স্বপ্ন বিকাশে ছোট কাগজ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:১৬:৪৯ অপরাহ্ন

দুলাল শর্মা চৌধুরী
ছোট কাগজের অস্তিত্ব দুইশ বছর আগেও ছিল না। কিন্তু আজ তার অনিবার্যতা এতই যে, একে ছাড়া শিল্প সাহিত্যের বিকাশই যেন অসম্ভব ব্যাপার। ব্যাপারটা এমন যে, বড় কাগজ সৃষ্টি হওয়ার ফলেই ছোট কাগজের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। কেন না, একটি সম্ভাবনাই আরেকটি সম্ভাবনার পথ তৈরি করে। আর ছোট কাগজই নতুন লেখকদের স্বপ্ন বিকাশে সম্ভাবনার পথের উৎস মুখ খুলে দেয়। পৃথিবীতে এমন এক সময় ছিল যখন লিখিত মাধ্যমই ছিল না, কিন্তু মানুষ তার মেধা দিয়ে অক্ষর তৈরি করেছে এবং তার আকাক্সক্ষা ও বহুমাত্রিক অনুভূতিকে উত্তর পুরুষের জন্য রেখে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছে। মানুষ তখন মাটি, পাথর, গুহা, পশুর চামড়া কিংবা প্যাপিরাসে এগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছে। এইভাবে চলে গেছে হাজার হাজার বছর। তারপর যখন কাগজ উদ্ভাবিত হলো, তাতে মানুষ লিপিবদ্ধ করে রাখতে লাগল তার স্বপ্ন সাধ, বোধ, কল্পনা এবং এইভাবেই পৃথিবী জুড়ে তৈরি হলো লিপিকর শ্রেণি, যারা তাদের পূর্ব পুরুষের লেখাজোখা হাতে লিখে ছড়িয়ে দিতে লাগল। এইভাবে ধীরে ধীরে ছোট কাগজ যখন বিকশিত হতে থাকল, তখনই বহুভাষাভাষী ও বহু সংস্কৃতিতে বিভক্ত মানবজাতি পরস্পরের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলো ছোট কাগজের কল্যাণে।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, সাহিত্য যেমন আদিকাল থেকেই ভাষাকে জীবিত রেখেছে, ঠিক তেমনি ছোট কাগজ শিল্প সাহিত্য-সংস্কৃতি ও নতুন লেখকদের সৃজনশীল সৃষ্টিশীলতা কে বিকশিত হওয়ার স্বপ্ন পূরণে ছোট কাগজের ভূমিকা অপরিসীম। তাই, সাহিত্য এবং লেখক সৃষ্টিতে ছোট কাগজকে আদিমাতা বলা হয়। ছোট কাগজ হলো একদল স্বেচ্ছাসেবী ও ত্যাগী মানসিকতার সৃষ্টিশীল লেখকদের প্লাটফর্ম। ছোট কাগজ হচ্ছে এমন একটা ঘর, যেখানে অনেক সৃষ্টিশীল লেখক একসাথে বাস করেন। ছোট কাগজে সাহস অবশ্যই দরকার, তার চেয়ে বেশি দরকার সৃজনশীলতা। সাহস অনেক ক্ষেত্রেই অন্ধ, আর নতুন সৃষ্টি মানে নতুন চোখ, নতুন দৃষ্টি। সংঘবদ্ধতা ছোট কাগজের এক অনিবার্য বৈশিষ্ট্য।
লেখকদের মধ্যে অনেক আছেন যারা ছোট কাগজে লিখতে চান না। তারা মনে করেন ছোট কাগজে লিখলে মান কমে যাবে, আর বড় কাগজে লিখলে মান বড় হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেটা ভালো না খারাপ। ছোট কাগজ হলো একজন লেখকের বীজ ভূমি। বাংলা ভাষার ছোট কাগজে না লিখে কেউ লেখক হননি। কারণ ছোট কাগজে একজন নবীন লেখককে হাত পাকানোর অনুশীলনকে প্রশ্রয় দেয়। ছোট কাগজ সব সময় লেখা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, এবং প্রয়োজন মতো তীব্র সমালোচনাও করে। ছোট কাগজে নবীন লেখকদের দীপ্তপদচারণা, সৃজনশীল, সৃষ্টিশীলতায় মগ্ন ভালোবাসা আর প্রচ্ছন্ন বা প্রকট প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে লেখকের হাতেখড়ি হয়। ছোট কাগজে কবিতা, গল্প, ছড়া লিখে সহজেই সাহিত্যের প্রাথমিক গোষ্ঠীতে পরিচিত ও আদরনীয় হয়ে ওঠেন তরুণ লেখক। এই প্রাথমিক কবি, গল্প, ছড়া লেখার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কবি, গল্পকার, ছড়াকারদের ছোট কাগজে ইচ্ছেমত ভাষার ব্যবহার করে এক নিজস্ব ভাষা তৈরি করে নেন এবং সেই ভাষা লেখককে ছোট কাগজের মাধ্যমে শহর, নগর, গ্রামে পাঠকদের কাছে পরিচিতি এনে দেয়। লেখার এই প্রাথমিক গণ্ডিকে অতিক্রম করে যারা বড় কাগজে প্রথম লেখাটি ছাপাতে চান, এবং রাতারাতি বড় লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তারা যেন বিনা টিকেটের যাত্রী। ছোট কাগজের টিকেট না কেটেই বড় কাগজের এক্সপ্রেসে উঠে পড়তে চান। আগে ছোট কাগজে লিখে হাত পাকান। তারপর বড় কাগজে লিখুন। নবীন লেখক যারা আছেন, আপনি যেই হোন, প্রথমে ছোট কাগজের মাধ্যমে নিজেকে দীক্ষিত করুন। তারপর সমৃদ্ধতর সেই লেখা নিয়ে বড় কাগজের বৃহত্তর পাঠক গোষ্ঠীর মুখোমুখি দাঁড়ান।
বড় কাগজের সঙ্গে ছোট কাগজের যুদ্ধ মান-অভিমান-রেষারেষি বাংলা সাহিত্যের এক অনিবার্য প্রক্রিয়া। কারণ এই জেদ রেষারেষি থেকেই লেখার মান উন্নততর হয়। নতুন লেখক এই প্রক্রিয়াকে বাদ দিয়ে সৃজনশীল লেখক হওয়ার জন্য সাহসী হতে হয়, তবে তা তার স্বরে চেঁচানো বা অনেক কাকের কা কা রব তোলার জন্য নয়। বরং এ যেন এক গহীন অরণ্য, যেখানে থাকবে অনেক পাখি যারা সবাই মিলে এক নিজস্ব ঐক্যতান তৈরি করবে। মনোযোগ দিয়ে শুনলে যাতে প্রত্যেকেরই সুর পৃথকভাবে শোনা যায়। ছোট কাগজটি আসলে সেই অরণ্য। তাই স্বপ্ন বিকাশে ছোট কাগজকে বাঁচিয়ে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক।