নতুন বছরে দূষণমুক্তির প্রত্যাশা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ ডিসেম্বর ২০২২, ৯:৪৬:৫২ অপরাহ্ন

মোহাম্মদ আব্দুল হক
সময়ের অবিরাম গতি। আমরা সময়ের গতির সাথে নিজেদেরকে নানান রকম কাজে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হিসাব মিলিয়ে চলতে থাকি কিছু সেকেন্ড মিনিট ঘন্টা দিন সপ্তাহ মাস ও বছর জুড়ে। খ্রীস্টিয় সাল গণনার ক্যালেণ্ডারে ৩১ ডিসেম্বরের পরেই শুরু হয় নতুন বছরে সময়ের স্রোতধারা। ক্যালেণ্ডারে প্রতি বছর বারোটি মাসের শেষে নতুন ক্যালেণ্ডারে নতুন স্বপ্ন নিয়ে মানুষের শুরু হয় নতুন দিনের যাত্রা। আমরা সুখে ও দুঃখে কাটাই। আমরা সুন্দরে ও দূষণে কাটাই। আবার নতুন বছরের শুরু হয় গণনা। প্রতি বছর আমরা যাবতীয় দূষণকে পিছনে রেখে এবং যা কিছু সতেজ ও সুন্দর তা সাথে নিয়ে আবার এগিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ নিয়ে আরও অধিক সুন্দরের খোঁজে চলি। আমাদেরকে চলতেই হয়। কারণ আমরা ঘুমে কিংবা জেগে সবসময়ই সময়ের সঙ্গী। আর সময়ের কোনো থামা নেই, তাই ব্যাপক অর্থে আমরা আসলে থামি না বা পিছনে যাই না, আমরা কেবলই চলি। মহাবিশ্ব কেবলই চলে এবং বাংলাদেশ মহাবিশ্বের সঙ্গী, তাই বাংলাদেশ সময়ের সাথেই চলে। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কেমন চলি বা কেমন চলছে বাংলাদেশ? কেমন চলছে পৃথিবী?
রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়ে শুরু করি- ‘দুঃখেরে দেখেছি নিত্য, পাপেরে দেখেছি নানা ছলে;/অশান্তির ঘূর্ণি দেখি জীবনের স্রোতে পলে পলে;/ মৃত্যু করে লুকোচুরি/সমস্ত পৃথিবী জুড়ে’। বিশ্ব জগতের এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ নিয়েই চিন্তা করি। আমাদের নেতৃত্ব থেকে আমরা শুনি আমরা এগিয়েছি। হ্যাঁ, আমরা এগিয়েছি- সাদাকালো টেলিভিশন যুগ থেকে আমরা রঙিন টেলিভিশন যুগে এগিয়েছি, একটিমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভি থেকে এখন আমাদের বিচিত্র অনুষ্ঠান দেখার বহু টেলিভিশন চ্যানেল হয়েছে, ঘরের ভিতরে টেবিলের উপর রাখা টেলিফোন থেকে আমরা মোবাইল ফোনের যুগে এগিয়েছি, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে এখন আমরা দীর্ঘ পদ্মা সেতু পাড়ি দিচ্ছি, আমাদের আরো অনেক অবকাঠামো উন্নয়ন এগুচ্ছে। তারপরও আমরা বহির্বিশ্বে চোখ রাখি এবং বাংলাদেশ কতোটা এগিয়েছে খুঁজি। সেই ১৯৭১ খ্রীস্টিয় সাল থেকে ২০২২ খ্রীস্টিয় সাল পেরিয়ে এসেছি, এবং এই একান্নটা বছর আমরা রাষ্ট্রের কেন্দ্রে থাকা নেতৃত্ব থেকে শুনেছি এগিয়ে যাওয়ার ভাষণ। হ্যাঁ, সন্দেহ নেই গতিশীল সময়ে এগিয়ে যাওয়াই ধর্ম। বিশ্বের গতির সাথে আমরা অচল থাকতে পারি না। কিন্তু; প্রশ্ন জাগে, আমরা যে চলছি বা চলি সেই চলার গতি কতোটা সুন্দরের পথে কিংবা ভাবতে হবে, আমাদের চলার গতি কতোটা প্রকৃষ্ট। আমরা কি দূষণমুক্ত পরিবেশে সময়ের সাথে চলছি। কেমন গতির বাংলাদেশ এবং কেমন গতির পৃথিবী চাই ভাবতে হবে নিশ্চয়ই।
