৫১ বছর পরের এক বিজয় মিছিল
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:২৯:৪৯ অপরাহ্ন
ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
বিশ্বজুড়ে প্রতিমুহূর্তে কতো ঘটনাই না ঘটে চলেছে। কিন্তু সব খবরই খবরের পাতায় খবর হয়ে মানুষের কাছে আসছে না। অর্থাৎ সব খবরই খবর নয়। কোন কোনটি খবর হিসেবে পত্র পত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে। যেমন ধরুন একটি রাস্তার কুকুর একজন পথচারীকে কামড়ালো। এটি একটি খবর হয়তোবা। কিন্তু সেটি উল্লেখযোগ্য কোন খবর বলে ধরে নেয়া যায় না। কারণ কুকুর মাঝে মাঝে মানুষকে কামড়ায়ই। কিন্তু এমন কোন ঘটনা যদি ঘটে যে কোন জায়গায় কোন মানুষ অর্থাৎ সুস্থ মানুষ কোন কুকুরকে কামড়ালো, তখন সংবাদকর্মীগণ ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে দৌড়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাবেন। কে কার আগে সংবাদটি সংগ্রহ করে পত্রিকায় ছাপানোর ব্যবস্থা করতে পারেন তার প্রতিযোগিতা চলে। মোদ্দা কথা হলো, কুকুর মানুষকে কামড়ালো, সেটা খবর নয়, মানুষ কুকুরকে কামড়ালেই সেটা খবর হয়।
তেমনি একটি খবরের শিরোনাম দেখতে পাই ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক ‘জনকন্ঠে’। আর সেটি হলো- ‘স্বাধীনতার ৫১ বছর পর বিহারীদের বিজয় মিছিল। এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায় কেন এটা ‘খবর’ হলো? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ৫১ বছর আগে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধে। একাত্তরে। বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে। কি ছিলো সে ইতিহাস?
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যারা সামান্যতম ঘাটাঘাটি করেন তাদের সে ইতিহাস অজানা থাকার কথা নয়। তবে আমরা যারা একাত্তরে ভরা যৌবনে ছিলাম আমাদের আজকের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সে ইতিহাস জানানো কর্তব্য বলেই মনে করি। আর সে তাগিদ থেকেই এ লিখা। ইতিহাসের একটু ছোঁয়া মিলবে মিছিলে অংশ গ্রহণকারী নতুন প্রজন্মের বিহারি কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের বক্তব্য থেকেই। তারা বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা বাংলাদেশী, এটা আমাদের পরিচয় আমাদের এখনো আটকে পড়া পাকিস্তানি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমাদের পূর্বসূরীরা কী করে গেছেন, বা এই ‘অনাকাক্সিক্ষত’ ঘটনার জন্য আমরা অবশ্যই ‘লজ্জিত’। আমরা এখন আমাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু চাই’। এই নতুন প্রজন্মের বিহারিদের মুখে উচ্চারিত ‘পূর্বসূরি’, ‘অনাকাক্সিক্ষত’ ঘটনা, ‘লজ্জিত’ শব্দগুলো থেকেই সত্যিকার ঘটনা বের হয়ে আসবে। অর্থাৎ সত্যিকার ইতিহাস হলো- ‘অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা’ হলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত বিহারি জনগোষ্ঠী একাত্তরে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হোক তা কখনো তারা চায়নি। তাদের আচার-আচরণে এবং মনেপ্রাণে তারা ছিলো পাকিস্তানি। পাকবাহিনীর বাঙালি নিধনযজ্ঞে তারা ছিলো সহযোগী। এক কথায় বলা যায়, তারা সত্যিকার অর্থেই ছিলো পাকিস্তানি। যে কারণে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকেই তারা এই বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানি বলেই ধরে নেয়া হয়েছিলো এবং এখনও তা-ই। কিন্তু ৫১ বছর পরে ২০২২ এ এসে তারা প্রথমবারের মতো বিজয় মিছিল বের করে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বিজয়কে নিজেদের বিজয় বলে স্বীকার করে নেয়।
প্রশ্ন আসে- কেন এমন হলো? উত্তরও সোজা- পাকিস্তানিরা তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়নি। যদিও আত্মসমর্পণকারী ৯৩ হাজার সৈন্যকে তারা ঠিকই ফিরিয়ে নিয়েছে। এইসব আটকে পড়া ৪ লাখ পাকিস্তানি নাগরিক একাত্তরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই তাদের ‘দেশপ্রেমে’র প্রতীক। তারা পাকিস্তানের নাগরিক। তাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসার ব্যবস্থা করা পাকিস্তানের দায়িত্ব। আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি-বিধি-বিধানও তাই বলে। কিন্তু পাকিস্তানি কোন সরকারই সেই বিধি বিধান আইনের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেনি। অর্থাৎ তাদের নাগরিককে ফিরিয়ে নেয়নি। ফলে ঘনবসতিপূর্ণ জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ।
এমতাবস্থায় অতিরিক্ত চার লাখ মানুষের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা যে কতো কঠিন তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু একান্তই মানবিক কারণে বাংলাদেশকে সে বোঝা বইতে হচ্ছে। কই, বাংলাদেশের তথাকথিত ‘সুশীল’ সমাজের সুশীল বাবু সাহেবরা টু শব্দটিও তো উচ্চারণ করেন না। আর সারা বিশ্বজুড়ে যারা তাদের স্বার্থ মোতাবেক মানবতা বা তাদের ভাষায় তথাকথিত ‘হিউমেন রাইটস’ এর জমজমাট ব্যবসা বাণিজ্যের ফেরি করে বেড়ান তারাওতো সেই আটকেপড়া পাকিস্তানিদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেবার ব্যাপারে কোন কথা বলেন না। আটকে পড়া পাকিস্তানিদের নতুন প্রজন্ম তথা তরুণ-তরুণীরা এর জন্য দায়ী নন।
বিপুল জনসংখ্যার চাপে আয়তনে ছ্ট্টো এই বাংলাদেশ তো এমনিতোই ভারাক্রান্ত। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের সমস্যার কথা তো বলে শেষ করার মতো নয়। নিজের মানুষকে তথা নাগরিকদের সমস্যা সমাধানে যেখানে সরকার হিমসিম খাচ্ছে সেখানে এই বাড়তি চাপ সহ্য করার মতো কতোটুকু শক্তি-সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে সে নিয়ে কেউ ভাবছে না। শুধুই দোষ খুঁজে বেড়ায়। অবস্থাটা এমন ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ।’ এই ৫১ বছরের মধ্যে একটিবারও কি ঐ ‘হিউমেন রাইটস’ ওয়ালারা এই আটকে পড়া পাকিস্তানিদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিতে পাকিস্তানের কোন সরকারের ওপর কোন প্রকার চাপ সৃষ্টি করেছেন? করেন নি। কেন করেননি। এর জবাব দেবে কে? ওদের লেলিয়ে দেয়া ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে নিহত মুজিব-আলেন্দেদের হত্যার বিরুদ্ধে মানবতার কথা না বলে উল্লাসই করেছে। এ কোন মানবতা?
যাকগে সে কথা। কথায় কথা আসে; কে শুনে কার কথা। তবে সব কথার শেষ কথা হলো- সময়ের কথা। সঠিক সময়ে সঠিক কথা সময় বলে দেবেই। যেমন বাংলাদেশকে নিয়ে এখন আর কেউ ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ কথা বলেন না। হয়তো লজ্জা পান। এ লজ্জা তো মানবিক লজ্জা নয়! পরাজয়ের লজ্জা।
পাকিস্তানের কুচক্রী মহলেরও বোধ হয় লজ্জা পাবার সময় ঘনিয়ে আসছে। সময়ের কাজ সময় করেই যাচ্ছে। তার আলামত কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এক চিঠি দিয়েছেন এক পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত সুইডিশ বিচারপতি। চিঠিতে তিনি বাংলাদেশে সমাহিত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বিহারি তথা বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানি ভাইয়েরা একাত্তরের বাংলাদেশের বিজয়কে নিজেদেরই বিজয় মনে করে ৫১ বছর পর হলেও ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় মিছিল বের করেছেন। এ বিজয় কার বিজয়! এ বিজয় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়। এ বিজয় মানবতার বিজয়। আরও ৫১ বছর পর কি হবে কে জানে। সময়ই সব বলে দেবে। বিচার করবে। আগামী ৫১ বছর পর পাকিস্তানের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানবতাবাদী মানুষের বিজয় মিছিল যে আরও বিশালাকার ধারণ করতে পারে না তা কি কেউ বলতে পারে?
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ব্যাংকার।