাম পায়ে হাঁটুর নিচে একটা কঠিন রোগ হয়েছিল। পা কেটে ফেলার প্রয়োজন হয়েছিল। পা কাটার জন্য অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানোর পর হঠাৎ খেয়াল হয় আমার বাব্বি’র (বড়চাচা) মত নেওয়া হয় নাই। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি তাঁকে জানানো হয়। শোনে তিনি খুব রাগ করেন এবং দ্রুত আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। মহান রাব্বুলের প্রতি শুকরিয়া চিরদিনের জন্য পঙ্গু বা খোঁড়া হওয়া থেকে আমি রক্ষা পাই। হাঁটুর নিচে বড় বিদঘুটে ক্ষতের দাগ এখনো আছে। বাব্বি আমাকে তাঁর ছেলে হিসেবে আদর যত্ন করে বড় করেন। আমি খুব ছোট থাকা অবস্থায় আমার আম্মা পরকালে পাড়ি দেন।
খেলা প্রসঙ্গে আবার আসতে হয়। আমি কাবাডি (হাডুডু) খেলা ভালো পেতাম। খেলতামও সুযোগ পেলে। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় হাত বা পা বাড়ালেই আমি ধরে ফেলতাম, পরে অন্যরা সামাল দিতেন।
পরিশেষে, আবার বলছি কোনও খেলার প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল না, আসক্তি ছিল না কোনও দিন। চলতি বিশ্বকাপ ২০২২-এর তোড়জোড়, রাত জাগা, খাওয়া-দাওয়া, আমোদ-আনন্দ এসবে আমি নেই, আমি পছন্দও করি না এসব।
মহান আল্লাহ, পাপ থেকে বেঁচে থাকার শক্তি দেন, পাপের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার ক্ষমতা দিন আমাকে।
লেখক: সিনিয়র কলাম লেখক ও সাবেক শিক্ষক।