প্রকৃষ্ট গতি অর্থাৎ যে গতিতে উৎকৃষ্ট ফল পাওয়া যায়। ফল তো পঁচাও হয় আবার সুমিষ্টও হয়। তেমনি যে গতিতে প্রগতিশীল চিন্তা মিশে থাকে সেখানে দিনে দিনে উৎকৃষ্ট ফল পাওয়া যায় এবং যে গতিতে লুটপাট, দুর্নীতি, মূর্খতা ইত্যাদি দুষ্ট চিন্তা থাকে সে গতিতে চলতে থাকলেও ফল মিলে পঁচা ও দুর্গন্ধময়। এখন ভাবতে হবে, উৎকৃষ্ট ফল পাওয়ার জন্যে প্রকৃষ্ট গতি কিভাবে ঠিক রাখা যায় এবং সচেতন থাকতে হবে চলার গতিতে কেন পঁচা ফল বা নিকৃষ্ট ফল ভাসে। আমাদের সমাজের রাজনীতি, ধর্মীয়, সাধারণ শিক্ষা, অর্থনীতি, ব্যবসা, বিজ্ঞান, দেশপ্রেম, সেবাকৌশল ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই দুষ্ট চিন্তার মস্তিষ্ক সবসময় সুযোগ খোঁজে যেকোনো উপায়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে সমাজকে অস্থির করার উদ্দেশ্যে। হ্যাঁ, আমরা এক বছর থেকে পরের বছরে এগুচ্ছি। কিন্তু, আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়ে যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব পায়, তারাও হয় লোভে পড়ে, না হয় ভুল করে দুষ্টদের প্রলোভনে পড়ে তাদেরকে সঙ্গে নেয়। এক্ষেত্রে ফল পাওয়া যায়, দুষ্টের প্রভাবে নিকৃষ্ট ফল। তাই বলতেই পারি, আমরা একান্নটা বছর যেভাবে এগুচ্ছি, তাতে বারবার দুষ্টের প্রভাবে উৎকৃষ্ট ফল ভোগ করা থেকে আমরা বারবার বঞ্চিত হয়েছি। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে বিগত একান্নটা বছরে আমাদের সড়ক যোগাযোগ বেড়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে, দীর্ঘসেতু হয়েছে, ব্যাংক বেড়েছে, পুলিশ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে লোকবল বেড়েছে, জনসংখ্যা বেড়েছে, শিক্ষার্থী বেড়েছে। পাশাপাশি আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষের জীবনে শান্তি কমেছে, অশান্তি বেড়েছে, দ্রব্যমূল্য বেড়েছে সীমাহীন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়, মানবিক মূল্যবোধ সেখানে পঁচনদশা বেড়েছে। স্বাধীনতার পরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্নভাবে সমাজের সাধারণ মানুষকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সরকারিতে যারা থাকেন, তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘যারা চাকরি করে তাদেরকে জনগণের টাকায় বেতন দেয়া হয়ে থাকে। কাজেই, সাধারণ জনগণ যেনো সেই সম্মান চাকরিজীবীদের কাছে পায়।’ কিন্তু, দিনে দিনে একান্নটা বছর শেষে দেখা যায়, যারা সরকারি চাকরিতে থাকে, তাদের জায়গা হয়, বাড়ি হয়, গাড়ি হয়। আর সাধারণ কৃষকদের ফসলের মাঠ বছরের পর বছর পানিতে তলিয়ে যায়। শতকোটি টাকা ঋণ খেলাপি বাইরে ঘুরে বেড়ায়, মঞ্চে অতিথি হয়, আর সামান্য হাজার টাকা ঋুণের দায়ে কৃষক জেল খাটে। আমাদের পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। আমাদের সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটে অগণিত। জনগণ ভোট দেয় আর এমপি সাহেবরা শুল্কমুক্ত গাড়ি চালান। এদিকে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক সামান্য