বিদায় ২০২২
সম্ভাবনার রৌদ্রালোকে উদ্ভাসিত-২০২৩
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০১ জানুয়ারি ২০২৩, ৬:৪৩:৩২ অপরাহ্ন
![<span style='color:#000;font-size:18px;'>বিদায় ২০২২</span><br/> সম্ভাবনার রৌদ্রালোকে উদ্ভাসিত-২০২৩ <span style='color:#000;font-size:18px;'>বিদায় ২০২২</span><br/> সম্ভাবনার রৌদ্রালোকে উদ্ভাসিত-২০২৩](https://sylheterdak.com.bd/wp-content/uploads/2023/01/Untitled-3-copy.jpg)
আহমাদ সেলিম:
বিবর্ণ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে গোটা পৃথিবীর মানুষ। শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন নয়, গোটা বিশ্বে যুদ্ধ চলছে, টিকে থাকার লড়াই চলছে-এই অনুভূতি কারো একার নয়, সমস্ত পৃথিবীর সব ধর্মের সব বর্ণের মানুষের।
রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ, অর্থনৈতিক যুদ্ধ, রাজনৈতিক যুদ্ধ, সামাজিক যুদ্ধ, সর্বোপরি বেঁচে থাকার কিংবা টিকে থাকার যুদ্ধে লিপ্ত প্রতিটি মানুষ। সেই যুদ্ধ কিংবা সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষেও পতাকা তুলছেন বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ। সব জঞ্জাল পেরিয়ে আজ থেকে নতুন যে বছরে আমরা প্রবেশ করলাম ; তার কাছে শুধু সিলেট কিংবা বাংলাদেশ নয়, সমস্ত পৃথিবীর মানুষের একটাই প্রার্থনা-দেশে দেশে শান্তি বর্ষিত হোক। জীবনের প্রতিটি দিন স্বপ্নের মতো সুন্দর হোক। প্রতিটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। স্নিগ্ধতায় সজ্জীবিত হোক প্রতিটি মানুষের পথচলা।
স্বাগত ২০২৩, বিদায় ২০২২ :
বিগত বছরের মতো ২০২২ সালটা করোনাস্নাত ছিলো না, আবার গাছে গাছে ফুলও ছিলো না। তবে যুদ্ধ ছিলো। ছিলো পাওয়া-না পাওয়ার অজস্র হিসেব-নিকেশ। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো চলছে, এখনো দুই দেশের মধ্যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। সেই যুদ্ধের প্রভাব পড়ছে বিশ্বের সব দেশে। বছরের শেষে এসে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জীবনবিনাশী মহামারি করোনা। চীন, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশে নতুন করে হানা দিয়েছে এই ভাইরাস। কিছুদিন আগে তুষারঝড় বয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কানাডার আকাশজুড়ে। স্মরণকালের সেই ভয়াবহ ঝড়ে নিভে গেছে অনেক জীবন। জীবন গেছে প্রবল বন্যায় জাপান সহ কয়েকটি দেশের মানুষের। তার পূর্বে ক্যালিফোর্নিয়াসহ বহু দেশে অধিক তাপমাত্রায় পুড়ে গেছে বনাঞ্চল, সেই সঙ্গে মানুষ। সেই সব দুর্বিপাকে পড়ে সবচেয়ে বেশী অনিরাপদ, সবচেয়ে বেশী হুমকিতে পড়েছে মানুষের মহামূল্যবান জীবন। মানুষ কোনদিকে যাবে, কার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে?
বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাজ্যের মতো দেশ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েছে। বহু মানুষ চাকুরীহারা হয়েছে। টিকে থাকার জন্য মানুষ শহর ছেড়ে শহরতলীতে আশ্রয় নিয়েছে। স্কুলে শিশুদের খাবার কমিয়ে আনা হয়েছে খাদ্যতালিকা থেকে। সেই সংকটের বাইরে ছিলেন না প্রবাসী বাঙালীরা। চরম মানবেতর জীবন পার করেছে আফগানিস্তানের মানুষ। দেশটিতে দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্যসংকট। অনাহারে-অর্ধাহারে প্রতিনিয়তই বাড়ছে অপুষ্টি আর শিশুমৃত্যুর সংখ্যা। অনেক বাসিন্দা তাদের ক্ষুধার্ত সন্তানদের খাবার দিতে না পেরে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রাখছেন। এমনকি অনেকে খাবারের খরচ জোগাতে নিজেদের কিডনি ও সন্তানও বিক্রি করার খবর ছাপিয়েছে বিবিসি। অন্যদিকে মানুষ হত্যার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করছে যুদ্ধে লিপ্ত দুই দেশ।
বিক্ষোভে উত্তাল ছিল ইরান। নীতি পুলিশের হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যু ঘিরে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ এখনো চলছে। ১০০ দিনের বেশি সময় ধরে চলা বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত নারী, শিশুসহ ৪৭৬ জন নিহত হয়েছেন। গত বছর বিশ্বে ৬৬ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন।
নেতিবাচক সমস্ত বিষয়গুলোর প্রভাব পড়েছে সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও। তবে সবচেয়ে বেশী আলোচিত ছিলো ২০২২ সালে সিলেটের বন্যা। যে বন্যা শতাধিক বছরের ইতিহাসে দেখেনি বাংলাদেশের মানুষ। সেই বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, বেঁচে থাকার শেষসম্বল। দীর্ঘস্থায়ী সেই বন্যা ঘরে ঘরে এক ধরণের দুর্ভিক্ষ তৈরী করে দিয়েছিলো। তবে সেই দুর্ভিক্ষ থেকেও আমরা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। অবশ্য এর পেছনে সরকারের পাশাপাশি ছিলো ব্যক্তি থেকে শুরু করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং পেশাজীবী মানুষের অনন্য দৃষ্টান্ত। সেই মানবতা এতটাই শক্তিশালী ছিলো, কোনো মানুষ না খেয়ে মরতে হয়নি বন্যার কবলে পড়ে। সিলেট ছাড়াও সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিদেশ থেকে ছুটে এসেছেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু সিলেটের প্রবাসীরা।
তারপর বন্যা শেষে শুরু হলো ঘুরে দাঁড়াবার যুদ্ধ। আর সেই লড়াইয়েও আমরা হারিনি। বাঙালীর হারাবার ইতিহাস নেই। আমরা যুদ্ধে হারিনি, আমরা সংকটেও মাথা নোয়াবো না। সেই না হারা কিংবা এগিয়ে যাবার পেছনে অনুপ্রেরণা ছিলো দেশের কিছু সুখবর।
গোটা বিশ্বে যখন চরম অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, সেই সময়ে অর্থাৎ ২০২২ সালে আমরা সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত করেছি পদ্মাসেতু। ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার মেট্রোরেল যোগাযোগ চালু হয়েছে। ২১ ডিসেম্বর দেশের ৫০টি জেলায় উন্নয়নকৃত ১০০টি মহাসড়কের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। ২৬ নভেম্বর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীর তলদেশে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’-এর দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজ সম্পন্ন হয়। ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী দেশের ২৫টি জেলায় ১০০টি সেতু নির্মাণ করে উদ্বোধন করেন। তারপর ১৯ অক্টোবর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিট-২ এর রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপন, ২১ মার্চ পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র (১ম পর্যায়) উদ্বোধন হয়। এছাড়া আরো অনেক মেগা ও মাঝারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজও পুরোদমে এগিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে বছরের শেষের দিকে এসে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়। সেই কর্মসূচিকে ঘিরে রাজনীতির মাঠ আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠে। সরকার এবং বিরোধীদল অবস্থান নেয় মুখোমুখি। তখন পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে ওঠে। বছরের শেষ সময়ে এসে দেশের রাজনীতিতে এমন অস্থিতিশীলতা মোটেই কাম্য নয় মানুষের।
অতীতেও বিশ্বকাপ ফুটবল হয়েছে, কিন্তু ২০২২ সালটা ছিলো ব্যতিক্রম, অন্যরকম। আর্জেন্টিনার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের অভূতপূর্ব ভালোবাসা বিশ্ব গণমাধ্যমকেও ছুঁয়ে গেছে। মাঠে না খেলেও বাংলাদেশের নাম স্থান করে নিয়েছে আর্জেন্টিনাবাসীর হৃদয়ে। আনন্দের পাশাপাশি সারা বিশ্বকে বেদনায় ভাসিয়েছে বছরের শেষ সময়ে এসে ফুটবলের রাজা পেলের মৃত্যু সংবাদ। বিদায়ী বছরে আরেকটি বড় সাফল্য ছিলো দেশের নারী ফুটবল দলের সাফ চ্যাম্পিয়ানশীপের শিরোপা জয়।
আমরা হারিয়েছি আমাদের সিলেটের কৃতিসন্তান, সাবেক অর্থমন্ত্রী, কূটনীতিক ও মুক্তিযোদ্ধা প্রজ্ঞাদীপ্ত মানুষ আবুল মাল আবদুল মুহিতকে। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
বিগত একটি বছরজুড়ে ইতিবাচকের পাশাপাশি নেতিবাচক অনেক খবরও রয়েছে আমাদের চারপাশে। পাওয়া- না পাওয়া, আনন্দ বেদনার বহু গল্প রয়েছে জীবনজুড়ে। সেগুলো ছাপিয়ে আমরা নতুন এক বছরে প্রবেশ করেছি। সেই বছরটির কাছে বিশ্ববাসীর অনেক প্রত্যাশা। পেছনের অন্ধকার পেরিয়ে সম্ভাবনার রৌদ্রালোকে নতুন বছর কতটা উদ্ভাসিত হবে- সেটিই এখন মুখ্য বিষয়। তবুও আমরা সব ভেদাভেদ ভুলে পরমতসহিষ্ণু মনোভাব নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। আমরা না পাওয়ার গ্লানি মুছে প্রস্ফূটিত ফুলের আবহে খুলে দিতে চাই ৬৮ হাজার গ্রামের প্রতিটি মানুষের দরজা। আমাদের কাছে দূরের আকাশের নীলিমা স্পর্শের চেয়েও অধিক দামি হবে প্রতিটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মূল্য। আমরা ষোল কোটি মানুষ সেই দিনটির অপেক্ষায়। জয় হোক সাম্যের, জয় হোক মানবতার।