সুবিধা আদায়ের জন্যে রাস্তায় মানব বন্ধন করেন, অনশন করেন, পুলিশের ধাক্কা খেয়ে ঘরে চলে যান লজ্জা নিয়ে। পুলিশের সাহায্য নিতে গিয়ে কতোজন দুর্বিষহ কষ্ট ও অপমান সয়েছেন এদেশের পত্রিকা সাক্ষী। হ্যাঁ, এসবই হচ্ছে নেতৃত্বে দুষ্ট চিন্তার মিশ্রণের নিকৃষ্ট ফল। তাই যারা নেতৃত্ব দিবেন তাদেরকে দূষণমুক্ত থাকা জরুরি। আমাদের সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনে একটু শান্তি ও সুন্দর সমাজের আকাক্সক্ষা আমাদের নেতৃত্বের কাছে।
আমরা আমাদের বাংলাদেশের সুন্দর পরিবেশ যেমন চাই, তেমনি চাই সুন্দর দূষণমুক্ত বিশ্ব। আমাদের দেশের শহরগুলো শব্দদূষণের শহর, ব্যর্থ ট্রাফিক সিস্টেমের শহর, আমরা চাই শব্দদূষণ থেকে মুক্তি এবং বাংলাদেশের ট্রাফিক সিস্টেম যেনো সেই পাকিস্তানি আমলের হাতের ইশারায় নিয়ন্ত্রণ করা থেকে মুক্তি পেয়ে সিগনাল বাতির গতিতে চলে। আমাদের রাজনীতিতে দূষণ দেখতে চাই না। আমরা চাই সন্ত্রাসমুক্ত, মানবতাবিরোধী অপরাধী মুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব। আমরা চাই জনগণের ভোটাধিকার, আমরা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখতে চাই। আমরা পাহাড় কাটা দেখতে চাই না। রাস্তায় রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মারামারি দেখতে চাই না। আমরা সিলেটের শিশু রাজনের পরে আর কোনো শিশু নির্যাতন দেখতে চাইনি। তারপরও চট্টগ্রামে শিশু আয়াত ঘটনা দেখতে হলো। এখানে নিরাপত্তা কোথায়? আমরা শিশুদের নিরাপদ বাংলাদেশ দেখতে চাই নতুন বছরে। আমাদের প্রত্যাশা হলো, বাসস্ট্যাণ্ডে, রেল স্টেশনে, শহরের মোড়ে মোড়ে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে বইয়ের দোকান গড়ে উঠুক। আমাদের প্রত্যাশা নতুন বছর থেকে আমরা ফরমালিন মুক্ত ফল যেনো খেতে পাই। আমরা সীমান্ত হত্যা চাই না। আমরা প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে শান্তিময় এক বিশ্ব চাই। আমরা নতুন বছরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেখতে চাই না। আমরা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যা দেখতে চাই না। আমরা রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা শরণার্থীদের শান্তিতে ঘরে ফেরা দেখতে চাই। আমরা চাই অর্থনৈতিক স্থিতিশীল অবস্থা এবং সকল ধর্মের মানুষের সুন্দর দূষণমুক্ত পরিবেশে সহাবস্থান।
যে বছর পিছনে গেছে তা তো গেছে-ই। নতুন বছরের গতি যেনো আমাদের নেতৃত্বকে কোনো দুষ্ট চিন্তা প্রভাবিত করতে না পারে, এই প্রত্যাশা। কারণ, আমরা জানি, দূষণমুক্ত সুন্দর একটা সমাজ পেতে হলে আমাদের সমাজের সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্বকে উৎকৃষ্ট মানুষের কাঠামোয় সাজাতে হবে। হ্যাঁ, আমাদেরকে আরও সচেতন হতে হবে, যাতে করে আমাদের সমাজের নেতৃত্ব দূষণমুক্ত থাকে। দূষণমুক্ত নেতৃত্ব থেকেই দূষণমুক্ত সামাজিক পরিবেশে এবং প্রগতিশীল পথে আমরা চলতে পারবো। নতুন বছরে সকল ক্ষেত্রে দূষণমুক্ত সুন্দরের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক।